
নদীর ভাঙন আতঙ্কে নোয়াখালীর তিন উপজেলা। নদী ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে এসেছে অনেকেরই ঘরের খুব কাছে। যে কোনো সময় বিলীন হবে নদীতে। উৎকণ্ঠিত বাসিন্দারা ভাঙনের দৃশ্য দেখে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
ছোট ফেনী নদীর ভাঙনে তীব্রতর হয়েছে নোয়াখালীর তিন উপজেলা। এতে শত শত ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও সড়ক নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের কারণে অনেকেই ভূমি হারাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যকরী পদক্ষেপের অভাবে সংকট দিন দিন আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ছোট ফেনী নদীসহ আরও দুটি নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে ও নোয়াখালীর তিনটি উপজেলা। এতে নোয়াখালীর তিন উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী ফেনীর প্রায় ১৩ কিলোমিটার অংশে তীব্র ভাঙন হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোট ফেনী নদীর ভাঙন রোধ ও সমুদ্রের লোনাপানির জোয়ার থেকে রক্ষার জন্য সোনাগাজীর কাজীরহাটে নদীর ওপর ১৯৬১ সালে একটি রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সময়োপুযোগী রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে নির্মাণের ৪১ বছর পর ২০০২ সালে রেগুলেটরটি নদীগর্ভে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০০৬ সালে ছোট ফেনী নদীতে কাজীরহাট রেগুলেটরের ২০ কিলোমিটার ভাটিতে মুছাপুর রেগুলেটর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালে রেগুলেটরটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। নির্মাণের ১৪ বছরের মাথায় গতবারের ভয়াবহ বন্যায় মুছাপুর রেগুলেটর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে নদীর দুই পাড়েই এখন তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে।
জানা যায়, ১৯৬১ সালের কাজীরহাট রেগুলেটর ও ২০১০ সালে নির্মিত মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীর পাড়ে রেগুলেটর না থাকায় জোয়ারের পানি ভয়াবহ ভাঙনের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে গত বছরের বন্যার পর থেকে ভাঙন বেড়েছে বহুগুণ। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মুছাপুর রেগুলেটর এলাকা পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও কার্যত অদ্যবদী কোনো পদক্ষেপ দেখছেন না স্থানীয় লোকজন।
সরেজমিন ঘুরে নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর গ্রাম, মাচ্চাঘোনা, পূর্ব চরহাজারী ও চরপার্বতী ইউনিয়নের পূর্ব চরপার্বতী, সোনাগাজী উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের উত্তর চরদরবেশ, উত্তরুপশ্চিম চরদরবেশ, চরসাহাভিকারী, চরইঞ্জিমান, তালতলী, তেল্লারঘাট, ফকিরাপুল, ইতালি মার্কেট এলাকা, চর মজলিশপুর ইউনিয়নের বদরপুর, মিয়াজীর ঘাট গ্রাম, বগাদানা ইউনিয়নের জেলেপাড়া, কুঠিরহাট কাটাখিলা, কালীমন্দির, আউরারখিল, আদর্শগ্রাম, কাজীরহাট স্লুইসগেট, আলমপুর, ধনীপাড়া, সাহেবের ঘাট, পার্শ্ববর্তী উপজেলার ভাষাশহীদ সালাম নগর গ্রামগুলোতে নদী উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ব্যাপক ভাঙন দেখা গেছে। ইতিমধ্যে কয়েক শ পাকা ও আধা পাকা বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
নদীর তীব্র ভাঙনে মানুষজন ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। ছোট ফেনী নদীর জোয়ারের পানির তোড়ে কাজীরহাট থেকে বাংলাবাজার পাকা সড়কের প্রায় ৫০০ মিটার নদীতে বিলীন হয়ে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফলে বাজারের উত্তরাংশে বসবাস করা মানুষজন একমাত্র রাস্তাটি হারিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কোম্পানীগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী সোনাগাজী উপজেলার কৃষিনির্ভর ব্যবসায়ীরা। ভাঙন অব্যাহত থাকায় মানচিত্রে ছোট হয়ে আসছে তিনটি উপজেলা।
চরদরবেশ ইউনিয়নের উত্তর চরসাহাভিকারী গ্রামের বাঁশবাজার এলাকায় ভাঙনের শিকার নারী আমেনা বেগম। তিনি বলেন, তীব্র ভাঙনে তাঁর ঘরের কিছু অংশ নদীতে চলে গেছে। তাঁর মতো এই এলাকার ৪০ থেকে ৪৫ পরিবার নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে। ভাঙন এভাবে অব্যাহত থাকলে কম সময়ের মধ্যে তাঁর ঘরের বাকি অংশও নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা জান্নাতুল কোথায় আশ্রয় নেবেন, সেই চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
একই এলাকার অসহায় আবুল হোসেন বলেন, সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর তাঁকে উপহার দেওয়া হয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই ঘর ইতিমধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে ঘরের মালামাল নিয়ে তিনি এখন অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
চর মজলিশপুর ইউনিয়নের মিয়াজীঘাট গ্রামের দিনমজুর হারিছ মিয়া বলেন, তাঁর বাড়িসংলগ্ন মিয়াজীঘাট থেকে কাজীরহাট মুছাপুর গেট পর্যন্ত সড়কটি নদীভাঙনে বিলীন হতে চলেছে। সড়কের এক মাথার ৯০ শতাংশ নদীতে বিলীন হওয়ায় সড়কসংলগ্ন তাঁর বাড়িটি যেকোনো সময় নদীতে তলিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে তাঁর প্রতিবেশীদের তিনটি বাড়ি নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিএনপি দলীয় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ জানান, নদীভাঙনের কারণে এলাকায় নদীতীরের অনেক মানুষ ঘরবাড়ি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ নদীতীরে গাছ ও বাঁশ দিয়ে বাঁধ তৈরি করে বসতবাড়ি রক্ষার চেষ্টা করছেন। এভাবে নদীভাঙন অব্যাহত থাকলে সড়কটিও নদীতে চলে যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীভাঙন রোধে দৃশ্যমান কোনো কাজ করছে না।
এলাকার জনপ্রতিনিধি জানান, নদীভাঙন প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে এসে ঘুরে তথ্য নিয়ে যান। তবে কাজের কাজ কিছুই চোখে পড়ে না।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, ছোট ফেনী নদী, ফেনী নদী এবং কালিদাস পাহালিয়া নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে ফেনীর চার উপজেলা। এতে প্রায় ১৩ কিলোমিটার অংশে ভাঙন হচ্ছে। ছোট ফেনী নদীর ভাঙন প্রতিরোধে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘বি স্ট্রং’ নামে একটি প্রকল্প সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়েছে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
রাজু