ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সাহিত্যে উত্তরাধুনিকতা

আতাতুর্ক কামাল পাশা

প্রকাশিত: ১৭:৫৩, ২২ মে ২০২৫

সাহিত্যে উত্তরাধুনিকতা

কবিতা লেখবার ব্যমো একবার যখন কাউকে পেয়ে বসে তখন সে আর স্থির থাকতে পারে না, নিজের হয়ে থাকতে পারে না। তাকে নিশ্চয়ই কেউ তাড়া করে ফেরে। তখন সে কবিতালেখক একজন আত্মসত্তা যতক্ষণ পর্যন্ত তার উদরের সন্তান উগরে দিতে না পারেন, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বস্তি পান না, ঠিক সে রকম কবিতাটি না শেষ করা পর্যন্ত সেই লেখক স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেন না। ঠিক একইরকমভাবে যার মাথায় একবার সুররিয়ালিস্ট ঢুকে যায় শুধু সে-ই বুঝতে পারে, এটি কি জিনিস, অন্যেরা তা অনুধাবন করতে পারে না, ফ্রয়েড তার স্বপ্নতত্ত্বেও এমনটি বুঝিয়েছেন। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে আলোচনা যা প্রজ্ঞায় প্রবেশের জন্য এ কথাগুলো জরুরি ছিল। বহুদিন আগে জামালুদ্দিন বারী নামে একজন কবি ও কলামিস্ট আমাকে বলেছিল, হ্যাঁ, নব্বইয়ের কবিরা আসলেই কিছু লিখছেন, আপনারা এখন তা ধরতে পারছেন না, পরে অনুভব করতে পারবেন। মূলত তিনি উত্তরাধুনিক প্রসঙ্গেই বলছিলেন। উত্তর আধুনিক মূলত বিশাল পরিধি নিয়ে কাজ করে। সৈয়দ শামসুল হক তো একসময় বলেই ফেলেছিলেন, আধুনিকেরই যেখানে শেষ নেই, সেখানে উত্তরাধুনিক আবার কোথা থেকে আসে! কিন্তু হাসনাত আবদুল হাই তার বহু বীক্ষণের বই শিল্পকলার নান্দনিকতা গ্রন্থে একস্থানে উত্তরাধুনিক সম্পর্কে লিখেছেন, “পোস্ট-মডার্নিজম কথাটি অনেক বছর থেকে শিল্প, সাহিত্যের আলোচনায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এর দ্বারা প্রথমত, সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ইতিহাসের একটি সময় পর্বকে চিহ্নিত করা হয়। দ্বিতীয়ত, শব্দটি সেই বিষয়ের ক্ষেত্রে কিছু গুণগত বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা করে। উভয়ক্ষেত্রেই শব্দটির সর্বজনীন প্রয়োগ প্রায় অসম্ভব অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্যের কোনো একটি ক্ষেত্রে পোস্ট-মডার্নিজমের সূচনাপর্ব এবং শনাক্ত করার মতো বৈশিষ্ট্য বলে যা নির্ধারণ করা যায়, অন্য ক্ষেত্রে তা না হয়ে পৃথক ব্যাখ্যা দাবি করে। পোস্ট-মডার্নিজমের এটা নতুন কোনো সমস্যা বা ব্যাপার নয়, মডার্নিজমের প্রসঙ্গেও একই জটিলতা দেখা গিয়েছে।” ঠিক একই জটিলতা পোস্ট-কলোনিয়ালিজম নিয়ে সাহিত্য ও শিল্পকলাতেও দেখা যায়। তবে স্যাররিয়ালিজম যতটা প্রচ্ছন্ন পোস্ট-কলোনিয়ালিজম ততটা প্রচ্ছন্ন নয়।
কোন দেশ, জাতি, সম্প্রদায়ের জন্য ঔপনিবেশিকতা একটা ক্ষতচিহ্ন। এ চিহ্ন শুধু রাষ্ট্র, ভূখণ্ড ও অর্থনীতিকেই নয়, ভাষা, সংস্কৃতি, পরিচয় এবং মনোজগতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এডওয়ার্ড সাইদ তার ঙৎরবহঃধষরংস (১৯৭৮) গ্রন্থে এটি স্পষ্ট করেন যার সঙ্গে হোমি কে. ভাভা, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এ তত্ত্বের উদ্গাতা। তারা বলতে থাকেন, ইউরোপীয়রা যেখানে যেখানে গিয়েছে, অর্থাৎ কলোনি গেড়েছে, সেখানে সেখানে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ পোক্ত করে দিয়েছে। ভারতবর্ষ উপমানচিত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবুও ফরাসি, স্পেনিয়রা চলে গেলে আফ্রিকার নগুইওয়া থিয়ং, গিয়ম অ্যাপেলিনিয়র, চিনুয়া আচেবে, জ্যাঁ রাইস তাদের হাজার বর্ষের ঐতিহ্যের আলোকে লিখতে শুরু করেন।
আমাদের উপমানচিত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঔপনিবেশিক ভাষায় সৃষ্টিশীলতা এনেছেন, কিন্তু হাজার বর্ষের স্বকীয়তায় ফিরে এসেছেন। জসিম উদ্দীন পুরোটিই ঔপনিবেশিক-উত্তর ধারাকেই আঁকড়ে ধরেছেন। শহীদ কাদরী মডার্নিজিমকে প্রাধান্য দিয়ে এক ভিন্নতরো ঔপনিবেশিক-উত্তর চেতনাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে প্রয়াসী ছিলেন।
তবে সম্প্রতি আমাদের এ বাংলার কবিদের মাঝে এক নব্য (ইতিবাচক অর্থে) ধারা প্রভাব বিস্তার করেই চলছে। সত্তর দশকের কবি কাজী মুস্তফা লিখছেন,

মহীর দেয়ালে রেখে
অধমের আঙুলের ছাপ
এ বেলা যাই গো বেনুবালা
বেলা ডুবে যায় দূরে
রাইনের ঢেউয়ের ওপারে
ফের দেখা হবে একদিন
দূর সাংহাই-  কিম্বা
ফ্লোরিডার সবজি বাজারে
অংশ বিশেষ
বিশ^ায়নের গান।  

কবি হাশিম কিয়াম লেখেন,
আত্মজ-আত্মজার রক্তে ভেজা বুকে
ফুটেছে রংবেরঙের ফুল, অপলক তাকিয়ে
আছে কুঁড়ি, গন্ধ নাও, আরো ফুল ফোটাও . . .
ঘন কুয়াশা ছায়া ফেলে, পুড়ে যায় না
যেন আমার সাজানো বাগান; সবুজ আঁচলে বাঁধা
সোনার চাবিতে খুলে ঐশ^র্যের সিন্দুক, কাঁধে কাঁধ
ঠেকিয়ে বসে কলাপাতার পাতে
মেখে নাও উৎসবের ঝোল; সর্বনাশের
আগুনের ঢলে ভেসে গেলে তারা রতির বিদ্ধ
উঠোনের গল্পের আসরের সুখ, বরফ ঝড়ে
আবার জমে যাবে সবুজের ঢেউ
পাহারা দেবার দুর্বার দুপুর . . . .
আর এক কবি আযাদ কালাম লেখেন
সব ফিরে আসে, যে দাঁড়িয়ে ছিলো, সে দাঁড়িয়ে
ছিলো না, ফিরে আসছিলো। একটি সকাল, সেও
বার বার ফেরে। তীব্র বাসনা ফিরে আসবেই। কী
বিকল্প আছে ফিরে আসবার। অবোধ বালক
সেজেও তুমি ফিরে আসবে। . . . .
সময়ের বিশ^াস অন্য এক মূর্ততা বা বিমূর্ততা ডেকে আনে যা থেকে অল্পায়াসে বোধগম্য হয় এ এক নতুন ধারা এবং নতুন ধারায় কথন। ইদানীং বেশ কিছু কবির কবিতায় এমন প্রলেপ দেখা যাচ্ছে। আশা করি, অচিরেই আমরা এমন একটি ধারার মুখোমুখি হবো যা অত্যাধুনিক বা উত্তরাধুনিক এবং আধুনিক ধারার চেয়েও অন্য এক কবিতার আঙিনা বিছিয়ে দেবে। 

প্যানেল

×