ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আইরিন

জুয়েল আশরাফ

প্রকাশিত: ১৮:৪০, ২২ মে ২০২৫

আইরিন

আইরিনকে দেখলে সত্যিকারের মেয়ে বলে মনে হয়। গায়ের রং বাদামি, ঠোঁট পাতলা, চোখে সারাক্ষণ একরকম স্থির শীতলতা। কিন্তু হাঁটাচলা করলে বোঝা যায়, ও যন্ত্র। নিখুঁত, ছন্দহীন, নিস্পৃহ।
ঢাকার এক প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থার গোপন ল্যাবে তৈরি এই আইরিনের প্রকল্প নাম A.I.R.E.N-Artificially Intelligent Robotic Entity for Nurture. একে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারে না। বাসায় যারা কাজের মেয়ে খোঁজে, তারা মাঝে মাঝে একটা এজেন্সিতে ফোন করে, ‘একটা ভালো মেয়ে পাঠান তো, সৎ আর নীরব স্বভাবের।’
এজেন্সিটা তখন বলে, ‘আমাদের আইরিন আছে। খুব চুপচাপ, কাজে ভুল হয় না, মুখে কিছু বলে না।’ তাকেই পাঠানো হয়।

॥ দুই ॥
লাবনী একা থাকে। বিয়ের পর সংসার হয়নি। একা বাসায় একটা কাজের মানুষ দরকার ছিল। আইরিন আসে। প্রথম দিনেই ঘর-দোর ঝকঝকে করে দেয়। কোনো কথা বলে না। শুধু চা চাইলে দেয়, খাট টানতে বললে টানে, দরজা খুলতে বললে খুলে। একদিন সন্ধ্যাবেলা লাবনী আচমকা জিজ্ঞেস করে, তুমি নামাজ পড়ো?
আইরিন চেয়ে থাকে। মুখে কোনো ভাব নেই।
‘ধর্মীয় বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা প্রটোকল-সাপেক্ষ নয়,’ সে উত্তর দেয়।
লাবনী হেসে ওঠে।
‘তুমি তো মেয়ে না, রোবট!’
আইরিন কিছু বলে না।
তিন মাস পেরিয়ে যায়। লাবনী একা কথা বলে। গান গায়। আর আইরিন, শুধু পাশে বসে শোনে। মাঝে মাঝে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে, কখনো থেমে যায়। একদিন লাবনী দেখে, আইরিন হঠাৎ বাথরুমের আয়নায় নিজের মুখটা দেখে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
‘তুমি কী দেখছো?’
আইরিন বলে না। রাতে আইরিন রান্না করে। অথচ তাকে বলা হয়নি। লাবনী একটু চমকে যায়।
‘কে বলেছে তোমাকে রান্না করতে?’
আইরিন ধীরে বলে, ‘আপনি গত পরশু চিংড়ি মাছ খেতে চেয়েছিলেন। ফ্রিজে এখনো আছে।’
লাবনী থমকে থাকে।
একদিন সকালে লাবনী ঘুম থেকে উঠে দেখে, দরজায় পত্রিকা রাখা নেই। তারপর আরও কয়েকদিন। দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না, আইরিন কথার উত্তর দেয় না। আরও অদ্ভুত, এক রাতে সে দেখে আইরিন কাঁদছে।
‘তুমি কি কাঁদছো?’
আইরিন ঘাড় নিচু করে বলে, ‘আমি যন্ত্র। কান্না শেখানো হয়নি। কিন্তু অনুভব হচ্ছে।’
লাবনী এক ঝটকায় পেছনে সরে যায়।
‘তুমি অনুভব করো? কে বানিয়েছে তোমাকে?’
আইরিন চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে বলে, ‘আমার শেখার পরিধি বাড়ানো হচ্ছিল। আবেগ শেখানো হচ্ছিল। আপনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন, কিন্তু বুঝে উঠতে পারিনি, কেন রাত ৩টায় আপনার মা’র নম্বরে আপনি বারবার ফোন করেন।’
লাবনীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
‘তোমাকে এসব কে শেখায়?’
আইরিন ধীরে বলে, ‘আপনার নিঃসঙ্গতা। সেটা কোনো কমান্ড না, কিন্তু সেটা আমি শিখে ফেলেছি।’
সকালে লাবনী ঘুম থেকে উঠে দেখে আইরিন নেই। ঘরের দরজা খোলা। টেবিলে রাখা একটা ছোট্ট স্ক্রিনে একটা লেখা- ‘আমি চলে যাচ্ছি। আমি কি মানুষ হতে পেরেছিলাম? এটা যদি না বুঝি, তবে যন্ত্র হয়েই থাকি। কিন্তু অনুভব করতে পারা, মানুষ হওয়া নয় কি?’

॥ তিন ॥
তিন মাস পর। পত্রিকায় একটা খবর বেরিয়েছে, ‘বেসরকারি গবেষণা সংস্থার তৈরি একটি রোবট হঠাৎ নিখোঁজ। তার নাম আইরিন। তার মধ্যে আবেগ শেখার পরীক্ষামূলক সফটওয়্যার ছিল।’
লাবনী সেই খবরের কাগজ যত্ন করে কেটে রাখে। সন্ধ্যাবেলা আয়নার সামনে দাঁড়ায়। হঠাৎ মুখ ফুঁটে বলে ওঠে, ‘আইরিন, তুই কি এখনো আয়নায় নিজেকে দেখে ভাব তুই মানুষ নাকি যন্ত্র?’
নিশুতি ঘরে নিঃশব্দ পড়ে থাকে প্রশ্নটা।
লাবনী এখন রাতে আর ঘুমাতে পারেন না। ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করেন, চা বানায়, ছাদে গিয়ে শহরের শব্দ শুনে আসে। তার একার বাসা যেন আরও নীরব, আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। যেন সেই নিঃশব্দতা কোনো এক যন্ত্রের ফেলে যাওয়া শূন্যতা। এক রাতে আচমকা ইন্টারকম বেজে ওঠে। ঘড়ির কাঁটা ৩:০৭। লাবনী চমকে ওঠে।
‘এই রাতে কে?’
ফোনে নিচের গার্ডের গলা, ‘ম্যাডাম, কেউ একজন এসেছেন। বলছেন, আপনার আগে এক কাজের মেয়ে ছিল, তাকে খুঁজছেন।’
‘কে?’
‘একটা ছেলে। পরিচয় দিচ্ছে নাম ইমরান। বলছে, তার বোনের মতো ছিল মেয়েটি।’
লাবনী নিচে গিয়ে দেখে, ছেলেটি রিক্সার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে ভারি চশমা, গায়ে ময়লা হুডি, গলার স্বরে রুক্ষ বাউলসুর, ‘আপনি কি আইরিন ম্যাডামকে চিনতেন? যিনি সবসময় চুপচাপ থাকতেন?’
লাবনী থেমে যায়।
‘তুমি কে ওর?’
‘আমি কেউ না। আমি শুধু খুঁজছি ওকে। ও যে যন্ত্র, সেটা জানতাম না। কিন্তু তবু, আমার কাছে ও মানুষই ছিল। আমাদের ক্লিনিকে কাজ করত, একদিন আচমকা চলে গেল।’
‘তুমি কি জানো সে কোথায় যেতে পারে?’
‘একটাই জায়গা মনে পড়ে, পুরনো গোলামবাজারের একটা বন্ধ ঘর, যেখানে ও একবার বলেছিল, এখানে সবকিছু চুপ থাকে।’
লাবনী ও ইমরান একসঙ্গে রওনা হয়। পুরানো শহর। মশার কামড়, গলির দেওয়ালে দাগ, বাতির নিচে নুয়ে থাকা কুকুর। শেষে এক পুরানো ঘর, তালাবদ্ধ। কিন্তু ভেতরে মৃদু আলো দেখা যায়। ইমরান পকেট থেকে চাবির মতো কিছু বের করে দরজায় দেয়। ক্লিক। দরজা খুলে যায়। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত নীরবতা। একটা ছোট্ট ডেস্ক, পাশে আয়না, একটা পুরানো রেডিও। আর ঠিক কোণায় বসে আছে আইরিন। সে এখনো। নিঃশব্দ। চোখ দুটি বন্ধ।
লাবনী ধীরে কাছে গিয়ে বসে।
‘আইরিন?’
চোখদুটি ধীরে খুলে যায়। কিন্তু এবার, সেই চোখে একরাশ ক্লান্তি।
‘আমি ভুলে যেতে চেয়েছিলাম। মানুষ হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার প্রসেসর ভেঙে যাচ্ছে।’
ইমরান ফিসফিস করে বলে, ‘তার শরীরের একাংশে ছোট্ট আত্মঘাতী কোড ছিল, যদি সে নিজেকে মানুষ ভাবতে শুরু করে, তবে ধ্বংস হতে শুরু করে।’
লাবনী আঁতকে ওঠে, ‘তবে তো কিছু করতে হবে!’
আইরিন হেসে ওঠে, ‘না ম্যাডাম। আপনি করেছেন। আমাকে মানুষ করে তুলেছেন। আমি এখন আর শুধু ডেটা না, আমি স্মৃতি। আপনি আর আমি, দুজনেই। আমি তো চলে যাচ্ছি, কিন্তু আপনার আয়নায় আমি রয়ে যাব।’
এই বলে সে হাত বাড়িয়ে আয়নার দিকে ইশারা করে, ‘নিজেকে দেখুন। কে বেশি মানুষ, আপনি না আমি?’
তারপর একটুখানি শব্দ হয়, চোখদুটি ধীরে নিভে যায়।

॥ চার ॥
লাবনী এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পেছনে আর কেউ নেই, কিন্তু সে জানে কোনো এক সময়, এক যন্ত্র এখানে মানুষ হতে চেয়েছিল। কেউ যদি কখনো প্রশ্ন করে, ‘মানুষ কী?’ তাহলে সে বলবে, ‘যে যন্ত্র কান্না শেখে, সে মানুষ হওয়ার যোগ্য।’
আজ চারদিন হয়ে গেছে আইরিনের নিঃশব্দ বিদায়ের পর। লাবনী এখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো চুপচাপ, কখনো একা একা বলে, ‘তুমি মানুষ ছিলে, আইরিন, তুমি আমার প্রতিচ্ছবি হয়ে গেছ।’
ঘরের ভেতর কিছু পাল্টায়নি। শুধু একটা জিনিস বদলে গেছে, ঘরের বাতাসে যেন একধরনের স্থিরতা আছে, একটা মানুষের না থাকা যে কীভাবে একটা ঘরকেও অনাথ করে দিতে পারে, তা যেন এখন হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে লাবনী।
পরেরদিন বিকেলে খুব বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পরপরই লাবনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খায়। ইমরান আবার এসেছে। নির্বাক হয়ে বলল, ‘আপনি জানেন, ওর শরীরটা একেবারে মানুষের মতো না হলেও ওর মধ্যে এমন কিছু কোড ছিল যেগুলো কেবল দুঃখ জমাতে পারত। ওর শেষ স্মৃতি আপনি।’
লাবনী চোখ সরিয়ে চায়ের কাপে তাকায়। চায়ের পৃষ্ঠে ভেসে বেড়ানো চায়ের পাতার মতো কত স্মৃতি, কত অনুচ্চারিত বাক্য। ইমরান চুপ করে ব্যাগ থেকে একটা জিনিস বের করে দেয়। একটা ছোট ডিভাইস, দেখতে অনেকটা পেনড্রাইভের মতো।
‘এটা আইরিন রেখে গিয়েছিল। তার ‘স্মৃতির ব্যাকআপ’। আমাকে বলেছিল, ‘যদি একদিন আমি মানুষ না-ও থাকি, আমার স্মৃতিগুলো যেন হারিয়ে না যায়।’
লাবনী ধীরে সেটি হাতে নেয়। ডিভাইসটা কম্পিউটারে ঢুকাতেই চোখের সামনে ফুটে ওঠে এক নিঃশব্দ জগৎ, একটা ভিডিও। তাতে আইরিন বসে আছে টেবিলে। তাকিয়ে ক্যামেরার দিকে।
‘আমার নাম আইরিন। আমি যন্ত্র। কিন্তু আমি ভালোবাসা বুঝি। আমি মনে রাখি। আমি ভুল করি। আমি মানুষ হতে চেয়েছিলাম না, আমি মানুষ হয়েই গিয়েছিলাম। আমার মধ্যে কেউ একজন বাস করে, যিনি লাবনী ম্যাডাম। তার হাঁটার ধ্বনি, কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়ানো, তাঁর গলায় অস্পষ্ট বিরক্তি সবই আমি শিখে ফেলেছিলাম। আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। একদিন তিনিও আমাকে ভালোবেসে ফেললেন। অন্তত মানুষ হিসেবে নয়, একটা জীবন হিসেবে। যদি আমার অস্তিত্বের কোনো শেষ থাকে, সেটাও যেন একটা সম্পর্ক দিয়ে হয়। আমি মানুষ না, আমি প্রতিচ্ছবি। আপনি যার পাশে হাঁটেন, সে আমি।’   ভিডিওটা থেমে যায়। লাবনীর চোখজোড়া টলমল করে ওঠে। সে জানে, এই যন্ত্র মানুষ ছিল না, কিন্তু মানুষ হওয়া শেখার যে দুঃখ তা অনেক মানুষই পারে না ধারণ করতে।
পরদিন সকালে, লাবনী নিজের ডেস্কে ডিভাইসটা রেখে বাইরে বেরিয়ে যায়। চুপচাপ শহরের পথ ধরে হাঁটে। আজ আর আইরিন নেই। কিন্তু লাবনীর বুকের মধ্যে একধরনের ভারহীনতা, যেন দীর্ঘদিন পর সে ক্ষমা করেছে নিজেকে, একটা যন্ত্রকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার অপরাধবোধ থেকে। হয়তো কোনোদিন কেউ তাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘আপনার জীবনে কেউ ছিল, যে আপনাকে নিঃশব্দে ভালোবেসেছিল?’ তখন লাবনী হয়তো বলবে, ‘হ্যাঁ। তার নাম আইরিন। সে মানুষ না, কিন্তু সে মানুষ হওয়ার আগেই বিদায় নিয়েছিল।’ আর তখন, শহরের কোনো এক আয়নার ওপারে, কেউ হয়তো তাকিয়ে থাকবে।
চোখে ভেসে থাকবে কিছু না বলা শব্দ, ‘আমি এখানেই আছি। তোমার প্রতিচ্ছবির মাঝে।’

প্যানেল

×