ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৩ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলের নারীরা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে

বিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ২২:৪১, ২২ মে ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলের নারীরা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায়। বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই সংকট মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে নেমে এসেছে। তবে নারীদের জীবনে এর প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে নারীদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রা।

শ্যামনগরসহ উপকূলের অনেক এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব এখন নিত্যদিনের বাস্তবতা। মিষ্টি পানির জন্য নারীদের প্রতিদিন পাড়ি দিতে হয় কয়েক কিলোমিটার পথ। গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধা ও কিশোরীদের জন্য এটি হয়ে উঠেছে এক অমানবিক পরিশ্রম। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে গর্ভবতী নারীদের উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া, গর্ভপাত এবং অপরিণত শিশু জন্মের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা বলছে, এটি এখন আর কেবল ব্যক্তিগত সংকট নয়, বরং এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে।

চিংড়ি পোনা ধরা ও কৃষিকাজে নিয়োজিত নারীদের দিনের পর দিন লবণাক্ত পানিতে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে তারা ত্বক, পা এবং প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণে ভুগছেন। জরায়ুর ইনফেকশন এতটাই বেড়েছে যে অনেক নারী বাধ্য হচ্ছেন জরায়ু অপসারণে। জরিপ অনুযায়ী, এসব অঞ্চলে জরায়ু-সংক্রান্ত জটিলতা দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। অপসারণের পর অনেক নারী পারিবারিকভাবে অবহেলিত হচ্ছেন; কেউ কেউ স্বামীর ঘর থেকেও বিতাড়িত হচ্ছেন।

এই স্বাস্থ্যঝুঁকি নারীদের মানসিক অবস্থাকেও প্রভাবিত করছে। সন্তান পালন, গবাদিপশুর যত্ন কিংবা স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টার মাঝেও লুকিয়ে আছে নিরাপত্তাহীনতা ও অসম্ভব শারীরিক চাপ। পুরুষেরা জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হলেও নারীরা থেকে যান সংকট মোকাবেলায়।

সরকারি পর্যায়ে সুপেয় পানি সরবরাহ, বিকল্প জীবিকার প্রশিক্ষণ ও দুর্যোগ প্রস্তুতি কর্মসূচি চালু থাকলেও তা এখনও সীমিত। ব্র্যাক, আইসিসিএডি ও শেয়ার-নেট ইন্টারন্যাশনালসহ কিছু এনজিও নারীদের প্রশিক্ষণ, সচেতনতা ও নেতৃত্ব বিকাশে কাজ করলেও সেটিও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

উপকূলীয় প্রতিটি ইউনিয়নে নারীদের স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা না দিতে পারলে পুরো অঞ্চলটি এক ধরনের জলবায়ু-সৃষ্ট বৈষম্যের শিকার হয়ে পড়বে। নারীরা শুধু ক্ষতিগ্রস্তই নন, তারা এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফ্রন্টলাইনে অবস্থান করছেন। তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত না করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি জাতীয় পর্যায়ে নারীবান্ধব নীতিমালা ও বাজেট বরাদ্দ। নারীদের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে অভিযোজন কৌশল নির্ধারণে উদ্যোগী না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

মিমিয়া

×