ভাট কবিতার সেকাল একাল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে ভাইরাল শব্দটা এখন সবার মুখে মুখে খৈ এর মতো ফোটে। আজকাল কোনো ব্যতিক্রমী, রোমাঞ্চকর, শোকাবহ, লোমহর্ষক ঘটনা ঘটলেই তা পোস্ট হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মানুষ পেয়ে যায় ঘটনার আদ্যোপান্ত মুহূর্তের মধ্যে। এমনকি ভিডিওতে দেখতে পায় ঘটনার দৃশ্য। শুরু হয়ে যায় লাইক, কমেন্ট, শেয়ার। আজ থেকে ২৫/৩০ বছর আগে ছিল না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এমন সুযোগ। ছিল না ইন্টারনেট। ছিল না এন্ড্রয়েড ফোন।
গ্রামের ৮০% মানুষ রেডিও, টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্রের উপর নির্ভর করত ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা শোনার জন্য। ৩৫/৪০ বছর আগে কয়েক গ্রামে হয়তো একটা টেলিভিশন ছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে হয়তো সংবাদপত্র পৌঁছাতো না। তাই বলে কি চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা ভাইরাল হতো না? অবশ্যই হতো। তবে সেই ভাইরালের মাধ্যম কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়। সেই ভাইরালের মাধ্যম ছিল ভাট কবিতা, হাটুরে কবিতা, শায়ের বা শায়েরি। গ্রামের সাদাসিধে কবিগণ চাঞ্চল্যকর খুন হত্যা, ডাকাতি, ফাঁসি, প্রেম, পরিণয় অথবা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস কিংবা যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ নিয়ে সাধারণ ভাষায়, অন্ত্যমিলে, পয়ার,
ত্রিপদী, ধুয়োর ছন্দে এসব ভাট কবিতা লিখতেন। যা সবার মুখে মুখে প্রচারিত হতো। অর্থাৎ ভাইরাল হয়ে যেত।
গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত কবিগণ ভাট কবিতা লিখলেও তাঁরা কিন্তু ছন্দ মেনে সব কবিতা লিখতেন। প্রথমে ওস্তাদের কাছ থেকে পয়ার, ত্রিপদী ও ধুয়োর ছন্দ শিখে তারপর ভাট কবিতা লিখতেন। ভাট কবিতার সঙ্গে পালাগান ও পুঁথির অনেক মিল আছে। তবে পালাগান ও পুঁথির তুলনায় ভাট কবিতার কলেবর অনেক ছোট। সাধারণত ১৬ থেকে ২৪ পৃষ্ঠার মধ্যে ভাটকবিতা লেখা হয়। যেখানে পালাগান ও পুঁথি একশ পৃষ্ঠারও বেশি হতে পারে।
এই ১৬ থেকে ২৪ পৃষ্ঠার ভেতরে কবিগণ বর্ণনা করতেন চাঞ্চল্যকর ঘটনাটিকে পাঠকের হৃদয়গ্রাহী করে। সেলাইবিহীন কাগজে ছাপানো ১৬ থেকে ২৪ পৃষ্ঠার কথাগুলো পাঠক হৃদয়ের সঙ্গে সেলাই করে দিতেন ভাট কবিতার কবিগণ। ২০০ বছরের আগের ঘটনাও পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে আছে ভাট কবিতার আঠার সুবাদে। ভাট কবিতাগুলো হাটে-বাজারে, বাসে, লঞ্চে ও ট্রেনে বিক্রি হতো। বিক্রেতারা কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ থেকে পাঠ করে পাঠক হৃদয়ে তৃষিত চাতককে আকৃষ্ট করে ভাট কবিতা বিক্রি করতেন।
কোনো কোনো বিক্রেতা পুরো কবিতা পাঠ করতেন, সঙ্গে সঙ্গে বিক্রিও করতেন। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে কবিতা রেখে, হাতে দুচার খানা রাখতেন এবং বিক্রি করতেন। আবার হাট-বাজারে চট বিছিয়ে তার উপর বিভিন্ন ভাট কবিতার পসরা সাজিয়েও অনেকে বিক্রি করতেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এক টাকা, দুই টাকা, চার টাকায় একখানা ভাট কবিতা কেনা যেতো। এর আগে এক পয়সা, দুই পয়সা, চার আনা, আট আনায় এসব কবিতা বিক্রি হতো।
গ্রামের মানুষ চিত্তবিনোদনের জন্য রাতে রাস্তার পাশে সবুজ ঘাসের গালিচার উপর বসে অথবা উঠোনে মাদুর পেতে ভাট কবিতার আসর বসাতেন। এছাড়া গরু বা মহিষের গাড়োয়ান, মাঠের কৃষক, কাঠুরিয়া, তালগাছের গাছি ভাট কবিতা পাঠ করে যেমন নিজেদের ক্লান্তি দূর করতেন পথিক কিংবা পরিবারের সদস্যদের রিক্ত চিত্ত সিক্ত করে ক্ষুধার্ত মনের খোরাক যোগাতেন। পঞ্চাশের মন্বন্তর, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও রচিত হয়েছে ভাট কবিতা।
বঙ্গবন্ধুর বিজয়গাথা, জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যার কাহিনী উঠে এসেছে ভাট কবিতার মাধ্যমে। মোটকথা এমন কোনো চাঞ্চল্যকর অথবা রোমাঞ্চকর কিংবা ভয়ঙ্কর ঘটনা নাই যা বাদ পড়েছে ভাট কবিতার কবিদের লিখনী থেকে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাড়া জাগানো ঘটনা যা রেডিও, টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো না। তা প্রচারিত হতো ভাট কবিতার মাধ্যমে। কবে থেকে ভাট কবিতা লেখা শুরু হয়েছে তার সঠিক দিন তারিখ জানা না গেলেও মধ্যযুগ থেকে ছাপানো ভাট কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়।
মুদ্রিত ভাট কবিতার প্রভূত প্রচার প্রসার ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। ১৮৭৬ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের উপর ভিত্তি করে কোরবান উল্লাহর ‘খ- প্রলয়’ সহ বেশি ভাট কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। অনেক ভাট কবিতার ভণিতা থেকে ঘটনা ও রচনার সাল তারিখ জানা যায়। যেমন ‘গরিবের ছেলে শাহজাহান ‘ভাট কবিতার শুরু হয়েছে সাল দিয়ে। তা হলো- ১৩৬৫ সালে/এই ঘটনা বরিশালে/ঘটেছিল পাতারহাট থানায়।/সেই দেশে এক বৃদ্ধ ছিল গরিব ছিল অতিশয়।/ও বৃদ্ধ কামলা খেটে খায়।/সেই ঘরেতে একটি ছেলে/দিয়েছিল দয়ময় নামটি তাহার শাহজাহান। —————————-। ভাট কবিতার নামের মধ্যে ইঙ্গিত থাকত মূল কাহিনীর। যেমন- মামলার সাক্ষী ময়নাপাখি, ইকবালের ফাঁসি, গরিবের ছেলে শাহজাহান, গাছবাড়িয়ার ঘূর্ণিঝড়। আবার নামগুলো ছিল হৃদয়গ্রাহী কিংবা রোমাঞ্চকর। যেমনÑ শিউলি বাদলের প্রেমের খেলা, বউ বদলের কবিতা, শাশুড়ির প্রেমে জামাই খুন, ইত্যাদি। তবে নি¤œমানের কাগজে ছাপা হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ভাট কবিতা সংরক্ষণ করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে ওঠে। তাই অনেক পুরনো ভাট কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
আগের দিনে বিয়েবাড়িতে মাইক বাজানো হতো এবং রাতের বেলা মাইকে ভাট কবিতা পাঠ করা হতো। ভাট কবিতা যেহেতু সহজ সরল ভাষায় লেখা তাই শোকাবহ কবিতা শুনে মানুষ কেঁদে ফেলতো।আবার রোমান্টিক কবিতা শুনে হয়ে পড়তো আবেগপ্রবণ পেতো মহাসমুদ্র সমান আনন্দ। আমাদের পরিবারের সঙ্গে ভাট কবিতার অনেক স্মৃতি আছে। আমার ছোট নানা অর্থাৎ আমার মা’র ছোট চাচা নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার বাঁকা গ্রামের মরহুম আব্দুল আলীম মোল্লাহ এর প্রায় শতাধিক ভাট কবিতা ও ধুয়োগান মুখস্থ ছিল।
মধ্য বয়সেই তিনি চোখের দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তা না হলে হয়তো আরও কবিতা, ধুয়ো, জারি মুখস্থ করে রাখতেন। যাহোক গ্রামের কোনো বিয়ে বাড়িতে মাইক আসলে রাতের একটা নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ থাকতো আব্দুল আলীম মোল্লাহ এর জন্য। হৃদয়গ্রাহী সব ভাট কবিতা মুখস্থ পাঠ করে যেতেন অন্ধ আব্দুল আলীম মোল্লাহ আর তা শুনতেন কয়েক গ্রামের মানুষ।
২৫/৩০ বছর আগেও এসব কবিতার লেখক,পাঠক ও শ্রোতা ছিল। যশোরের সালেহা হত্যা, ঢাকার রিমা হত্যার করুণ কাহিনী নিয়েও প্রকাশিত হয়েছিল ভাট কবিতা বা শায়ের। সর্বশেষ আব্দুল করিম খানও সোলাইমান খোয়াজপুরী নামের দুজনেই দাপটের সঙ্গে ভাট কবিতা লিখতেন। সোলাইমান খোয়াজপুরী এখন মাদারীপুরে খোয়াজপুরে নিজ বাড়িতে থাকেন। লেখালেখি তেমন করেন না। আব্দুল করিম খানের সম্পর্কে কোন তথ্য আমি সংগ্রহ করতে পারি নাই। তবে তাঁর কোনো নতুন লেখা এখন বাজারে দেখা যায় না। প্রযুক্তির প্রভাবে মানুষ এখন ঝুঁকে পড়েছে ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমের উপর।
কষ্ট করে কেউ ছাপানো অক্ষর পড়তে চায় না। যে হারে শিক্ষিতদের সংখ্যা বাড়ছে সেই হারে কিন্তু মুদ্রিত লেখার পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে না। যার দুষ্ট প্রভাব পড়েছে ভাট কবিতার উপরও। এখন চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনে লাইভ দেখানো হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখতে পারে সত্য তবে সাহিত্য রসটা আর পায় না।
পুঁথি এবং পালাগানের পরে ভাট কবিতা ছিল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে সাহিত্যের প্রিয় মাধ্যম। গ্রাম গাঁয়ের সহজ সরল মানুষ সাহিত্য রসের মাধ্যমে গ্রহণ করত ভাট কবিতার রোমাঞ্চকর কিংবা লোমহর্ষক ঘটনার নির্যাস। ভাট কবিতাকে হাটুরে কবিতা বলা হলেও এর লেখকগণ ছন্দের ব্যাপারে ছিলেন যথেষ্ট সতর্ক। কবিগণ ছন্দ না শিখে কেউ ভাট কবিতা লিখতেন না। এজন্য ওস্তাদের ডেরায় পড়ে থাকতে হতো শিষ্যদের।
তাইতো পয়ার, ত্রিপদী ও ধুয়োর ছন্দে লেখা কবিতার মধ্যে থাকত বিভিন্ন উপমা যা শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত পাঠকের হৃদয়ে সেলাই হয়ে গেঁথে থাকত নকশীকাঁথা হয়ে। এখনও ঘটছে অনেক রোমাঞ্চকর কিংবা শোকাবহ ঘটনা যা ভাইরাল হচ্ছে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মানুষ জানতে পারছে ঘটনাটি সত্য কিন্তু পাচ্ছে না কোনো সাহিত্য রস। বাংলা সাহিত্যের এই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমটি অর্থাৎ ভাট কবিতা এখন বিলুপ্তির পথে এ কথা বললে ভুল হবে না তবে সবাই যদি একটু সচেতন হই। ভাট কবিতার লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা করি তাহলে হয়তো স্বল্প খরচে প্রকাশিত ১৬ অথবা ২৪ পৃষ্ঠার এই সাহিত্য মাখা মধু দীর্ঘদিন ধরে আমরা পান করতে পারব।