
(পর্ব-৬)
(পূর্ব প্রকাশের পর)
‘আমার দিকে লক্ষ্য রাখবে। জানালা দিয়ে আমাকে দেখতে পাবে তুমি।’
‘ও. কে।’
‘একটা জিনিস দিচ্ছি তোমাকে। একসময় আমি এভাবে হাত তুলবো- হাত তোলা মাত্রই জিনিসটা তুমি ছুঁড়ে মারবে ভেতরে। তারপর আগুন আগুন বলে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি জুড়ে দেবে। ঠিক ঠিক বোঝাতে পেরেছি?’
‘একশ’ পার্সেন্ট।’
‘জিনিসটা ভয়ানক কিছু নয়।’ হোমস আমাকে আশ্বস্ত করলো। সিগারের মতো দেখতে লম্বা একটা জিনিস সে বের করলো পকেট থেকে। ‘এটা একটা সাধারণ স্মোক-বোম, দুই মাথায় দুটো ক্যাপ আছে- ছুঁড়ে দিলে তাতে আগুন ধরে যাবে। এটুকুই তোমার কাজ। তুমি আগুন আগুন চিৎকার দেওয়া মাত্র আরও কয়েকজন লোক তোমার সঙ্গে যোগ দেবে। এরপর তুমি রাস্তার মাথায় গিয়ে অপেক্ষা করবে। একটু পরেই আমি চলে আসবো তোমার কাছে। সব ঠিক ঠিক বুঝেছো?’
‘আমি ইন্টারফেয়ার করবো না কোনো কিছুতে। জানালার কাছে পজিশন নেবো। ইশারা পাওয়া মাত্র স্মোকবোম জানালা দিয়ে ছুঁড়ে আগুন আগুন চিৎকার দিতে থাকবো, তারপর রাস্তার মাথায় গিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।’
‘একদম ঠিক।’
‘নিশ্চিন্ত থাকো- যা বলেছো, তাই করবো অক্ষরে অক্ষরে।’
‘চমৎকার। এবার তাহলে আমি আমার নতুন ভূমিকার জন্য প্রস্তুত হই।’
ঘরের ভেতরে চলে গেল হোমস। একটু পরে বেরিয়ে এলো পাদ্রির ছদ্মবেশে। কে বলবে পাদ্রির কালো পোশাক পরা, চওড়া হ্যাট মাথায় এই লোকটা আমার বন্ধু হোমস। পাদ্রিদের মতোই তার হাবভাব, মুখের হাসি, সরল চাহনি। অভিনয় করলে ভালো অভিনেতা হতে পারতো হোমস।
সোয়া ছয়টার সময় আমরা বেকার স্ট্রিট থেকে রওনা দিলাম। ব্রায়োনি লজে যখন পৌঁছালাম সাতটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, রাস্তার বাতিগুলো কেবলি জ্বলে উঠেছে। আমরা অপেক্ষা করছি বাড়ির বাসিন্দার ফিরে আসার। হোমসের বর্ণনা শুনে বাড়িটা যেমন কল্পনা করেছিলাম ঠিক তেমনই দেখতে পেলাম।
তবে আশপাশের পরিবেশ যতটা নিরিবিলি ভেবেছিলাম, ততটা নিরিবিলি নয়। রাস্তায় বেশ মানুষের ভিড়। একটু দূরে পুরনো ময়লা পোশাক পরা একদল লোক সিগারেট খাচ্ছে, হাসাহাসি করছে- ছুরি-কাঁচি ধার দেওয়ার লোকটা বসে আছে একপাশে, দুজন গার্ড মশকরা করছে এক নার্সের সঙ্গে, আর কয়েকজন সুবেশধারী যুবক সিগার মুখে ইতস্তত পায়চরি করছে রাস্তায়।
‘বুঝলে তো,’ হোমস বললো, ‘ওদের বিয়েটা অনেক কিছু সহজ করে দিয়েছে।’ এদিক-ওদিক হাঁটছি আমরা দুজন। হাঁটতে হাঁটতে হোমস বললো, ‘এখন ইরিনও চাইবে না ছবিটা গডফ্রের চোখে পড়ুক, যেমন আমাদের ক্লায়েন্ট চাচ্ছে না তার বাগদত্তার হাতে পড়ুক এই ছবি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ছবিটা কোথায়?’
‘সেটাই প্রশ্ন।’ আমি সায় দিলাম।
‘ছবিটা কেবিনেট সাইজের। পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে রাখার উপায় নাই। তাছাড়া ইরিন জানে বোহেমিয়ার রাজা তক্কে তক্কে আছে, দুবার চেষ্টা করা হয়েছে ছবিটা ছিনিয়ে নেওয়ার। কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি ছবিটা নিজের সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি করবে না ইরিন।’
‘তাহলে কোথায় থাকতে পারে সেই যক্ষের ধন?’
‘তার আইনজীবী কিংবা ব্যাঙ্কারের কাছে রাখতে পারে। কিন্তু কী জানো, মেয়েদের মন বড় বিচিত্র- তারা গোপন বিষয় সহজে কাউকে জানাতে চায় না। আমার মনে হয় ছবিটা এই বাড়িতেই আছে। ভেবে দেখো, দু’একদিনের মধ্যেই ছবিটাকে কাজে লাগাবে ইরিন- সেক্ষেত্রে ছবিটা সে হাতের কাছে রাখবে এটাই যুক্তিসঙ্গত। হ্যাঁ ছবিটা এখানেই কোথাও আছে, এই বাড়িতে।’
‘কিন্তু এই বাড়িতেও দুবার সার্চ করেছে রাজার লোকেরা।’
‘ঠিকমতো খুঁজতে জানে না ওরা।’
‘তুমি জানো?’
‘আমিও জানি না।’
‘তবে?’
‘ইরিন আমাকে জানাবে।’
‘জানাবে না।’
‘জানাতে বাধ্য হবে। ঐ যে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। রেডি হও। যা যা বলেছি একদম অক্ষরে অক্ষরে করা চাই কিন্তু।’
হোমসের কথা শেষ হতে না হতেই পথের মোড়ে হেডলাইটের আলো দেখা গেল। ছিমছাম চেহারার ল্যান্ডাউটা এসে দাঁড়ালো ব্রায়োনি লজের সামনে। গাড়িটা কাছে আসতেই রাস্তার ভবঘুরেদের মধ্যে থেকে একজন দৌড়ে এলো গেট খুলে দেওয়ার জন্য, দুটো পয়সা বখশিস পাওয়ার আশায়। তার আগেই আরেকজন এসে কনুইয়ের ধাক্কায় প্রথমজনকে হঠিয়ে দিল। দুজনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। দূরের গার্ড দুজনও এসে যোগ দিল- তারা একজনের পক্ষে, ওদিকে ছুরি-কাঁচিওয়ালাও যোগ দিল আরেকজনের পক্ষে। বেধে গেল তুমুল ঝগড়াঝাটি। একজন আরেকজনকে ঘুসি বাগিয়ে আক্রমণ করছে।
গাড়ি থেকে নেমে এসবের ঠিক মাঝখানে পড়ে গেলেন যাত্রী ভদ্রমহিলা। হোমস তাকে উদ্ধার করার জন্য ছুটে গেল। কিন্তু কাছাকাছি পোঁছেই সে একটা চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল মাটিতে- মারমুখো একজনের ঘুসি লেগেছে তার মুখে। হোমসের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। এই দৃশ্য দেখে গার্ড দুজন পালালো একদিকে, বাকিরা আরেক দিকে।
সুবেশধারী যুবকেরা এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছিল। তারা এবার এগিয়ে এলো ভদ্রমহিলাকে আর আহত হোমসকে সাহায্য করার জন্য। ইরিন এডলার সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে যাচ্ছিলো- দৃশ্যটা আমার স্পষ্ট মনে আছে আজও- সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে সে ফিরে তাকালো, পেছনে সিঁড়িঘরের আলো- তার অপরূপ ফিগার স্পষ্ট ফুটে আছে সেই আলোতে।
‘ভদ্রলোক কী খুব বেশি আহত হয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করলো ইরিন।
‘মরেই তো গেছে।’ এক সঙ্গে কয়েকজন বলে উঠলো। (চলবে...)
প্যানেল/মো.