.
ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ একটি অদ্ভুত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে সামুদ্রিক নাবিকের বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও প্রত্যয়দীপ্ত সুরের মাধ্যমে সিন্দবাদ মাঝি সামুদ্রের নতুন জীবনের ডাক দিয়েছে। কাব্যে নজরুলের জাগরণে উদীপ্ত জনতাকে স্বপ্ন, কর্মসাধনা ও আদর্শের পথে দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পাওয়া যায়। বাংলা ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক উপাদানগুলো এখানে অতীতের ঘটনাবলী ও স্মৃতির সঙ্গে সমন্বয়ে বর্তমানের ভাবনায় উদ্ভাসিত।
প্রায় দুই শত বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রাককালে চল্লিশের দশকে নবজাগ্রত বাঙালি মুসলমানের জীবনে যে নতুন স্বপ্ন, আশা, আকাক্সক্ষা, প্রত্যয় ও চ্যালেঞ্জ এসে পড়ে তারই বর্তমান ও ঐতিহ্যিক উপাদানে উজ্জ্বল ও উদ্দীপ্ত কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’।
এই কাব্যগ্রন্থে একদিকে ঐতিহ্য-প্রীতি ও ইসলামী জীবনাদর্শে আস্থা; অন্যদিকে সমকালীন জীবন-সমস্যা সমাধানের পথরেখা অঙ্কন করা হয়েছে। অন্যদিকে আদর্শিক, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির রূপরেখা অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামের পর বাংলা কাব্যে ইসলামী ধারার নতুনতর, স্বতন্ত্রতর দিগন্ত উন্মোচন সম্ভব এমনটি চিন্তা যখন অনেকেই করেননি তখনই ফররুখ আহমেদের আবির্ভাব। নজরুল-যুগের পর ফররুখ-যুগ যেকোনো বিচারে ছিল বাংলা সাহিত্য-ইতিহাসে অনন্য। ফররুখ আহমদ একটি যুগের স্রষ্টা। কাব্যক্ষেত্রে তিনি এমন সব নতুন আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন যা আগে অনেকেই কল্পনা করেননি।
ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’র বিভিন্ন কবিতায় মুসলিম জাগরণ, বিজয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতীক দুঃসাহসিক নাবিক। সিন্দাবাদের বিভিন্ন সফর অভিযানের আলেখ্য চিত্র রূপময় ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ কাব্যের ‘সিন্দাবাদ’ ‘বা’র দরিয়ায়’ ‘দরিয়ার শেষ রাত্রি’, ‘শাহরিয়ার ‘আকাশ নাবিক’ ‘বন্দরে সন্ধ্যা’, ‘ডাহুক’, ‘এই রাত্রি’, ‘পাঞ্জেরী’, ‘স্বর্ণমঙ্গল’ ‘লাশ’, ‘তুফান’, ‘হে নিশান বাহী’, ‘নিশান’, ‘আউলাদ’ ও ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রভৃতি কবিতায় মুসলিম ঐতিহ্যকে লালন করা হয়েছে। ‘সাত সাগরের মাঝি’তে যেমন আছে স্বপ্ন, সৌন্দর্যবোধ ও উজ্জীবনের প্রেরণা, তেমনি আছে আত্মধিক্কার এবং নির্যাতিত ও দুঃখ পীড়িত ক্ষুধাতুর মানুষের চিত্র।
কবি ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়েই মূলত তিনি নবজাগরণের কবি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। এই গ্রন্থের নাম কবিতা ‘সাত সাগরের মাঝি’তে জাতিকে নবজাগরনের পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন :
‘হে মাঝি! তবুও থেমো না দেখে এ মৃত্যুর ইঙ্গিত,
তবুও জাহাজ ভাসাতে হবে এ শতাব্দী মরা গাঙে।
এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবুও দেখা যায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজ- তোরণ,
এ গ্রন্থের ‘আউলাদ’ ‘লাশ’ ইত্যাদি কবিতায় মানবতার বিপর্যয়ের জন্য হাহাকার ও ব্যথাতুর মানুষের জন্য বেদনা প্রকাশ পেয়েছে। বলিষ্ঠ ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে মানবতাবিরোধী শোষক ও সভ্যতার প্রতি অভিশাপ। ইসলামের মানবতাবাদী আদর্শের প্রত্যয়ী কবি মানুষের মুক্তির প্রত্যাশায় ইঙ্গিত করেছেন, ‘হেরার রাজ-তোরণে’র দিকে ‘সাত সাগরের মাঝি’কে আহ্বান জানিয়েছেন। সেই রশ্মি ধরে সফরের পর সফরে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এই কাব্য গ্রন্থে সব আশা-আকাক্সক্ষা স্বপ্ন এবং উজ্জীবনের প্রেরণাই ভাষারূপ পেয়েছে রূপ ও সৌন্দর্যের পথ ধরে। ফররুখ আহমদের এ সব কবিতায় সেই রূপ ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন কবির গভীর এবং আন্তরিক অনুভূতি সংস্কৃতানুগ শব্দের পাশাপাশি আরবী-ফরসী শব্দের শিল্পসম্মত অনুপম ব্যবহার এবং উপমা উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প সৃষ্টির সৃজনী কৌশল।
স্মরণ করা যেতে পারে ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতার অসাধারণ সূচনা পঙ্ক্তি :
কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হ’ল জানি না তা’।
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের ফেনা।
তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?
তবে কবির বোধোদয় হয়েছে, কেননা ‘এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,/তবু দেখা যায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজতোরণ’, বাধাবিপত্তি এড়িয়ে সে পথেই তাকে এগোতে হবে কবি নজরুল এসেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতা, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময়। ফররুখ এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা, পাকিস্তান আন্দোলন ও দুর্ভিক্ষের করুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে।
আল্লামা ইকবালের ভাবশিষ্য নিজ জাতির সমস্যাকে চোখে আঙুল দিয়ে ফররুখ আমাদের দেখিয়ে তার লেখনির মাধ্যমে বলেছিলেন,
‘হে মাঝি এবার তুমিও পেয়ো না ভয়
তুমিও কুড়াও হেরার পথিক তারকার বিস্ময়
ঝরুক এ ঝড়ে নারঙ্গী পাতা তবু পাতা অগণন
ভিড় করে সেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজতোরণ।’
ফররুখ আহমদ ছিলেন মানব দরদী কবি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিলো সকল মানুষই সমান। তিনি নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের দুঃখ সমব্যথী এবং গভীর মমতায় অনুভব করতেন। তাঁর এই জীবনাদর্শের প্র্রকাশের ভঙ্গিও ছিলো ভিন্নতর। তিনি নির্যাতিত মানুষের দুঃখ বেদনায় মুসলিম ঐতিহ্যকে স্মরণ করেছেন এবং সেই আদর্শকে বুকে বাধার পরামর্শ দিয়েছেন:
‘নিশান আমার কি স্বপন তুমি দেখছো আজ।
নিশান আমার শীর্ণ মুঠিতে পেতে চাও তুমি মহা নিখিল?
ক্ষুধিত মাটিতে সে নয় তাজমহল মানুষের মাঠে বিরাণ মাটিতে এবার ফলবে তাজা ফসল।’ (নিশান)
তাঁর কাব্যে ঐতিহ্য ও আদর্শের পারস্পর্য কি তা সহজেই বোধগম্য এবং কোন প্রেক্ষিতে এই সমন্বিত উদ্বোধন তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তাতে ঐতিহ্যের স্বপ্ন লাবণ্যে উদ্ভাসিত। জীবনধারণের সঙ্গে আদর্শের যোগ স্থাপিত করা হয়েছে প্রতীক ও রূপক দ্যোতনার মাধ্যমে। তাই ফররুখ আহমদের প্রতীক ব্যবহার জীবন রসে নয় প্রতীকী রসে সিঞ্চিত। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিলে কথাটি পরিষ্কার হবে :
‘নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দাবাদ’
‘পাকে পাকে ঘুরে-তীর বেগে ছুটে আবর্তে দিশেহারা,
ক্ষুধার ধমকে ঘাস ছিঁড়ে খেয়ে আকাশ জাগায়ে সাড়া,
জালিমের চোখ আগুনে পোড়ায়ে গুড়ায়ে পাপের মাথা,
দেখেছি সবুজ দরিয়া জাজিমে স্বপ্ন রয়েছে পাতা।’ (সিন্দাবাদ)
জীবনের কান্না-গ্লানি যাত্রাপথের ভয়ংকর ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ আপদকে তুচ্ছ করে সুনির্দিষ্ট মঞ্জিলে পৌঁছাতে কবি বদ্ধ পরিকর। চরম দুর্যোগের দিনেও সাহসে বুক বেধে জীবনের সার্বিক লক্ষ্যে পৌঁছানো রূপকের মোড়কে মোড়কে তিনি মূলত মুসলিম জাগরণের গান গেয়েছেন। মুসলিম পূর্ণজাগরণের কবি দ্বিধাহীন বিশ্বাস ও আশা পোষণ করতেন। (এরপর ১৩ পৃষ্ঠায়)
‘মোরা মুসলিম দরিয়ার মাঝি, মওতের নাহি ভয়’
এ কথার মত এ পর্যায়ের কবিতায় আস্থার কথা আশার বাণী অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও জোড়ালো:
‘পাল তুলে দাও ঝান্ডা উড়াও; সিন্দাবাদ, এল দুস্তর তরঙ্গ বাধা তিমিরময়ী।
দ্বিধা সংশয় কত জমা হয় কে মানে আজ?
কে ছোটে হারানো গীতিকার পিছে মিথ্যাময়ী?
এ ঝড় তুফানে জাগো দুর্বার দুঃসাহসী নতুন সফরে হবে এ কিশতী দিগি¦জয়ী।’ (নতুন সফল)
ফররুখ আহমদ নিজের সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে পুঁজিপতিদের শাসন-শোষণে বিপক্ষে কথা বলেছেন। তিনি নিজের অনুভবের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছেন জড় সভ্যতার ভ-ামি। এবং মানবিক ও বিশ্বশান্তি জন্য শোষকশ্রেণির প্রতি তীব্র ঘৃণা, ধিক্কার জানিয়েছেন। কবি চেয়েছেন শাসন-শোষণের নিষ্ঠুর সভ্যতাকে ধ্বংস করে মানবিক সমাজ গড়তে। তাই তো তিনি ‘লাশ’ কবিতায় আবারও বলেছেন-
‘তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিন্ডে পদাঘাত হানি
নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বারপ্রান্তে টানি
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও
ধ্বংস হও, তুমি ধ্বংস হও।’
[লাশ/ সাত সাগরের মাঝি]
অন্যদিকে তিনি জানতে চেয়েছেন ‘পাঞ্জেরি’ কবিতার মাধ্যমে পুঁজিপতিদের শাসন-শোষণের হাত থেকে শান্তিপূর্ণ মানব সমাজ কবে পাবে মুক্তি’
‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?
বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,
বুঝি মৌসুমি হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
বুঝি কুয়াশায়, জোছনা-মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।’
‘পাঞ্জেরী’ কবিতায় তিনি আবারও আরবী ও ফারসি ভাষায় সুন্দর ছন্দে গভীরভাবে কথাটি তুলে ধরেছেন -
‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘ?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।...
২৩ জুন ১৭৫৭ সালের পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ঘষেটি বেগম ও মীর জাফরদের ষড়যন্ত্রের ফলে অস্তমিত হওয়ার ফলে বিপ্লবী কবি ফররুখ দেখেছেন ইংরেজ বেনিয়াদের শাসন ও শোষণের অবস্থা। এ দেশবাসীর জন্য স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই। আরও উপলব্ধি করেছেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য সুযোগ্য নেতা প্রয়োজন। যে নেতা কোটি কোটি মজলুম মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবেন তিনিই হলেন কবির কল্পনায় সৃষ্ট আদর্শ মহানায়ক পাঞ্জেরী। এক রূপক কবিতার মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করলেন :
‘জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি
জাগো অগনন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি।’
অথবা:
কবির মনে প্রশ্ন :
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?...
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাজার, ওকি
রোনাজারি ক্ষুধিতের!
ওকি দরিয়ার গর্জন, ওকি বেদনা মজলুমের!
ওকি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী!
পাঞ্জেরী!
পাঞ্জেরী : সাত সাগরের মাঝি
যদিও তিনি কবি তবে সত্যেন্দ্র নাথ রায়ের মতো তার কাব্যে ছান্দসিক ব্যঞ্জনা না থাকলেও তার কাব্যের পরতে পরতে বৈপ্লবিক আহ্বান লক্ষিত। তাই তো ছন্দে তিনি জাদুকর ছিলেন না, ছিলেন বিপ্লবী।
‘ভেঙে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ, দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ,
ছিঁড়ে ফেলো আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দবাদ’।
[সিন্দবাদ]
১৩৫০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছিল ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠীর চাপানো একটি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। এ নিয়ে অনেক কবি কবিতা লিখেছেন। বিপ্লবী কবি ফররুখ আহমদের লেখা ‘লাশ’ এ ফুটে উঠেছে তার বাস্তব অবস্থা। কবি লিখেছেন :
‘মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর
সাক্ষী তার পড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরনীর পর।’
[লাশ: সাত সাগরের মাঝি]
অধ্যাপক ড: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান লিখেছেন : ‘লাশ’ তেরশ পঞ্চাশের মতন্তরের পটভূমিতে লেখা একটি অসাধারণ কবিতা।
‘নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দাবাদ’।
‘নোনা দরিয়ার ডাক’ শুনে নতুন সফরে মাঝি সিন্দাবাদকে নিয়ে ‘জিন্দেগী আর মওতের মাঝখানে’ অগ্রসরমান কবি। কিন্তু ‘মাটির মমতা’ বোঝে মাঝির দল, ‘বার দরিয়ায় জীবনের তাজা ঘ্রাণ’-এর প্রয়াসী কবি ও তাঁর সতীর্থরা। নতুন জীবন ডাকছে, ‘জড়তার রাত শেষ হয়ে এলো আজ’। তাই কবি বলেন,
রাত জেগে শুনি খোদার আলমে বিচিত্র কলরোল,
তারা ছিটে পড়ে মধ্য সাগরে জাহাজে জাগায় দোল,
আমরা নাবিক জংগী জোয়ান ইশারা পেয়েছি কত
মওতের মুখে তাই ভেসে যাই টুকরা খড়ের মত’।
ফররুখের এই পথচলা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা অন্য কবিদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতির। কখনো বা খুবই প্রত্যক্ষভাবে আহ্বান :
‘কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ ব’য়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ!
‘সিন্দবাদ’: সাত সাগরের মাঝি; ফররুখ আহমদ রচনাবলী, প্রথম খন্ড, ১৯৯৫
প্রয়োজনে কবি গর্জে ওঠেন ‘স্ফীতদের বর্বর সভ্যতার’ বিরুদ্ধে :
পৈশাচিক লোভ
করিছে বিলোপ
শাশ্বত মানব-সত্তা, মানুষের প্রাপ্য অধিকার,
ধিত মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় রুধিয়া দুয়ার,
মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর;
সাক্ষ্য তার পড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরণীর পর।
লাশ (তেরশো পঞ্চাশ)
এ কাব্যের ‘ডাহুক’ কাবিতায় অনুপম প্রাকৃতিক ও রোমান্টিকতার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্ত সত্তার প্রতীক ডাহুক-এর অশান্ত ডাকের আলেখ্য।
‘রাত্রিভ’র ডাহুকের ডাক...
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক,
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।...
আবার কাব্যের ‘ঝরোকা’য়’ কবিতায় অভূতপূর্ব রোমান্টিক কল্পনা কবিকে উদ্বুদ্ধ করে তুলল জাতির নবজাগরণের যাত্রাপথে।
হে প্রিয়া শাহেরজাদী। তুমি আজ কী অজ্ঞাত প্রেমে
জেগে ওঠো শঙ্কায়, লজ্জায়?
তোমার সকল প্রেম আবার লুকাতে চায়
নেকাব-প্রচ্ছায়?...
হে ছলনাময়ী! অন্ধ পুরুষের, পৌরুষের কেড়ে নাও শ্রান্ত ঘুমঘোর,
ছড়াও পরাগ রক্তধারা
জাফরানের মধু-গন্ধ ভরা।
(ঝরোকা’য়)
ইসলামী মানবতাবাদী আদর্শের কবি মানুষের মুক্তির জন্য ইঙ্গিত করেছেন হেরার রাজতোরণ এর দিকে সাত সাগরের মাঝি কে আহ্বান জানিয়েছেন সেই রশ্মি ধরে সফরের পর সফরে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতার ভেতর দিয়ে জাতির আশা ও কামনা সেদিন তাদের যে সুরের রূপ পেয়েছিল এবং যে প্রাণচাঞ্চল্য সঞ্চার হয়ে উঠেছিল ‘সাত সাগরের মাঝি’ তে সে ছবিই বিবৃত হয়েছে। তাই ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থ এক কথায় আমাদের জাতীয় রেনেসাঁর সার্থক রূপকার। তিনি ঐতিহ্যের পাটাতনে আদর্শের পাল উড়িয়ে সিন্দবাদ নাবিক সেজেছেন।
ফজিলা ফয়েজ
তারাগঞ্জ, রংপুর