ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

রাজশাহীর একজন যতীন্দ্রনাথের হারিয়ে যাওয়ার গল্প

তানভীরুল আলম তোহা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী

প্রকাশিত: ২০:২১, ২৩ মে ২০২৫

রাজশাহীর একজন যতীন্দ্রনাথের হারিয়ে যাওয়ার গল্প

রাজশাহীর সাহেববাজারের সোনাদীঘি মোড়ে একসময় দাঁড়িয়ে থাকত একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। চোখ এড়ানোর উপায় ছিল না। পথচারী হোন কিংবা যাত্রী, শহরে ঢুকেই নজরে পড়ত সেই সাদা মর্মর পাথরে গড়া মানুষটি। না, তিনি ছিলেন না কোনো রাজনৈতিক নেতা, ছিলেন না কোনো বিখ্যাত লেখক কিংবা ধর্মগুরু। ছিলেন একেবারে সাধারণ এক মানুষ—যিনি তার অসাধারণ আত্মত্যাগের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিলেন আমাদের শহরের অন্তর্গত ইতিহাসের এক উজ্জ্বল চিহ্ন।

তার নাম ছিল যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। একজন এমএ, বি-এল ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষ, কিন্তু তাঁর পরিচয় আসলে আরেক জায়গায়—একটি প্রাণময় মানবিকতার জায়গায়। ইতিহাস বলে, প্রমত্ত পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়া দুই নারীর বিপন্ন অবস্থায় এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নিঃসঙ্কোচে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নদীর উত্তাল স্রোতে। দুজনকেই বাঁচিয়ে তুলেছিলেন, কিন্তু নিজে আর ফিরতে পারেননি। অগাধ জলের বুকে হারিয়ে গিয়েছিলেন চিরতরে।

এই আত্মত্যাগ ভুলে যায়নি রাজশাহীর মানুষ। ডুবে যাওয়া পরিবারই কলকাতার একজন শিল্পীকে দিয়ে তৈরি করিয়েছিল সেই ভাস্কর্য, আর শহরের কেন্দ্রস্থলে সেটি স্থাপন করা হয়েছিল শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে। যুগের পর যুগ এই ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে থেকেছে আমাদের শহরের হৃদয়ে। আর সেই সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকেছে এক মানবিকতার বার্তা নিয়ে—জীবন যদি সত্যিই সার্থক হয়, তবে তা অন্যের জন্য উৎসর্গে।

সোনাদীঘির মোড় দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করেন যারা, তাদের জন্য এই ভাস্কর্য ছিল এক নীরব শিক্ষক। পড়তে শেখার আগেই যেন সবাই বুঝে যেত এই মানুষটি ছিলেন কোনো অন্যরকম। স্মৃতির পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা তার গল্প ।

এই নতুন চেতনার শহরে যতীন্দ্রনাথের মতো আত্মত্যাগী মানুষদের আর কদর নেই বলেই হয়তো ভাস্কর্যটিকেও আর জায়গা দেওয়া হয়নি। রাজশাহীর পুরাতন সিটি কর্পোরেশন ভবন ভেঙে যখন বহুতল আধুনিক স্থাপনার কাজ শুরু হলো, তখন ‘উন্নয়ন’-এর নামে এক গভীর রাতে সরিয়ে নেওয়া হলো এই মানবিকতার প্রতীককে। শহরের বুক থেকে যেন মুছে ফেলা হলো এক নিঃস্বার্থ আত্মদান আর নাগরিক মূল্যবোধের পাঠ।

স্মরণশীল কিছু মানুষ প্রতিবাদ করেছিল, কেউ কেউ বলেছিল—“এটা কোনো পাথরের ভাস্কর্য নয়, এটা আমাদের শহরের আত্মা।” তবুও এই গলা আধুনিক যন্ত্রের শব্দে ঢাকা পড়ে গেছে। দিন যায়, মানুষও ভুলে যায়। এখনকার প্রজন্ জানেই না সাহেববাজার মোড়ে একদিন দাঁড়িয়ে থাকত এমন একজন লোক, যার জীবনের কাহিনী ছিল পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বড় ।

আজ যখন শহরের অলিতে-গলিতে উঠছে উন্নয়নের কংক্রিট দেয়াল, ঠিক তখনই হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক মূল্যবোধের চিহ্ন। সোনাদীঘির পাড় দিয়ে হেঁটে যাওয়া শিশুরা আর চোখে পায় না সেই ভাস্কর্য, তারা আর প্রশ্ন করে না, “কে এই মানুষ? তার হাত নেই কেনো ” কারণ দেখানোর মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

একজন যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন, যিনি নিজের জীবন কে উৎসর্গ করেছিলেন অচেনা দুই মানুষের প্রাণ বাঁচাতে। আর এমন আত্মত্যাগের কথা কেবল ইতিহাস নয়, নাগরিক মূল্যবোধের স্মারক হিসেবেও সংরক্ষণ করা জরুরি।
 

সাব্বির

×