
ছবি: সংগৃহীত
আঙুলের ছাপ হল আঙুলের ছাপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য। যা কোনো পদার্থে আঙুল দ্বারা স্পর্শ করলে সৃষ্টি হয়। মানবদেহের আঙুলের ছাপকে একজন ব্যক্তির পুরো ডাটা ব্যাংক বলা হয়। মানুষের ত্বকের ‘ইকরিন গ্ল্য়ান্ডস’ থেকে নিঃসরিত ঘাম কোন কঠিন পদার্থ, যেমনঃ কাচ, পালিশ করা পাথর ইত্যাদির উপর আঙুলের ছাপ তৈরী করে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডারমাটোগ্লিফিক্স (ফবৎসধঃড়মষুঢ়যরপং)। আঙুলের ছাপের সংমিশ্রণে রয়েছে জৈব ও অজৈব উপাদান। জৈব উপাদানে রয়েছে অ্যামিনো এসিড, প্রোটিন, গ্লুকোজ, ল্যাকটোজ, ইউরিয়া, পাইরুভেট, ফ্যাটি এসিড ও স্টেরল। অন্যদিকে অজৈব উপাদানে রয়েছে ক্লোরাইড, সোডিয়াম, পটাসিয়াম ও আয়রন।
প্রাচীন মাটির ট্যাবলেট, সীলমোহর এবং মৃৎপাত্রে, মিশরীয় সমাধিগুলির দেওয়ালে এবং মিনোয়ান, গ্রীক এবং চীনা মৃৎপাত্র আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। প্রাচীন চীনে কর্মকর্তারা তাদের আঙুলের ছাপ দিয়ে সরকারী নথি প্রমাণীকরণ করতেন। প্রায় ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, ব্যাবিলনে লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করা হত। ব্যাবিলনীয় রাজা হাম্মুরাবির সময় (রাজত্বকাল ১৭৯২-১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আইন কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার হওয়া লোকদের আঙুলের ছাপ নিতেন। চীনের কিন রাজবংশের সময়, রেকর্ডে দেখা গেছে যে কর্মকর্তারা অপরাধের দৃশ্য থেকে প্রমাণ হিসাবে হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ এবং আঙুলের ছাপ নিয়েছিলেন। হামাদানি (১২৪৭-১৩১৮) তার জামি আল-তাওয়ারিখ (ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি) গ্রন্থে তাদের আঙুলের ছাপের মাধ্যমে চিহ্নিত করার চীনা অভ্যাসের কথা উল্লেখ করেছেন। ১৬৮৬ সালে, বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানটমি বিভাগের অধ্যাপক মার্সেলো মালপিঘি পৃষ্ঠের উপর রেখে যাওয়া আঙ্গুলের ছাপগুলিতে শিলা, সর্পিল এবং লুপ সনাক্ত করেছিলেন। ১৭৮৮ সালে জার্মান অ্যানাটমিস্ট জোহান ক্রিস্টোফ আন্দ্রেয়াস মায়ার প্রথম ইউরোপীয় যিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে আঙ্গুলের ছাপ প্রতিটি ব্যক্তির জন্য অনন্য। ১৮৮০ সাল থেকে গবেষণা শুরু করে ১৮৯২ সালে ইংল্যান্ডে স্যার হেমচন্দ্র বসু এবং কাজি আজিজুল হক আবিষ্কার করেন যে, পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া যাবে না যার আঙ্গুলে ছাপ অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে হুবহু মিলে যাবে। ব্রিটিশ ভারতে অপরাধ তদন্তের জন্য ১৯ শতকের শেষদিকে হেমচন্দ্রবসু, কাজী আজিজুল হক এবং স্যার এডওয়ার্ড হেনরি দ্বারা বিকশিত হেনরি শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থা হল একটি দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি যার মাধ্যমে আঙ্গুলের ছাপ এক থেকে একাধিক অনুসন্ধানের জন্য শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারে সাজানো হয়।
ব্রিটেনের ‘দ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি’, ‘দ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি আজিজুল হক অ্যান্ড হেমচন্দ্র বোস প্রাইজ’ চালু করেছে। ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার’ নামক যন্ত্রের মাধ্যমে আঙুলের ছাপকে ডিজিটাল ডাটায় রুপান্তর করা যায়। একেকজনের একেক রকম আঙ্গুলের ছাপ হওয়ায় এর ব্যবহার অনেক। যেমনঃ ব্যক্তির স্বাক্ষর, সম্পাদনা, জাতীয় পরিচয় পত্রে, ভিসা আবেদনের জন্য, মোবাইল বা কম্পিউটারে ব্যক্তি শনাক্ত করন, নিরাপত্তা, মোবাইল সংযোগ পেতে, ফরেনসিক সম্পাদনা, আপরাধী সনাক্তকরন করতে এবং উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ সম্পাদনায় আঙুলের ছাপ অন্যতম মাধ্যম। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এই আঙুলের ছাপ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। মানবদেহের চাবি হচ্ছে আঙুলের ছাপ। বিজ্ঞানের বিস্ময়, মানুষের আঙুলের ছাপে এখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞান এটিকে সাম্প্রতিককালে আবিষ্কার করলেও কুরআন ১৫০০ বছর আগে-এর ইঙ্গিত দিয়েছে। ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ওপর কোরআন নাজিল হয়। আর এই কোরআনকে বলা হয় বিজ্ঞানময় কোরআন। সবচেয়ে আশ্চর্যবিষয় হলো আধুনিক বিজ্ঞান-পূর্ব যুগে অর্থাৎ এই আবিষ্কারের শত শত বছর আগে পবিত্র কোরআন এই আঙুলের ছাপ থিওরির তথ্য নিশ্চিত করেছে। অবিশ্বাসীরা একসময় পুনরুত্থানের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করত আর নিজেরা হাসি-তামাশা করে বলত, ‘আমরা মরে গেলে আমাদের শরীরের সব কিছুই তো মাটির সঙ্গে মিশে যাবে, তাহলে আল্লাহ আমাদের অস্থিমজ্জাগুলো আবার কিভাবে একত্র করবেন? এটা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ অবিশ্বাসীদের পুনরুত্থান বিষয়ে সেই সন্দেহের বক্তব্য পবিত্র কোরআনে তুলে ধরেছেন : ‘এবং তারা বলে, আমরা (মৃত্যুর পর) হাড্ডিতে পরিণত হয়ে পচে গেলেও কি নতুন সৃষ্টিরূপে পুনরায় উত্থিত হবো?’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৪৯)। অবিশ্বাসীরা আরো বলত, যা কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে : ‘এ হ”েছ তাদের (যথার্থ) শাস্তি, কেননা তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করত, তারা আরো বলত (মৃত্যুর পর) যখন আমরা অস্থিতে পরিণত হয়ে যাব ও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাব, তখনো কি আমরা নতুন সৃষ্টিরূপে উত্থিত হব?’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৯৮)। অবিশ্বাসীদের ভ্রান্ত ধারণা ও হাসি-তামাশার জবাবে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘মানুষ কি ধরে নিয়েছে, (সে মরে গেলে) আমি তার অস্থিমজ্জাগুলো আর কখনো একত্র করতে পারব না? নিশ্চয়ই (আমি তা পারব) আমি তো বরং তার আঙুলের গিরাগুলোও পুনর্বিন্যস্ত করে দিতে পারব।’ (সুরা : আল-ক্বিয়ামাহ, আয়াত : ৩-৪)। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এ সত্য ১৪০০ বছর আগেই কুরআনে বর্ণিত ছিল। পবিত্র কুরআন সেটি বলে দিয়েছে সেই সময় যখন মানুষ সেটি ধারণাও করত না। এ থেকে বুঝা যায় যে, এটি মহান আল্লাহর কুদরতের এক বিশাল কারিশমা।
জানা যায়, মানবদেহের আঙুলের ছাপকে একজন ব্যক্তির পুরো ডেটা ব্যাংক বলা হয়। এখানেই ব্যক্তির পুরো পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া যাবে না যার আঙুলের ছাপ অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে সম্পূর্ণ মিলে যাবে। একজনের আঙুলের ছাপ অন্যজনের সাথে কোনোভাবেই সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। ১৮৮০ সালে ইংল্যান্ডের স্যার ফ্রান্সিস গোল্ট আবিষ্কার করেন- পৃথিবীর এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া যাবে না, যার আঙুলের ছাপ অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে হুবহু মিলে যাবে। তখন থেকেই দুষ্কৃতকারীদের শনাক্ত করার ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। প্রতিটি মানুষ মৃত কিংবা জীবিত প্রত্যেকেরই ভিন্ন ধরনের অনন্য আঙুলের আঁকিবুকি রয়েছে। আঙুলের এ ছাপের মাধ্যমে বিশ্বের বিশাল বিশাল গোয়েন্দা সংস্থা যেমন- এফবিআই মোসাদ কেজিবি অপরাধী শনাক্ত করতে ব্যবহার করে। পবিত্র কোরআন জ্ঞানীদের জন্য এক মহাবিস্ময়। যার অন্যতম জ্বলন্ত প্রমাণ আঙুলের ছাপ তথা ফিঙ্গার প্রিন্ট।
ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, যিনি বিজ্ঞানকে অল্প জানবেন তিনি নাস্তিক। এই পৃথিবীতে অনেক মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইয়াহুদি ও নাস্তিক সহ সকল ধর্মের কিছু ব্যক্তি সত্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সত্য খুঁজে পেলেই হুমরি খেয়ে আঁকড়ে ধরছেন। এটাকেই হেদায়েত বলা হয়। মোহাম্মদ (সা.) এর অন্যতম সাহাবী ওমর ফারুক (রা.), তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে তিনি যে ভুলগুলি করেছিলাম ওটাও তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে করেছিলাম, তখন তিনি ভাববেন এ মোহাম্মদ (সা.) আমাদের পূর্ব পুরুষদের ধর্ম নিয়ে ভিন্ন কথা বলছেন। নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি হওয়ার জন্য এ মোহাম্মদ (সা.) দায়ী। তাহলে তাকে হত্যা করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এক পর্য্যায়ে তিনি মোহাম্মদের (সা.) মাথা কেটে নেওয়ার জন্য রওনা হলেন, পথিমধ্যে যখন বুঝলেন মোহাম্মদের কথাই সঠিক, মোহাম্মদ (সা.) প্রকৃত নবী ও রাসুল, তখন তিনি মুহাম্মদের মাথা কর্তন করার পরিবর্তে নিজের মাথা মোহাম্মদকে (সা.) দিয়ে আসলেন। অর্থাৎ তিনি বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন। সত্যের সন্ধানে যারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারা যদি এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে গবেষণা করেন, তবে সত্য খুঁজে পাবেন। যে ব্যক্তি সত্য খুঁজে পেলে ওটাকে মেনে নিচ্ছেন, তাকে ভালো মানুষ বলা হয়। এটাই হেদায়েত।
লেখক: ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
আসিফ