ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

যে জীবন কার্তিকের, যে জীবন অঘ্রানের

ইভান অনিরুদ্ধ

প্রকাশিত: ২১:০৯, ৯ মে ২০২৪

যে জীবন কার্তিকের, যে জীবন অঘ্রানের

.

চোখে ঠিমমতো দেখে না, কানেও কম শোনে। খুপরি ঘরের সামনে এক চিলতে উঠোনে অগ্রহায়ণ মাসের সকালের রোদ এই বুড়োর দিকে তাকিয়ে হাসছে। আট বছরের নাতিটা গামলায় গরম ভাত আর ভাতের একপাশে শিমের ছালুন রেখে গেছে বুড়োর সামনে। রোদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে পরম মমতায় সকালের খাবার খাচ্ছে বুড়ো। মাছের ছালুনের ঘ্রাণে বুড়োর ভাঙ্গা চৌকিতে শুয়ে থাকা বেড়ালটাও এই খাওয়ায় শামিল হয়। বুড়ো ভাতের একটা বড় নলা মাখিয়ে বেড়ালের সামনে দেয়- কা, বেশায়া কা। আর এইবায় নয়া জামাইয়ের লাহান ভাত-ছালুন খাইয়া বিছানাত হুইত্তা-বইয়া থাহিস। উঁন্দুর সামনে দিয়া গেলেও তুই কিনু কইছ না। উঁন্দুর আমি ধইরা তোরে দিয়ামনে! আমার নয়া ক্যাঁতাডা, গিলাপটা কাইট্যা কুডি কুডি কইরালছে হুংগার দলে। এইবায় যদি অত্যাচার সইয্য করণ লাগে, তে তুই আমার সঙ্গে আছস ক্যারে? আমারে ছাইড়া দুরাবায় যা গা। তোরে পালনের তো দরহার নাই। বুড়োর এই বক্রোক্তি বেড়াল বুঝলো কি না কে জানে! সে ভাতের নলা সাবাড় করে একদৌড়ে চৌকির উপর গিয়ে ছেঁড়া কাঁথার দলায় মুখ গুঁজে বসে থাকে। ভাবখানা এমন যে- জাগতিক কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে সে! বুড়োর কথা শোনার সময় তার নাই! প্যাঁচাল করতাছে, করুক! বেড়ালকে ভাতের নলা দেওয়া দেখে ছেলের বউ খ্যাঁক করে উঠে- নিজে খাওনের মুরাদ নাই। কুত্তা-বিলাইরে ক্যারে অত তালাবি দেওন লাগে আফনের? কুত্তা-বিলায়ের লাইগ্যা অত হোয়াইগ্যাম ক্যারে? এক-সইন্ধ্যা কামাই-রুজি নাই। ওয়াক্তে-ওয়াক্তে তিনবেলা খাওন তো ঠিহি জুগানি লাগে আমার! আমার এই জাইত্যা নমুনা মজা লাগে না!

সব কথা বুড়োর কানে যায়। সে এসব কথা কানে ধরে না রেখে অপর কান দিয়ে বের করে দেয়। কানের ভেতর জমিয়ে রাখলে কান তব্দা হয়ে থাকে। মাথা ভন ভন করে। আর কী এমন দায় পড়েছে যে, এই পোলার বউয়ের কথা জীবনের শেষবেলায় এসে কানে তুলতে হবে! এই সংসার, এই বাড়ি, এই ঘর- কার? হারামজাদি যে অত সাওগারি করে এই সংসারে, এই তালুকদারি কি তার বাপের বাড়িত থাইক্যা আনছে? এই সবই তো তার। আর তাকেই কি না উঠতে-বসতে পোলার বউয়ের মুখ ঝামটা খেতে হয়! এমনিতেই তো সে কানে কম শোনে! চোখে কম দেখে, শরীরের রথ পড়ে গেছে। এখন সে এই সংসারে হুরাবডি, আবর্জনা!

গামলায় ভাত রয়ে গেছে কিন্তু ছালুন শেষ হয়ে গেছে। বুড়ো নাতিকে ডাকে- ভাইয়ু, তোর মারে আরটু ছালুন আনতো। হুকনা ভাত গলা দিয়া নামে না। ছেলের বউ রাগে এক চামুচ ছালুন গামলার কোনায় ঢেলে দিয়ে যায়। বুড়ো এক টুকরা শিম মুখে দিয়ে বলে- আর কয়ডা দিন, আর তুমরারে ত্যাক্ত করতাম না। আমার সময় ফুরাইয়া আইছে। ছেলের বউ মুখ ঝামটা দিয়ে সামনে থেকে সরে আসে- এই কথা তো গত আড়াই বচ্ছর ধইরাই কইতাছুইন। কুনু গতি তো অয় না আফনের। বুড়ো ভাত মাখাতে মাখাতে মুচকি হাসে। পোলার বউকে বলে- উশ্যির ছালুনডা বিরাট মজা অইছে। আরেকদিন বেশায়া উশ্যি গাছতে তুইল্যা হুরি দিয়া রাইন্দো। গাছটারে বালামিতে যত্ন কইরো। এই অগ্রাণ মাসো উশ্যির ছালুনই মজা লাগে আমার। তুমার হাতের ছালুন রান্দাডা অক্কোরে তুমার হওরির রান্দার মতন! আহা, আমারে একলা এই নিদানে থুইয়া গেছে গা! যাউক, আমবো আইতাছিগামলার ভাত তরকারি সবটাই শেষ। বুড়োর ইচ্ছে হচ্ছিল ছেলের বউটাকে জিজ্ঞেস করে- গুড় বা কলা আছে কি না ঘরে। মাঝে মাঝে গুড়-কলা দিয়ে গরম ভাত এক সঙ্গে মাখা মাখা করে খেতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু আর সাহসে কুলোয় না কথাটা বলার। মনে মনে বলে- থাউক, আগামী কাইল শনিবার। লালচান্দের হাট। সেখানে নিজে গিয়া একপোয়া খেজুর গুড় কিইন্যা আনবাম। কিন্তু বললেই কি হয়? তার হাঁটাচলার শক্তি প্রায় পুরোটাই লোপ হয়েছে। এতটা পথ হেঁটে তারপক্ষে হাটে যাওয়া অসম্ভব। শীতে এই নড়বড়ে শরীর আর অচল হয়ে যায়। ছেলের বউকে শুনিয়ে বুড়ো বলে- আহা, কী লান্যত্তিয়া জীবন আমার! কিবায় ঘর-বৈডুহী অইয়া গেলাম। কুনদিন যে আজরাইল আইবো! আইলে বাঁইচ্যা গেলামোয়। লাঠিতে ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে যাওয়া শরীরটা টেনে বাড়ির বাইরাগে গিয়ে রোদে দাঁড়ায়। কোমরের ডানপাশে লুঙ্গির ভাঁজ থেকে ম্যাচ আর বিড়ি বের করে। তিনবারের চেষ্টায় আধাভাংগা বিড়িটাতে আগুন ধরিয়ে লম্বা একটা টান দেয়। উদাস চোখে তাকায় তার স্ত্রীর কবরের দিকে। সুখটান দিয়ে বিড়িটা ফেলে কবরটার দিকে ধীর পায়ে হেঁটে যায়। হাতের লাঠিটা একপাশে রেখে দুইহাতে কবরের উপর হাত বুলিয়ে দেয় বুড়ো। পাশেই তো তার ছেলেটার কবর। দুই বছর আগে চলে গেল পাঁচ দিনের জ্বর আর কাশিতে ভুগে! আহা, বিধির কী বিধান!

আমাকে দেখে আরশাদ চাচার আর কোনো দিশা থাকে না। কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেই আমাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। তার ছেলেবাবুল আমার সমবয়সী ছিল। আমার ছোটবেলার খেলার সাথী। বাড়ি এলে আমার সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত এই পুরোটা সময় তার সঙ্গেই কাটাতাম। আজ বাবুল নেই! আমার চোখ তারকবরের দিকে চেয়ে ঝাপসা হয়ে আসে!

দুই

আম্মা বেশ আক্ষেপ করে, সঙ্গে আব্বাও।

এই সময়টায়, হেমরে এই সময়টায় আম্মা শহরের বাড়ি থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কয়েকটা দিন থাকার জন্য খুব বেহানা হয়ে উঠে। আম্মা আক্ষেপ করে এই ভেবে যে, তার পাঁচ বোন আর একমাত্র ভাই- সবাই যদি বাড়িতে এসে কয়েকটা দিনের জন্য একত্রিত হতো! সবাই যদি একত্রিত হয়ে তাদের আব্বা আর আম্মার কবরের পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকতো গোল হয়ে! সবাই যদি সারাটা রাত ঘরের উষারায় বসে জীবনের শেষবেলায় এসে এই-সেই গল্প, সুখ-দুঃখের গল্প, তাদের ছেলেমেয়েদের গল্প, তাদের নাতি-নাতনিদের গল্প করে পার করে দিত! সবাই যদি বড় একটা ডেগে লাল বিরই চালের ভাত রান্না করে, ভর্তা আর কড়া ঝালের মাছের ছালুন দিয়ে ইচ্ছেমতো খেতো! যে জীবন ফেলে গেছে এই বাড়িতে, সেই জীবন যদি আম্মা আবার ফিরে পেতো! পাই পাই করে ফিরে পেত যদি ফেলে আসা সব স্মৃতির ওয়ারিশ! ফিরে পেতো যদি ছিঁড়ে যাওয়া স্মৃতির তসবিহ দানা!

আমার আনুবুজিও এমন আক্ষেপ করতো আমার সামনে। তার চন্দ্রপুরের বোনের সঙ্গে, গাবরাগাতির বোনের সঙ্গে বছরের পর বছর দেখা না হওয়ার হাহাকারের কথা বলতো। আনুবুজি বলতো- গাঙে গাঙে দেহা অয় কিন্তু বইনে বইনে দেহা অয় না রে! আহা, বুক বিদীর্ণ হয়ে যায় এই কথায়। আম্মারও কি তাই ঘটে? ঘটে, আমি জানি ঘটে! আমি অনুভব করি- ঘটে, তুমুল বর্ষণের মতো আম্মার ভেতরে হাহাকার ঘটে, ভাঙনে আসে! প্রতিবার আম্মার মুখে শুনি তার সব বোনেরা আসবে। নেত্রকোনা থেকে আম্মাকে নিয়ে তারা গ্রামের বাড়ি যাবে। কয়েকদিন থাকবে। সারাবাড়ি একরোজ কামলা নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে, কবর দুটোর উপর যে জঙ্গল হয়েছে তা কেটে সাফ করবে, আম গাছের ডালগুলো ছেটে দেবে। এই ডালের জন্য রোদ আসে না বাড়ির উঠানে। সবাই মিলে হেমন্তের সকালে রোদ পোহাবে উঠানে বসে, সব বোনেরা মিলে পাড়াবেড়ানিত যাবে এই বাড়ি, সেই বাড়ি। আহা, জীবন! যাপিত জীবনের ক্যানভাসে কত রঙিন জলছাপ!

আমার সামনে সেই মহিলার মুখ ভাসে আর কথাগুলো এখনো কানে লাগে। বছর তিনেক আগে নভেম্বর মাসে, আম্মাকে মুমূর্ষু অবস্থায় নিয়ে একুশ দিন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছিলাম। মেডিসিন ওয়ার্ডে এক ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলা এসেছে। বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলায়। তার লাস্ট স্টেইজ কিন্তু ডাক্তার তাকে এখনো কিছু বলেনি। হয়তো আর মাসখানেক থাকবে তার এই জীবনে আয়ু। সেই মহিলা বিকেলে মোবাইলে বাড়িতে তার মেয়েটির সঙ্গে জোরে জোরে কথা বলতো। সাংসারিক কথাবার্তা।

-আবু, ধান কাডা লাগছে? কামলা আইছে না?

-কুনদিন আইবো?

-আঁস মুরুগডি দেইখ্যা রাহিছ।

-তোর বাফেরে কইছ দুই মণ ধান আল্লোয়া রাহে যে। বেকটি উনা দেয় না যে।

-আমি আর দুই তিন থাকবাম। ডাক্তোরে রিলিজ দিয়ালবো।

-বাড়িঘরডা হুইরা রাহিছ হত্যিদিন। সহালে উইঠ্যা কেঁথা-বালিশটি রইদো দিস। তোর বাফের গিলাপটা আর তবনডা বালামিতে সাবান দিয়া দইয়া দিস।

অথচ এই মহিলা চলে যাবে হেমন্তের বা শীতের কোনো এক চান্নি-পসর রাইতে! আহা, জীবন! কী মায়াময় জীবন, সংসার জীবন, জীবন সংসার!

তিন

আর কদিন পরেই বাড়িতে ধান কাটা হবে। ছোটভাইকে বলে এসেছি ক্ষেত কাটার দুই-তিন দিন আগে আম্মাকে বা আমাকে যেন জানায়। সম্ভব হলে আমিও চলে আসবো আম্মাসহ বাড়িতে। জানি, আম্মার অসুস্থ-রুগ্ন দেহ নিয়ে কিছুই করার সামর্থ্য নেই। তবু আম্মা বাড়িতে কয়েকটা দিন থাকুক আব্বা সহ। আম্মার সামনে অগ্রাইন্যা দাওয়া ধান তাফালে সেদ্ধ হতে থাকুক। আর আম্মা তা দেখুক পরম তৃপ্তি নিয়ে। আম্মা চুলার আগুনে সিদ্ধ হতে থাকা কয়েকটা ধান কামড় দিয়ে দেখুক- বালামিতে সিদ্ধ হলো কি না। আব্বা চলে যাক সকাল থেকে নতুন বাজারে চায়ের স্টলে। সারাটা দিন আব্বা বাতুরবানের লাহান ঘুরে সকালের ভাত দুপুরে এসে খাক। এসব স্বর্গীয় আর মায়াময় ছবি দেখতে দেখতে আমি হয়তো চলে যাবো আমার সব দুঃখ ভুলে থাকার সেই আপনজন জীবনানন্দের কাছে-

আমি তার উপেক্ষার ভাষা

আমি তার ঘৃণার আক্রোশ

অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র- নক্ষত্রের দোষ

আমার প্রেমের পথে বারবার দিয়ে গেছে বাধা

আমি তা ভুলিয়া গেছি;

তবু এই ভালোবাসা- ধুলো আর কাদা!

আমার অশান্তমন কার্তিকের নীল কুয়াশা ভেদ করে, হেমন্তের স্মৃতির ভেলায় চড়ে চলে যায় আনুবুজির কাছে!

ঘরের ভেতর কি চৌকি, তোষক নেই? আছে। তারপরও শীতকালে এসবের উপর শুইলে আনুবুজির ঘুম হয়না। হেমন্ত কিংবা পৌষের মাসের জারে তার শরীর ডাইয়া হয়ে যায় কয়েক স্তর করে কাঁথা গায়ে দেওয়ার পরেও। বাড়ির চারপাশে, সড়কে, বিছরায় হেমন্তকালের নতুন ধানের খড় ছড়িয়ে আছে। আমরা নেত্রকোণার মানুষজন এটাকে বলি- বন। শীতের মিষ্টি রোদে সেই বন সারাদিন গরম হয়ে থাকে। সন্ধ্যায় আনুবুজি আমাকে ফরমাইশ দেয়- আইজ ব্যাটেরা ডাইয়া। বাইরাগের বিছরাতো এক-আঞ্জা বন লইয়া আয়। রাইতের বিছনা করন লাগবো যুইত মতো।

আমি বাইরাগ থেকে গরম বন এনে ঘরের ভেতর রাখি। রাতের খাওয়ালা সন্ধ্যায় শেষ হলে আনুবুজি মাটিতে বন বিছিয়ে বিছানা তৈরি করে। বনের তোষকের উপর একটা মোটা কাঁথা বিছিয়ে দেওয়া হয়। গায়ের উপর থাকে দুই-তিন পরতের কাঁথা। আমি আনুবুজির সঙ্গে সেই বিছানায় শুয়ে থাকি। গল্প করি, আনুবুজির চিবিয়ে দেয়া মুখের পান-সুপারি খাই। তারপর একসময় আনুবুজির পেট জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। খড়ের বিছানায় শুয়ে কী যে আরাম লাগে! তুলতুলে নরম, রোদমাখা গরম বিছানা। পরদিন সকালে উঠে সেই খড় আবার রোদে নিয়ে মেলে দিই।

মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় ঢাকায় যদি এক আঞ্জা বন দিয়ে ঘরে বিছানা করতে পারতাম! ইচ্ছে হয় মেয়েকে ফরমাইশ দিই- আম্মাজি, এক-আঞ্জা বন লইয়া আও। রাতে বিছানা করবো। সে হয়তো এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যে, আমি হয়তো ক্ন্দুার পাগল হয়ে গেছি। আমাকে শিকল দিয়ে বাড়ির উঠানের আম গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হবে। হা,হা,হা। জানি উত্তরার সুরম্য, সুসজ্জিত বাসগৃহে থেকে আমার মেয়ে এক-আঞ্জা বন কোথাও পাবেনা। জানি, সে হয়তো সারাজীবন চন্দন-পালঙ্কে শুয়ে দিন কাটাবে কিন্তু আমার ফেলে আসা শৈশবের খড়ের বিছানার স্বাদ কোনদিনই পাবে না।

চার

দুদিন হলো গ্রামের বাড়িতে এসেছি। টিনের চালে সারারাত বৃষ্টির মতো উশপড়েছে। শিশিরকে গ্রামের লোকজন বলে উশ। মনে হবে বুদ্ধদেব বসুররাত রে বৃষ্টিনয়, রাত ভরে টপটপ শীতের হিম ঝরছে চালের উপর। জানি, গ্রাম এখন গ্রাম নেই। তবু আমাদের গ্রাম যেন গ্রামই রয়ে গেছে। হুটহাট একদিন-দুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি আসি বলেই কি গ্রামের দৃশ্য, বাড়ির পরিবেশ, গাছগাছালি ইত্যাদি দেখে আপ্লুতহই? শহরে স্থায়ী আবাস বলেই কি গ্রামের বাড়ির জন্য পেটপুড়ে? জানি না। হয়তো তাই, হয়তো তাই না। শহরে থাকা সব মানুষেরই কি নিজের শেকড় বা গ্রামের বাড়ির জন্য পেটপুড়ে? মনে হয় না। এই পেটপোড়া খুব খারাপ রোগ! কোনোকিছুর জন্য কিংবা কারো জন্য যদি পেটপুড়ে, তাহলে না দেখা পর্যন্ত আত্মাডা শদ্দ হয় না! যাকে দেখতে বা যার সঙ্গে দেখা করার জন্য মন ফিরাগ হয়, তাকে দেখতে না পারার সান্ত¦না তো দুনিয়ার অন্যকিছু দিয়ে পাওয়া যায় না।

যে কারো মৃত্যুর ঘটনা দারুণ শোকের। গ্রামের বিশিষ্টজন, নানাভাবে গ্রামের মানুষজনের কাছে সারাজীবন আলোচিত-সমালোচিত প্রায় শতবর্ষী একজনের মৃত্যুর সংবাদ সকাল থেকে মাইকিং করা জানানো হচ্ছে। আমি উনাকে নানা ডাকতাম। সড়কে দাঁড়িয়ে সেই শোক সংবাদ শুনে মন ভার হয়ে গেল। আমাদের পাড়া-গাঁয়ে এমন বয়স্ক কি আরও কেউ আছে? নাই মনে হয়। উনি নেত্রকোনা শহরে থাকতেন। উনার ছেলেকে মামা ডাকি, খুব ঘনিষ্ঠতা আছে। ফোন করে সমবেদনা জানালাম। বাদ আসর, নেত্রকোনা শহরের বাসা থেকে মরদেহ গ্রামের ভিটায় নিয়ে আসবে। মাগরিবের পর দাফন হবে। আল্লাহ উনার সমস্ত ভুল ক্ষমা করে চিরশান্তিতে রাখুন। আহা, শহর আর গ্রামে উনার কত প্রপার্টি! সারাজীবন নানাভাবে শহর আর গ্রামে সম্পদ করেছেন। সরকারি চাকরি করেছেন। জীবনের অভিজ্ঞতার ভান্ডার বিশাল। তিন বছর আগে আমরা তার কাছ থেকেএকটা জমি কিনেছিলাম। সেই সুবাদে উনাকে খুব কাছ থেকে জানার সুযোগ হলো। যদিও সেই অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। ভাবতাম, একটা মানুষ এমন কেন হয়! তবু এখন মন থেকে বলি- আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খুব তরস্ত ছিলাম। ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে থেকেই অর্ধেক দিন গেছে। মেশিনে ধানকাটা হচ্ছে- তা দেখেছি, ধান বস্তায় ভরে ব্যাপারি মাপজোক করছে তা দেখেছি। ছোটভাই বেশ বড় সিলভার কার্প, রুই মাছ মেরেছে খন্তা থেকে তা দেখেছি। তারপর সেই মাছ কড়া ঝাল আর লেবুপাতা দিয়ে যখন ভুনা করে আম্মা সামনে দিল তখন সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই উধাও।

আম্মা রয়ে গেছে গ্রামের বাড়ি। হয়তো আরও দুইদিন থাকবে। বাড়িতে বড়চাচার সঙ্গে হলো। সড়কে রোদে বসেছিলেন। শরীর অনেকদিন ধরেই বেশ নাজুক। কথা হলো কিছু তবে কন্ঠ বেশ দুর্বল। ছোটচাচার সঙ্গেও দেখা করলাম। সঙ্গে ঢাকা থেকে যাওয়া এক কাছের বন্ধুছিলো। এই প্রথম সে আমাদের গ্রা্মরে বাড়িতে এলো। ছোটচাচার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম তাকে। সন্ধ্যায় নেত্রকোনা বাসায় ফিরে এলাম। চলে আসার সময় আবার সড়কে ফের দুই চাচা আর অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা অটোরিকশায় উঠে পড়লাম। পুরোপুরি সন্ধ্যা নেমেছে। সাঁই সাঁই চলছে অটোরিকশা। বেশ শীত লাগছিলো। শীত আরও পড়ুক। এই মাসের ভেতর আবার আসতে হবে- পাশে বসা বন্ধু বললো। আমিও খুশি হলাম তার  প্রথম দেখাতেই গ্রামের বাড়ির প্রতি আগ্রহ দেখে। ভালো লাগলো। পথের দুইধারে ঝাপসা কুয়াশা। মনে হলো-

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায়

চিলের ডানা থামে।

সোনালি সোনালি চিল -

শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে

কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!

×