
ছবি: সংগৃহীত
আপনি যদি ভাবেন, প্রশ্ন করা মানেই অবিশ্বাস, তাহলে হয়তো দর্শনকে আপনি এখনো ঠিকভাবে বোঝেননি। আমাদের সমাজে এক ধরনের প্রচলিত ধারণা রয়েছে—যারা দার্শনিকতা চর্চা করেন, প্রশ্ন করেন, যুক্তি খোঁজেন, তারা বুঝি ‘নাস্তিক’। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
দার্শনিকতা মানেই কি ঈশ্বরে অবিশ্বাস? না, দর্শন মানে হচ্ছে চিন্তার দরজা খোলা, যুক্তির আলোয় যাত্রা করা। দর্শন প্রশ্ন করে, অন্ধ অনুসরণ করে না। এটি বিশ্বাসের বিরুদ্ধ শক্তি নয়, বরং বিশ্বাসকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক পথ।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, দার্শনিকদের মধ্যে কেউ কেউ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, কেউ আবার প্রশ্ন করতেন তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে। যেমন, ইম্যানুয়েল ক্যান্ট মনে করতেন নৈতিকতা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। সরেন কেয়ারকেগার ছিলেন খ্রিস্টান দার্শনিক, যিনি ঈশ্বরের প্রেম ও বিশ্বাসকে দর্শনের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। সুফি কবি ও চিন্তাবিদ রুমি তার দর্শন ও কাব্যে ঈশ্বরের সঙ্গে ভালোবাসার গভীর সম্পর্ক তুলে ধরেছেন।
অন্যদিকে, বার্ট্রান্ড রাসেল বা কার্ল মার্কস ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখেননি। কিন্তু তাদের দর্শন শুধুই অবিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল না—তা ছিল সমাজ, রাজনীতি, এবং মানবজীবনের গভীর বিশ্লেষণ।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, দার্শনিক মানেই নাস্তিক এই ধারণাটা কেন ছড়াল? সম্ভবত এর কারণ, দার্শনিকরা সবকিছুকে প্রশ্নের চোখে দেখেন। তারা সমাজের প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ, ধর্ম, সংস্কার—সব কিছুতেই যুক্তির আলো ফেলেন। আর আমাদের সমাজে অনেক সময় প্রশ্ন করাকে অবিশ্বাসের সমান ভাবা হয়।
তবে প্রকৃত দর্শন কখনোই বিশ্বাসকে ভেঙে দিতে চায় না। বরং বিশ্বাসকে বুঝতে চায়, গঠন করতে চায়, প্রশ্ন করতে চায়—যাতে সে বিশ্বাস হয় আত্মিক এবং যুক্তির সমন্বয়ে গঠিত।
একবার এক তরুণ একটি দার্শনিককে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি কি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন?” দার্শনিক উত্তরে বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি না যেমন সবাই করে। আমি সৃষ্টিকর্তাকে বোঝার চেষ্টা করি, কেননা আমি তাঁকে ভালোবাসি।”
এই উত্তরের মধ্যে লুকিয়ে আছে দর্শনের প্রকৃত স্বরূপ। যারা শুধুই অনুসরণ করে, তারা হয়তো বিশ্বাসী। কিন্তু যারা বোঝে এবং প্রশ্ন করে, তারা হয়তো আরও গভীর বিশ্বাসী—একজন দার্শনিকের মতো।
সব দার্শনিক নাস্তিক নন। তারা শুধু চোখ মেলে চেয়ে থাকেন সেই অদৃশ্য সত্যের দিকে, যাকে ধর্ম বলে ঈশ্বর, আর দর্শন বলে তত্ত্ব। তাই প্রশ্ন করাকে অবিশ্বাস নয়, বরং বোঝার শুরু হিসেবে দেখা উচিত। একজন চিন্তাশীল মানুষ অবশ্যই ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে পারেন—তবে তা অন্ধ নয়, জাগ্রত ও যুক্তিসম্মত।
এসএফ