দুপুরের চিৎকারটা ভুলতে পারছি না
এখন:১
দুপুরের চিৎকারটা ভুলতে পারছি না। কিছুতেই না। সারাক্ষণ কানের ভেতরে বেজেই চলেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনিদের মতো অসহায় হয়ে পড়েছি; দিশেহারা লাগছে। অচেনা এক অনুভূতি বাসা বেঁধেছে মাথার মগজে। থরথর করে কাঁপছি। বেঁচে নেই যেন। একে বেঁচে থাকা বলে না। এই মুহূর্তে ফ্রানৎস কাফকাকে মনে পড়ছে। কাফকা বলেছেন, ভয়ংকর এক পৃথিবী। এমন এক দুনিয়া, যেখানে একটা খাঁচা আছে একটা পাখির সন্ধানে।
দুপুর কোন্ খাঁচায় ধরা পড়েছে? গত দুদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছি না। রোকেয়া হলের কেউ তার খবর বলতে পারছে না। প্রাণের মানুষ কোথায় হারালো? কাঁদতে কাঁদতে দুচোখের পাতা হুলফোটা কোলাব্যাঙ হয়ে গেছে। ঘুমাতে পারছি না। খেতে পারছি না। বুকের ভেতরে সারাক্ষণ ধুকপুক ধুকপুক শব্দ! উহঃ অসহ্য যন্ত্রণা! গলার ভেতরটা ঠিক যেন মরুভূমি। মনে হচ্ছে এখুনি গলার চামড়া ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসবে।
পুরো শরীরে অসহ্য ব্যথা। প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন খুলে পড়ে যাবে। হাঁটতে গেলে মনে হচ্ছে, কোমর থেকে সমস্ত অস্থিগুলো ঝনঝন শব্দে খুুলে পড়বে মাটিতে। বসে থাকলে ভোঁ ভোঁ করে মাথা ঘুরছে। চোখ মেলে তাকালে কেবল লাল-নীল জোনাকিরা উড়ে বেড়ায় দৃষ্টির সীমানায়। কিচ্ছু করতে পারছি না। দুচোখে শুধু মিছিল আর মিছিল। আমার মগজের নিউরনগুলো দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর চিৎকার করে ডাকছে-দুপুর। দুপুর। দুপুর।
তখন:১
ঠিক চার বছর আগে রোকেয়া হলের গেটে প্রথম যখন দুপুরকে দেখেছি, তখন তার মাথায় কোনো চুল ছিল না। বেল মাথার এক সুন্দরী, টগবগে উচ্ছ্বাস। দুচোখে কাজল পরা, ঠোঁটে টকটকে লাল রঙের লিপস্টিক দেয়া। অবাক হয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রী এমন বেল মাথায় থাকে! এমন করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে বেড়াতে পারে! অবশ্য বুয়েটিয়ান ছেলেরা পরীক্ষা এলে বেল মাথায় থাকে।
পড়তে পড়তে মাথা গরম হয়ে যায় বলে মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য চুল ফেলে দেয়ার ধুম পড়ে যায়। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো নারী বুয়েটিয়ানকে বেল মাথায় দেখিনি। নারী বুয়েটিয়ানদের মাথা এতো ঠান্ডা থাকে কি করে? কণ্ঠশীলনের ক্লাসে যাওয়ার জন্য দ্রুত বের হই হল থেকে। ফিরে এসে দেখি বেল্লু সুন্দরী আমার রুমের দরজায় হেলান দিয়ে বসে আছে। কানের মধ্যে এয়ারফোন লাগানো। সম্ভবত গান শুনছে চোখ মুদে।
ইয়া লম্বা নাক, ফর্সা গোলগাল মুখের আদল। মনে হচ্ছে, সে এই জগতে নেই। অন্য ভুবনে ডুবে গেছে। তাকে পাগলী পাগলী লাগছে। প্রথম দেখে ক্যান্সারের রোগী মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে জন্ম পাগলী। বিস্ময়ে আমার মুখটা হা হয়ে গেল। সে তুড়ি বাজিয়ে গুনগুন করে ওঠে —-
ঝড় তুমি ওগো আর এসো না
জোনাকি জ্বলুক আজ
ফেলে রেখে সব কাজ
লুকাবো তারি বুকে আজ
থ হয়ে আছি। কি করবো বুঝতে পারছি না। ঠিক সেই সময় গুনগুন থেমে গেল। মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, ওহ সরি। সরি। মৃদু হেসে বললাম, ঠিক আছে। বেল্লু সুন্দরী হাত এগিয়ে দিলো হ্যান্ডশেকের জন্য। শুরু হলো শান্তি স্থাপনের সংকেত। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে হ্যান্ডশেকের শুরু হয়েছিল শান্তি স্থাপনের সংকেত হিসেবে। সে সময় হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বোঝানো হতো, দুজনের কারো হাতে কোনো অস্ত্র নেই। আমাদের হাতেও অস্ত্র নেই, আছে কেবল মায়া। সম্পর্কের মায়া।
সে বলল,আপু আমি দুপুর। এই রুমে সিট পেয়েছি।
তুমি যদি দুপুর হও, তাহলে আমি রাত।
Ñমানে?
মানে কিছু না। আমি আসলে নিশি। তো কোন্
ডিপার্টমেন্টে? কোন্ ইয়ারে?
বাংলা। ১ম বর্ষ
গুড। আমিও বাংলায় তবে ২য় বর্ষে।
পরিচয়ের প্রথমদিন থেকেই দুপুরের সঙ্গে আমার জমে গেল। সে বছর ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার সময় রোড এক্সিডেন্ট করে ট্রমা সেন্টারে ভর্তি থাকলাম তিন মাস। ফলে, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে আর তৃতীয় বর্ষে উঠতে পারলাম না। দুপুর তো মহাখুশি। আমরা একসঙ্গে ক্লাসে যাই, একসঙ্গে টিএসসিতে ফুসকা খাই। একসঙ্গে কণ্ঠশীলনে আবৃত্তি শিখি। বর্ষার নতুন পানির মতো আমাদের বন্ধুত্ব হু হু করে বাড়তে লাগলো। ক্যাম্পাসে সবাই আমাদের নাম একসঙ্গে করে দিলো। ডাকতে লাগলো, মানিকজোড় নিশিদুপুর।
এখন:২
পুরো রাস্তায় রক্তের দাগ। তাজা তাজা রক্তে ভেসে আছে ঢাকা শহর। আহা, আমার ক্যাম্পাস! প্রিয় ঢাবির রাস্তায় এমন রক্তের বন্যা দেখতে হবে, কখনো ভাবিনি। হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এখানে শত শত গরু জবাই করে রক্ত রেখে গেছে। এমন নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচার ছাত্রছাত্রীদের উপরে কেবল অমানুষরাই করতে পারে। আমার ভাইয়ের রক্ত! আমার বোনের রক্ত! আর সইতে পারছি না। চোখের বন্যা কুলুকুলু করে বয়ে চলেছে। চারদিকে কেবল আহাজারি আর আহাজারি! প্রাণের সহপাঠীদের আর্তচিৎকার! উহঃ
রক্তের উপরেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। দাঁড়াতে পারছি না। ঠকঠক করে শরীর কাঁপছে। মাথা নুয়ে রাস্তায় কপাল ঠেকিয়ে বললাম, এই রক্তের দাম কে দেবে? এই রক্তের সঙ্গে সবার রক্ত মিশে আছে। এতো রক্ত কেন ঝরলো? আমরা তো কেবল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন করেছি। ন্যায্য দাবি চেয়ে সবাই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি মাত্র।
মুক্তি যোদ্ধাদের নাতিপুতিদের জন্য কোটা ধরা হয়েছে ৭৫%, আমরা কোটা চাই না। মেধা চাই। এই ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য টেবিল থেকে উঠে রাস্তায় নেমেছি সবাই। তার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হবে কেন? কেন এভাবে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব দিয়ে পাখির মতো গুলি করে মারা হলো??
একি! গলা দিয়ে কথা আসছে না। গো গো শব্দ হচ্ছে। অর্থহীন সেই শব্দ। শিশুদের বেবিলনের মতো অনেকটা। কথা বলতে পারছি না কেন? তবে কি আমি মরে গেছি? আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি না তো? তাই হয় তো কেউ আমার চিৎকার শুনতে পাচ্ছে না।
কতোটা সময় ধরে যে, রাস্তার উপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছি, ঠিক জানি না। হঠাৎ অনুভব করলাম, কেউ একজন আমাকে টেনে তুলতে চাইছে। অনেক কষ্টে মাথা তুলে পেছনে তাকাতেই দেখি, একজন অপরিচিত নারী সাংবাদিক বলছেন, হলের ভেতরে যাও। পুলিশ গুলি ছুড়ছে। যাও তাড়াতাড়ি। ওরা এদিকেই ধেয়ে আসছে।
আমি তো নড়তে পারছি না। শরীরে এক বিন্দু শক্তি নেই। মনে হচ্ছে, পাথর হয়ে গেছি। ওই নারী সাংবাদিক আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন হলের ভেতরে। চোখ তুলে দেখি তার নেমপ্লেটে লেখা-জঊইঅ।
তখন:২
১৯শে জুলাই, ২০২৪। গভীর রাত। রোকেয়া হলের ছাত্রীদের কারো চোখে ঘুম নেই। কি যে ভয়ংকর এক কালোরাত! যেন ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের সেই কুৎসিত রাত। একটু পর পর গুলির শব্দ। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, সব বন্ধ।
হঠাৎ দুপুরের আর্তচিৎকারে ভারি হয় চারপাশ। আমার সখী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে। ‘নিশি বাঁচাও’ বলে ডাকে। আমি আর লুকিয়ে থাকতে পারি না। দৌড়ে যাই। পশুদের বাধা দিতে থাকি। কিন্তু ওরা আমাকে মেরে অজ্ঞান করে দেয়। যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় দেখতে পাই।
এখন:৩
সারাদেশে কারফিউ চলছে। তবু আমি দুপুরের ছবি হাতে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে এসেছি। কেউ কোনো তথ্য দিতে পারছে না। দুপুরের মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বোবা মূর্তি হয়ে। হঠাৎ তিনি আমাকে টানতে শুরু করলেন। কিছু একটা বলছেন কিন্তু আমি তার কথা শুনতে পাচ্ছি না। তিনি ইশারা করে পেছনে তাকাতে বললেন। পেছনে তাকিয়ে দেখি, অমানুষের দল গুলি ছুড়ছে। খালাম্মা আমাকে টেনে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন। তিনি আমাকে তার বাসায় নিয়ে এলেন।
টিভির সংবাদ দেখছি আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। হঠাৎ সাংবাদিক রেবার মৃত্যুর খবর শুনে পাথর হয়ে গেলাম।
আমি তো ঘুমাতে পারছি না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তাও পারছি না, গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। খেতে পারছি না, গলা দিয়ে খাবার নামে না। কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে। হৃদয়ের ভেতরে কেবল যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা। এই রুমে দুপুরের সব জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। এটা দুপুরের রুম। আহা, ভয়ংকর এক পৃথিবী যেন!
আজ আটদিন পরে নেট চালু হয়েছে। সারাদিন দুপুরের বিছানায় শুয়ে আছি। বুকের উপরে ওর একটা ওড়না। ওর গায়ের ঘ্রাণ পাচ্ছি। ওকে মনের ভেতরে লালন করি আর ভালো ফিল করি। মনে মনে বলি, আল্লাহ ওকে ফিরিয়ে দাও।
খালাম্মা মোবাইল হাতে দৌড়ে এলেন। পেয়েছি, নিশি রে আমার মেয়েকে খুুঁজে পেয়েছি। খালাম্মার চোখের জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে। দুফোঁটা আমার গালের উপরে পড়ল। শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম খুশিতে। উনার হাত থেকে মোবাইলটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেই।
ওই তো দুপুর আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে স্লোগান দিচ্ছে। কপালে লাল-সবুজ পতাকা বাঁধা। কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! পতাকাটা ওর কপালে এতো চমৎকার মানিয়েছে! আহা, আমার প্রাণের সখী!
সারা নেট দুনিয়ায় দুপুরের এই ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই ভিডিও দেখছি।