ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৩ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রাজপথ ছাড়ল ইশরাক সমর্থকরা

রিট খারিজ, ইশরাকের শপথে বাধা নেই॥ হাইকোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:০৬, ২৩ মে ২০২৫

রিট খারিজ, ইশরাকের শপথে বাধা নেই॥ হাইকোর্ট

রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে সমাবেশস্থলে এসে বৃহস্পতিবার আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র  ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া গেজেট অবৈধ ঘোষণার দাবি এবং তাকে শপথ পড়ানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা চেয়ে করা রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ‘নট মেইনটেইন্যাবল’ বলে পর্যবেক্ষণসহ রিট খারিজ করে দেন আদালত। ফলে, মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথ নিতে আর বাধা নেই বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা।

বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। এদিকে রায় পক্ষে আসার পর সমর্থকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে  ইশরাক হোসেন কর্মসূচী স্থগিত ঘোষণা করেন।  তিনি বলেন, হাইকোর্টের আদেশ শোনার পর আমাদের দল থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা আন্দোলন আপাতত স্থগিত রাখব এবং সরকারকে আগামী ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখব।
এছাড়া বৃহস্পতিবার এ রিটের আদেশকে ঘিরে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মাজার গেট ও বার কাউন্সিল গেটসহ বিভিন্ন প্রবেশপথে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
আদেশের পরে আইনজীবীরা জানান, দুই গ্রাউন্ডে ইশরাকের শপথ ঠেকাতে চাওয়া রিট খারিজ হয়েছে। প্রথমত:  যিনি রিট করেছেন তিনি সংক্ষুব্ধ পক্ষ নন, জনস্বার্থে তার রিট চলতে পারে না। দ্বিতীয়ত: নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ফোরাম আছে। সে ফোরামে বিবাদী পক্ষ (নির্বাচন কমিশন ও ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস) আপিল করতে পারতেন, সেটি তারা করেননি। নির্বাচন কমিশন গেজেটও প্রকাশ করেছে। তাই তৃতীয় পক্ষ এসে রিট করা গ্রহণযোগ্য নয়। 
এদিকে আদেশের পর ইশরাকের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, গড়িমসি না করে এখন সরকারের দায়িত্ব ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা করা। হাইকোর্টের আদেশের পরও শপথ না পড়ালে সেটা হবে আদালত অবমাননা। আমরা আশা করি, সরকার কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করে ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা করবে। অন্যদিকে আদেশের পর রিটকারী আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, তারা হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। 
রিটের ওপর মঙ্গলবার ও বুধবার দুই দফা শুনানির পর বৃহস্পতিবার তা খারিজ করে আদেশ দেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। আদালতে ইশরাকের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তাদের সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান ও অ্যাডভোকেট মাকসুদ উল্লাহ। রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান মিলন।
বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ নিতে দেওয়ার দবিতে এক সপ্তাহ ধরে তার সমর্থকরা আন্দোলন করছিলেন। তাদের আন্দোলনের মধ্যে বৃহস্পতিবার আদালত এই রায় প্রদান করলেন। 
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটির সবশেষ নির্বাচন হয়। এতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে পৌনে ২ লাখ ভোটে হারিয়ে মেয়র হন আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস। কিন্তু শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর গত ২৭ মার্চ ঢাকার নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল সেই ফল বাতিল করে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে এবং সে অনুযায়ী গেজেটও প্রকাশ করে। কিন্তু ইশরাককে যেন শপথ পড়ানো না হয় সেজন্য গত ১৪ মে হাইকোর্টে একটি রিট করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশিদ। সে সঙ্গে বিএনপির বৈদেশিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করা ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও চাওয়া হয় রিটে।
এদিকে ইশরাককে শপথ পড়ানোর দাবিতে ওইদিনই আন্দোলন শুরু করে তার সমর্থকরা। তারা নগর ভবন অবরোধ করে রাখে। এতে এক সপ্তাহ ধরে বলতে গেলে অচল হয়ে আছে নগর ভবন। 
বুধবার যখন হাইকোর্টে এ মামলার শুনানি চলছিল, তখনো মৎস্যভবন ও কাকরাইল এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন ইশরাক সমর্থকরা। এর পাল্টায় বুধবার নির্বাচন ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে অবিলম্বে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি জানায় নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। দলটির অভিযোগ, ইশরাককে মেয়র ঘোষণার গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতিত্ব করেছে।
ওই অভিযোগ অস্বীকার করে নির্বাচন কমিশনের তরফে বলা হয়, এনসিপির দাবি ‘রাজনৈতিক’; নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ে ইসির পক্ষভুক্ত হওয়ার নজির নেই। 
শুনানিতে রিটকারীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে মামলার সময় ইশরাককে জয়ী ঘোষণা করতে হবে, সেই মর্মে কোনো প্রতিকার চাওয়া হয়নি। একই সঙ্গে ইশরাক বেশি ভোট পেয়েছেন সেরকম কিছুই আবেদনে ছিল না। বরং আবেদনে ভোটের ফলে ইশরাক কম ভোট পেয়েছেন মর্মে উল্লেখ  আছে।’ তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে ইশরাকের আবেদনে দুবার সংশোধন করা হয়েছে, যা আইনসম্মত নয়। কারণ, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের মামলায় কোনো আবেদন ৩০ দিন পর সংশোধন করা যায় না। এটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অনেক রায় রয়েছে।’
এদিকে ইশরাকের পক্ষে ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আদালতের রায়ের পর গেজেট হয়ে গেছে। তারা শপথ পড়াতে বাধ্য। এই রিটকারীর রিট করার আইনগত এখতিয়ার নেই। রিট খরচসহ খারিজ চাই। আর ওই রিটকারী কে, তার পরিচয় কী, তার কিছুই নেই। 
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে ॥  হাইকোর্টে রিট খারিজের পর এবার ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসি মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া গেজেট স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করার কথা জানিয়েছেন রিটকারীর আইনজীবী। আদেশের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, গেজেট স্থগিত চেয়ে আগামী রবিবার তারা আপিল বিভাগে আবেদন (সিএমপি) করবেন। এর আগে গেজেটের বৈধতা নিয়ে এবং শপথ পড়ানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা চেয়ে করা রিট পর্যবেক্ষণ দিয়ে সরাসরি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। আরেকটি সূত্র জানায়, শনিবারই সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল দায়ের করা হবে। 
রাজপথ ছাড়ল ইশরাক সমর্থকরা ॥ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথের দাবিতে গত আটদিন ধরে চলা আন্দোলন আপাতত স্থগিত বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন।  তিনি বলেন, হাইকোর্টের আদেশ শোনার পর আমাদের দল থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা আন্দোলন আপাতত স্থগিত রাখব এবং সরকারকে আগামী ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখব। এই সময়ে তাদের যে কর্মকা- সেটার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেব। বর্তমান সরকারের ভেতরে যে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছেন তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সরাসরি সমর্থক এবং সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন। তাদের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন শেষ হবে না। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তিনি এসব কথা বলেন।
ইশরাক বলেন, আইনের শাসনের বিজয় হয়েছে। যেহেতু আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সেহেতু আমরা আশা রাখব সরকার কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে আদালতের রায় বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে যে এজেন্ডা সেটা জনগণের কাছে তুলে ধরবেন। আমাদের নির্দেশনা এমন যে, আজ আমরা রায়টি পেয়েছি, যদি সরকার আবারও টালবাহানা করে, আবারও কালক্ষেপণ করে তাহলে কাল সবাই আমরা এখানে এসে আবার জড়ো হব।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন আমাদের এই কর্মসূচির কারণে সড়কে যানজট সৃষ্টি হয় এবং জনগণ দুর্ভোগে পড়ে। এজন্য আমরা আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। পাশাপাশি আমরা এটাও বলে দিতে চাই, বর্তমান সরকার আমাদের অধিকারবঞ্চিত করতে গিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে আমরা এমন কর্মসূচিতে নামার সিদ্ধান্ত নিই।
এই বিএনপি নেতা বলেন, আমরা আগে যেটা বলেছিলাম যে, ছাত্র প্রতিনিধিসহ অন্যান্য প্রতিনিধিদের পদত্যাগ করতে হবে, সেই দাবি দাবির জায়গায় থাকবে। সরকারের সঙ্গে আমাদের উচ্চপর্যায় থেকে আলাপ-আলোচনা করে এটিকে সমাধান করার চেষ্টা করবে। যদি না হয় তাহলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। একটি একটি করে ধাপ পার হয়ে আমরা আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
রাজপথ ছেড়ে গেছে ইশরাকের সমর্থকরা। অন্তর্বর্তী সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়ার পর কাকরাইল মোড় ও শাহবাগ মোড় ছেড়ে গেছে ইশরাকের সমর্থক ও বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় কাকরাইল মোড়ে এসে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন। এর পরেই কাকরাইল মোড়ের যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ইশরাকের সমর্থকেরা কাকরাইল মোড়ে এসে জড়ো হয়। 
দুপুরে কোর্টের রায় ইশরাকের পক্ষে আসায় নেতাকর্মীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তবে দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে তারা নানা স্লোগান দিতে থাকে। বুধবার সকাল থেকে ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে কাকরাইলে অবস্থান নেয় তার সমর্থকরা। সারারাত সেখানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা।
সরেজমিনে রাজধানীর কাকরাইল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপির নেতাকর্মীরা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে সারারাত অবস্থা করেন কাকরাইল এলাকায়। বৃহস্পদিবার দুপুরের দিকে যখন আদালতের রায় ইশরাকের পক্ষ আসে তখন আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা গেছে ইশরাক সমর্থক ও বিবিন্ন নেতা-কর্র্মীদের। এর সময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দেন। একইসঙ্গে দুই উপদেষ্টার পদত্যাগও দাবি জানান তারা। এ সময় ‘যমুনারে যমুনা আমরা কিন্তু যাব না, এই মাত্র খবর এলো ইশরাক ভাই মেয়র হলো’; ‘এই মুহূর্তে দরকার নির্বাচিত সরকার, দফা এক দাবি এক নির্বাচিত সরকার’; ‘যমুনারে যমুনা, শপথ ছাড়া যাব না’-বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তারা।

×