
নবযুগ ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা ১৯২০-এর দশকে ভারতে তীব্র রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্থানের সময়, ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি গঠনের মানসে একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন; একই সময়ে নজরুল ইসলাম, মুজফ্ফর আহমদ ও কতিপয় সমমনা ব্যক্তি ব্রিটিশবিরোধী গণজাগরণের লক্ষ্যে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশেরও চিন্তাভাবনা করছিলেন। এ ব্যাপারে ফজলুল হকের বাসভবনে একাধিকবার সভা হয় এবং তাতে পত্রিকার নামসহ অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হয়। শেষপর্যন্ত নজরুলের প্রস্তাব অনুযায়ী পত্রিকার নাম হয় নবযুগ। পরবর্তীতে পত্রিকাটি ঔপনিবেশিক বিরোধী মনোভাব প্রকাশ এবং সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন করার একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল।
নবযুগে প্রকাশিত নজরুলের আবেগময় ও বলিষ্ঠ ভাষায় ব্রিটিশবিরোধী সম্পাদকীয় ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করে। দেশ, জনগণ ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের এমন সম্পাদকীয় বক্তব্য সেকালে দুর্লভ ছিল। নজরুলের চেষ্টায় এতে কবিতা ও সাংবাদিকতার অপূর্ব মিলন ঘটেছিল। নজরুলের রচনাগুণে নবযুগ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
নবযুগের এই জনপ্রিয়তা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন: ‘যথাসময়ের একটু আগে-পিছে ১৯৪১ সালের অক্টোবর নামে ধুম-ধামের সঙ্গে ‘নবযুগ’ বাহির হইল। জোরদার সম্পাদকীয় লিখিলাম। সোজাসুজি মুসলিম লীগ বা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কিছু বলিলাম না। মুসলিম বাংলার বাংলা দৈনিকের আধিক্যের প্রয়োজনের উপরেই জোর দিলাম। তোখড় সম্পাদকীয় হইল। অমনি জোরের সম্পাদকীয় চলিতে লাগিল। সবাই বাহ্ বাহ্ করিতে লাগিলেন ।’
নবযুগ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই ‘নবযুগ’ নামে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এই কবিতার মাধ্যমেই এটা পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ‘নবযুগ’ জনগণের আশা আকাক্সক্ষার ধারক হিসাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। দৈনিক নবযুগকে উদ্দেশ্য করে লেখা ‘নবযুগ’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন,
‘তাই নবযুগ আসিল আবার। রুদ্ধ প্রাণের ধারা
নাচিছে মুক্ত গগনের তলে দুর্ম্মদ মাতোয়ারা।
এই নবযুগ ভুলাইবে ভেদ, ভায়ে ভায়ে হানাহানি,
এই নবযুগ ফেলিবে ক্লৈব্য ভীরুতারে দূরে টানি।’
শেরে বাংলা প্রতিষ্ঠিত সন্ধে দৈনিক নবযুগে কাজি নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় নবযুগ হয়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবিরোধী একটি প্রগতিশীল কাগজ। এতে বাংলার শ্রমিক কৃষকদের কথা তুলে ধরতেন। আরও থাকত ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ত্রাসন এবং রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সম্পাদকীয়। এর বেশিরভাগ লিখতেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নবযুগ ব্রিটিশ শাসকদের মনে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। এই তেজস্বী বিপ্লবীর ক্ষুরধার কলম সশস্ত্র বিপ্লবের বাণী প্রচার করেছিল সেদিন। নবযুগ পত্রিকার বিপুল প্রচার সংখ্যাই প্রমাণ করেছিল যে জনসাধারণকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারা যায় সংবাদপত্রের দ্বারা। তার রচনার সাধারণ আলোচ্য বিষয় ঔপনিবেশিক শাসন, তার প্রক্রিয়া ও কুফল এবং তার প্রতিক্রিয়া ও মোকাবিলা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন এবং তাতে অংশও নিয়েছিলেন। ফলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাটি ছিলে তার সাহিত্যকর্মে বহমান।
পত্রিকাটিতে কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং সমালোচনামূলক মন্তব্যসহ বিভিন্ন ধরনের সাহিত্যের ধারায় অন্যান্য উদীয়মান লেখক এবং চিন্তাবিদদের কর্মের আহ্বানের অবদানের রেখেছিল। অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয় সাংস্কৃতিক লেখক, শিল্পী এবং কর্মীদের জন্য। একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার এ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করে ও পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের চেষ্টায় পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়। পরে ফজলুল হকের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে নজরুল ও মুজফ্ফর আহমদ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করলে পত্রিকাটি আবার বন্ধ হয়ে যায়।
নবযুগ পত্রিকার মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতার সূচনা হয়। রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ইত্যাদি নানা বিষয়ে কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, অমলেন্দু দাশগুপ্ত, শামসুদ্দীন আহমদ, মাওলানা আহম্মদ আলী ও শেখ আবদুল হাকিম প্রমুখ ব্যক্তিদের লেখার কারণেও নবযুগ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদক হিসেবে নজরুল তার নিজস্ব বৈপ্লবিক আদর্শ ও দারিদ্র্য, নিপীড়ন এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের অভিজ্ঞতা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার কবিতা স্বাধীনতা, সাম্য এবং মানবিক মর্যাদা উদযাপন করেছে। যে বিষয়গুলো নবযুগের পাতায় ছড়িয়ে পড়েছে।
নবযুগ নজরুলকে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে তার খ্যাতিকে মজবুত করতে সাহায্য করেছিল।
কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদকীয় উদ্দীপনামূলক নিবন্ধটির শেষাংশ ছিল ব্রিটিশ পরাধীনতা থেকে বাঙালিকে জেগে উঠার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে নিবন্ধে লেখা হয়েছিল: বাঙালিকে, বাঙালির ছেলে-মেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও :
‘এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির আমাদের।
দিয়া ‘প্রহারেন ধন জ্ঞয়’
তাড়াব আমরা, করি না ভয় যত পরদেশী দস্যু ডাকাত
‘রামা’দের ‘গামা’দের।’
২০ দশকের গোড়ার দিকে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পীরা ঔপনিবেশিক শাসন এবং সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করে ভারতীয় জনগণের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে নবযুগের আবির্ভাব ঘটে, যা বাঙালি ও ভারতীয়দের মধ্যে পরিচয় ও গর্ববোধ জাগিয়ে তোলে।
প্যানেল