
উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগীয় শহরে নান্দনিক নকশায় নির্মিত ১০০ শয্যার বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালটি শুধু একটি শোভা বর্ধনকারী অবকাঠামোতেই পরিণত হয়েছে। উন্নয়ন বৈষম্যের ফাঁদ থেকে এখনো মুক্তি মেলেনি রংপুর বিভাগের মানুষজনের।
অবকাঠামো নির্মাণের পাঁচ বছর এবং আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আড়াই বছর পার হয়ে গেলেও হাসপাতালটি চালু হয়নি। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় ভবনের পরিবেশ এখন ভূতুড়ে বাড়ির মতো হয়ে উঠেছে। অযত্ন ও অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে হাসপাতালের অন্যান্য সামগ্রীও। অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনিক নির্দেশনা না থাকা এবং জনবল নিয়োগ না হওয়ায় এটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩১ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা।
তালা বন্ধ ভবন, হতাশ জনসাধারণ
সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শিশু হাসপাতাল ভবনের পুরো চত্বর নিরব নিস্তব্ধ। প্রধান ফটক বন্ধ, প্রতিটি ফটকে তালা ঝুলছে। ভবনের তিনতলায় ওঠার সিঁড়িতেও তালা দেওয়া। ছোট একটি পকেট গেট দিয়ে শুধু প্রবেশাধিকার সীমিত রাখা হয়েছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভবনের নিচতলায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আওতাধীন শিশু বহির্বিভাগ আংশিকভাবে চালু করা হলেও, স্বতন্ত্র হাসপাতালের কার্যক্রম চালু হয়নি। তেমন রোগীও দেখা যায়নি।
হাসপাতালের সামনে স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন,
চীনের দেওয়া ১ হাজার শয্যার হাসপাতাল কোথায় হবে তা নিয়ে তো সবাই আন্দোলন করল, মানববন্ধন করল। অথচ এই শিশু হাসপাতাল চালু না হওয়া নিয়ে কেউ টু শব্দটি করে না। রংপুরের আট জেলায় কোনো শিশু হাসপাতাল নেই, অথচ এখানে অবকাঠামো থাকলেও তা বন্ধ পড়ে আছে। শিশুদের চিকিৎসায় কী ভয়াবহ অবস্থা যাচ্ছে, তা দেখার কেউ নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা রমজান আলী বলেন,সব সরকারের আমলেই রংপুর উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার। এত বড় হাসপাতাল করল, কিন্তু ৫ বছরেও চালু হলো না—এটা খুব দুঃখজনক। এখন প্রশ্ন, শিশুর সেবার দুয়ার কবে খুলবে?
কী আছে এই হাসপাতালে?
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগীয় শহরের সিটি করপোরেশনের সামনে সদর হাসপাতালের ১ একর ৭৮ শতাংশ জমির ওপর তিনতলা ভবন, সুপারিনটেনডেন্ট কোয়ার্টার, ডাক্তার, নার্স, স্টাফ ও ড্রাইভার কোয়ার্টারসহ পুরো কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়।
২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর। ২০২০ সালের ৮ মার্চ ভবনটি জেলা সিভিল সার্জনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
হাসপাতালে রয়েছে –
-
ইমার্জেন্সি
-
আউটডোর
-
চিকিৎসকদের চেম্বার
-
ল্যাব
-
অপারেশন থিয়েটার
-
বার্ন ইউনিট
-
ওয়ার্ড ও কেবিন
বিদ্যুতের সাবস্টেশন স্থাপনের জন্য আলাদা ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে।
করোনার সময় ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল এটি করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল হিসেবে কিছুদিন চালু রাখা হলেও, পরে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
উদ্বোধন হয়েছিল, কিন্তু সেবা আসেনি
২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আনুষ্ঠানিকভাবে হাসপাতালটির উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি জানান,হাসপাতালে ১৫ শয্যার আইসিইউ, সিসিইউ ও ৭০-৮০টি শয্যায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন রয়েছে। দ্রুত জনবল নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে।
কিন্তু উদ্বোধনের পর আজও নেই জনবল, নেই যন্ত্রপাতি।
জনবল লাগবে ৬৫৯ জন!
রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয় সূত্র জানায়, হাসপাতাল পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ৬৫৯ জন জনবল। এর মধ্যে
-
তত্ত্বাবধায়ক ও প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা: ১৮০ জন
-
দ্বিতীয় শ্রেণি (নার্সসহ): ১১৬ জন
-
তৃতীয় শ্রেণি: ৬৩ জন
-
চতুর্থ শ্রেণি: ৩০০ জন
চাহিদাপত্র তৈরি করে ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে কবে নাগাদ অনুমোদন আসবে, তা অনিশ্চিত।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহাবুল আলম বলেন,আমরা আমাদের দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ শেষ করে হস্তান্তর করেছি। কিন্তু জনবল ও যন্ত্রপাতি না থাকায় হাসপাতালটি এখনো চালু হয়নি। প্রশাসনিক অনুমোদন পেলেই এটি চালু করা সম্ভব হবে।
মিমিয়া