ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলা কবিতায় রোমান্স

মোস্তাফিজুল হক

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলা কবিতায় রোমান্স

ফরাসি ভাষার ‘রোমাঞ্জ (Romaû)’ শব্দ থেকে ‘রোমান্টিক’ শব্দের উৎপত্তি

ফরাসি ভাষার ‘রোমাঞ্জ (Romaû)’ শব্দ থেকে ‘রোমান্টিক’ শব্দের উৎপত্তি। অতীতকালে সংকলিত ‘রোমান (roman)’ শব্দটি লাতিনের নানান মাতৃভাষায় চলমান ছিল। ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসে Old Lingua Romana-এর উপস্থিতি ছিল। ‘রোমানা’ বা ‘রোমানিকা’র ক্রিয়াবিশেষণ ‘জড়সধহরপব’ এবং এর বিশেষ্য পদ ‘রোমান্স’। এ ভাষায় ‘প্রভসাল’ ও স্প্যানিশে যে সাহিত্য লেখা হতো, তার মূল ভাববস্তু ছিল অবাস্তব ও অলীক ভাবনা। শব্দের উৎস আলোচনায় রোমান্টিসিজম ‘ক্লাসিক বিরোধী ধারা’ এবং ‘অবাস্তব ও অলীক বা অভিযানমূলক’ কোনো তাৎপর্য বহন করত। ‘রোমান’ বলতে লাতিনের ক্লাসিকাল ভাষার বদলে যা লেখ্যভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

এ ভাষা ছিল প্রাকৃত ভাষা (ঠঁষমধৎ ঃড়হমঁব), যা দিয়ে মধ্যযুগের ফরাসি গাথাকাব্য বা কাহিনিকাব্য লেখা হতো। ‘রোমান’কে আজও ফরাসিরা বলে ভষবং ষরহমঁবং ৎড়সধহবং’ বা ‘রোমান্স ভাষা’। রোমান ভাষায় লিখিত সাহিত্যসম্ভারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ফরাসি ভাষায় সামরিক ক্রিয়াকলাপের ওপর রচিত কবিতার বইয়ের কিছু রোমান্টিক পাঠ, যার অধিকাংশই কাল্পনিক।’ (জড়ঁংংবধঁ ধহফ জড়সধহঃরপরংস, চধমব: ১৮) 
মধ্যযুগের রোমান্স উদ্দীপনার শিহরণ ও অতিশয় কল্পনাপ্রবণতা মধ্যযুগোত্তর রোমান্টিক কবিদের কাব্যেও প্রভাব বিস্তার করেছে। মধ্যযুগের রোমান্স কবিতায় ছিল কল্পনার অফুরন্ত অবকাশ, স্বপ্নের অশেষ আয়োজন, বীরত্ব ও অভিযানের দুর্বার প্রকাশ। এসব ভাবসূত্র রোমান্টিসিজমের মৌলিক বিন্দুকে স্পর্শ করে বিস্ময়কর অনুভূতি বা কল্পনার নতুন স্বরগ্রাম সৃষ্টি করেছে। স্কট বা ওয়ার্টন, কোলরিজ বা কীটস রোমান্টিক আন্দোলনকে গ্রহণ করে এক নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছিলেন। মধ্যযুগের রোমান্সের বিষয়বস্তু এবং কাহিনি ছিল কল্পনাময় এক অভিযান।

এ প্রসঙ্গে মারিও প্রাজের উক্তি হলো :‘ঙহব সঁংঃ ধপপবঢ়ঃ রঃ ধং ঃযব ফবভরহরঃরড়হ ড়ভ ধ ঢ়বপঁষরধৎ শরহফ ড়ভ ংবহংরনরষরঃু’ অর্থাৎ, একে এক বৈচিত্র্যময় সংবেদনশীলতার সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। মারিও প্রাজের উক্তি যে যথার্থ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। জার্মান প-িত জাঁ পল রোমান্স সম্পর্কে বলেছেন, ‘ডরংঃভঁষ’ অর্থাৎ ‘বিলোল’ বা ‘সতৃষ্ণ’। এছাড়াও রোমান্টিক সংবেদনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জাঁ পল একটি মন্ত্রসিদ্ধ উক্তি করেছেন, ‘গধমরপ ড়ভ ঃযব ওসধমরহধঃরড়হ’ অর্থাৎ ‘কল্পনার জাদু’। অজানা, অপরিচিত, অনন্য, সুদূরের অণ্বেষন সম্পর্কিত ভাবনাগুলো কল্পলোকে দোলা দেয় ও বিস্ময় উদ্রেক করে বলেই তা রোমান্টিক। অজানার বিস্ময় এখানে শৈল্পিক ফলশ্রুতি। সুতরাং ফলশ্রুতির বিচারে রোমান্স শাখাকে রোমান্টিক বলা চলে।
রোমান্স ও রোমান্টিসিজম সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন : অধ্যাপক হারফোর্ড বলেছেন, রোমান্টিসিজম হলো ‘অহ বীঃৎধ ড়ৎফরহধৎু ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ রসধমরহধঃরাব ংবহংরনরষরঃু.’ অর্থাৎ, ‘রোমন্টিসিজম হলো কল্পনাপ্রবণতার অসাধারণ বিকাশ।’ ওয়ালটার পিটার বলেছেন, ‘ঞযব ধফফরঃরড়হ ড়ভ ংঃৎধহমবহবংং ঃড় নবধঁঃু.’ অর্থাৎ, ‘রোমন্টিসিজম হলো সৌন্দর্যানুভূতির সঙ্গে তীব্র কৌতূহলবোধের সংযোগ।’ ওয়াটস ডালটন পিটার বলেছেন, ‘জড়সধহঃরপরংস রং ঃযব ৎবহধংপবহপব ড়ভ ড়িহফবৎ.’ অর্থাৎ, ‘রোমান্টিসিজম হলো বিষয়রসের পুনর্জীবন।’ সংক্ষিপ্তাকারে বলতে গিয়ে এডওয়ার্ড আলবার্ট রোমান্টিসিজমকে ‘প্রকৃতির অভিমুখে প্রত্যাবর্তন’ বলে অভিহিত করেছেন। ভিক্টর হুগোর মতে সাহিত্যে রোমান্টিসিজম হলো ‘উদারপন্থা’ এবং ব্রুনেটিয়ারের মতে ‘আত্মমুক্তি’।
রোমান্টিসিজমের কবিদের নির্মাণ কলার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো : ০১. ব্যক্তিনিষ্ঠতা, ০২. স্বেচ্ছাচারিতা, ০৩. গতিশীলতা, ০৪. আবেগপ্রবণতা, ০৫. সৌন্দর্যপ্রিয়তা, ০৬. অভিনব প্রকৃতিপ্রেম, ০৭. আধ্যাত্মিক নিঃসঙ্গতা, ০৮. সর্বসাধারণের প্রতি বিস্ময়বিমুগ্ধ শ্রদ্ধা, ০৯. অপ্রচলিত কাব্যাদর্শ এবং ১০. বিস্ময় ও রহস্য সৃষ্টি।
০১. ব্যক্তিনিষ্ঠতা : রোমান্টিসিজমের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিনিষ্ঠতা। ব্যক্তিনিষ্ঠতা হলো কোনো বহিস্থ ঘটনা, পরিস্থিতি বা বস্তু সম্পর্কে কোনো ব্যক্তির নিজস্ব সচেতন উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা, প্রত্যাশা, সাংস্কৃতিক অনুধাবন, বিশ্বাস, পূর্বসংস্কার, পক্ষপাত, ইত্যাদির সমষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গি। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো-র মতে পরম সত্য, আপেক্ষিক সত্য, এরকম কিছু নেই।

ব্যক্তিনিষ্ঠতা বাস্তবতা বা সত্য থেকে আলাদা কোনো বস্তু বা সত্তা নয়, বরং বাস্তবতা বা সত্যকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির একটি ব্যক্তিনির্ভর রূপ। এখানে কবি ও লেখকের একান্ত ভালোলাগা বা মন্দলাগার বহির্প্রকাশ ঘটে এবং সাহিত্যে আত্মভাবই প্রধান হয়ে ওঠে। এ ধরনের রচনা মূলত মন্ময় বা বিষয়ভিত্তিক হয়। ফলে কবি বা লেখক যখন সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তখন তাঁর একান্ত ভালোলাগা বা মন্দলাগা ছাড়া অন্য কারোর প্রসঙ্গ বা সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে না। এখানে সাহিত্যিকের সুতীব্র অনুভূতি স্বতোজাতরূপে প্রকাশিত হয় এবং কোনো কৃত্রিমতার ভাব থাকে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমি’ কবিতাটি এর যথার্থ দৃষ্টান্ত :

‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’,
সুন্দর হলো সে।

তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,
এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব, এ সত্য,
তাই এ কাব্য।
এ আমার অহংকার,
অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।’
[‘শ্যামলী’: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

০২. স্বেচ্ছাচারিতা: রোমান্টিসিজমের ধারায় স্বেচ্ছাচারিতা হলো প্রচলিত রীতিনীতিকে অস্বীকার করা। এ ধারার কবিদের মন অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাঁদের এসব স্বেচ্ছাচারিতার বৈশিষ্ট্য দুইভাবে প্রকাশ পায়। যেমন: ক) বিষয়বস্তু নির্বাচনে স্বেচ্ছাচারিতা এবং খ) রীতিনীতি ও প্রকাশভঙ্গির স্বেচ্ছাচারিতা। ফলে তাঁরা নিজের খেয়ালখুশি অনুযায়ী কবিতার কাঠামো ও বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন এবং সাহিত্যের পূর্বাপর নিয়মনীতি তথা ছন্দ ও অলংকারের বন্ধনকে মানেন না। বিশিষ্ট ছন্দবোদ্ধা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘হ্যালো দমদম’ কবিতাটি স্বেচ্ছাচারিতার এক দুরন্ত উদাহরণ:

‘আমার হাতের মধ্যে টেলিফোন;
আমার পায়ের কাছে খেলা করছে
সূর্যমণি মাছেরা।
পিচ-বাঁধানো সড়কের উপর দিয়ে
নৌকো চালিয়ে আমি
পৃথিবীর তিন-ভাগ জল থেকে এক-ভাগ ডাঙায় যাব।’
[‘উলঙ্গ রাজা’: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী]
০৩. গতিশীলতা : সমকালীন যুগ ও জীবন, সামাজিক অনুশাসন এবং রাজনৈতিকভাবে অনুগত থাকতে চান না এ ধারার কবিগণ। বাস্তব জগতের রূপ ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন ও প্রমত্ত-প্রচ- এবং স্বেচ্ছাচারী কল্পনার পাখা মেলে দিয়ে উধাও হতে চাওয়াই গতিশীলতা। এ ধরনের কবিরা অতীতাচারী হন। তাঁদের মন স্বপ্নালোকে অলৌকিক রাজ্যে পৌঁছে যায়। যেমন:

‘মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্নগুলো আসলে নৌকো
এই দুঃখ দরিদ্র দীঘিতে অন্যপারে
শৈশবের বাড়িতে ফিরে যাবার যান; আর কিছু নয়।’
[বিরতিহীন উৎসব: সৈয়দ শামসুল হক]

০৪. আবেগপ্রবণতা: রোমান্টিসিজমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য আবেগপ্রবণতা। এ ধারার কবিগণ ভীষণ স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল। সামান্য আঘাতেই ভেঙে পড়েন, আবার কিছু আনন্দেই উচ্ছ্বসিত হন। ফলে অপূর্ণতা, হতাশা, নৈরাশ্য, বিষাদ-যন্ত্রণা মানসিক প্রশান্তি কেড়ে নেয়। জাগতিক ক্ষয়ক্ষতিতে আশাহত হয়ে কেঁদে ওঠেন। কাজী নজরুল ইসলামের নিচের কবিতাংশ এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ:

‘ভুল করে আসিয়াছি
অপরাধ যেয়ো ভুলে।
দেবতা চাহে কি ফুল মরে যবে পদমূলে॥’
[গীতিগ্রন্থ : গীতি-শতদল]
০৫. সৌন্দর্যপ্রিয়তা : রোমান্টিসিজমের পঞ্চমধারা সৌন্দর্যপ্রিয়তা। রোমান্টিক কবিমাত্রই শাশ্বত সুন্দরের উপাসক। যা কিছু সর্বসাধারণের চোখে সুন্দর, এই ধারার কবি সেসবের পুজারি নন। তিনি বাস্তব জগতের ঊর্ধ্বে এক শাশ্বত সুন্দরের রাজ্য খুঁজে পান। আর সে রাজ্যের খোঁজ পেলেই তার মন মুক্ত বিহঙ্গের মতো গেয়ে ওঠে। যেমন :

‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।

ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
 দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।’
[কৃষ্ণকলি, ক্ষণিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

 অথবা,
‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।’
[বিদ্যাপতি: চ-িদাস]
০৬. অভিনব প্রকৃতিপ্রীতি: রোমান্টিক কবি প্রকৃতির মধ্যে এক সজীব ও চৈতন্যময় সত্তার অস্তিত্ব অনুভব করেন। প্রকৃতিকে ঘিরে তাঁর মনে অনন্ত বিস্ময় ও অপার রহস্যবোধ জেগে ওঠে। তিনি প্রকৃতির রূপ-রস, বর্ণ-গন্ধ ও সজীবতায় এক অন্তহীন ও অন্তর্লীন আনন্দ খুঁজে পান। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, জন কিটস, শেলি, রবার্ট ফ্রস্ট, বাংলার জীবনানন্দ দাশ এই ধারার কবি। যেমন:
‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে- সবচেয়ে সুন্দর করুণ :
সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;’
[এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে: জীবনানন্দ দাশ]

০৭. আধ্যাত্মিক নিঃসঙ্গতা : ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ছেড়ে দিয়ে কবির মন যখন অলৌকিক জগতে ঘুরে বেড়ায়, তখন তাঁর মনে আধ্যাত্মিক নিঃসঙ্গতা ধরা দেয়। বাউল কবি লালন শাহ, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম তা অনুভব করেছেন।

‘আজব আয়না মহল মণি গভীরে। 
সেথা সতত বিরাজে সাঁই মেরে ॥
পূর্বদিকে রতœবেদি
তার উপরে খেলছে জ্যোতি।
যে দেখেছে ভাগ্যগতি
সচেতন সে সব খবরে ॥’
[লালন ফকির: কবি ও কাব্য, পৃ. ২১০]
০৯. সর্বসাধারণের প্রতি বিস্ময়বিমুগ্ধ শ্রদ্ধা: রোমান্টিক কবি ও লেখকের মনে সহজ-সরল জীবনের প্রতি অসাধারণ মমতা প্রকাশ পায়। গদ্যসাহিত্যে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’ লেখকের মমত্ববোধ রোমান্টিক মানসের গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করেছে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘লুসি’ কবিতার তুলনায় বাংলার পল্লী­কবি খ্যাত জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এর বৈশ্বিক পরিচিতি কোনোভাবেই কম নয়।

‘কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে
মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নক্সী কাঁথাটি ধরে
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজায় করুণ সুরে
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।’
[নক্সী কাঁথার মাঠ : জসীমউদ্দীন]
০৯. অপ্রচলিত কাব্যাদর্শ : রোমান্টিক কবিগণ প্রচলিত প্রকাশভঙ্গির প্রচ- বিরোধী। ভাষা, ছন্দ, অলংকার নির্মাণে তাঁরা প্রথাসিদ্ধ পথে চলতে নারাজ। যা কিছু পুরনো, যা কিছু প্রথাসর্বস্ব সেসব বিষয়ে রোমান্টিক কবিদের বিদ্রোহ। এ কারণেই জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর মতো কবিগণ বাণী ও শৈলির কৃত্রিমতা পরিহারে মনোযোগী হয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘বনলতা সেন’ এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ :

‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের’ পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’
১০. বিস্ময় ও রহস্য সৃষ্টি : বিস্ময় রসের উদ্বোধনেই রোমান্টিকতার সূত্রপাত ঘটে। বিস্ময়ের সীমাহীন আলোছায়ায় পাঠকের চক্ষু বিস্ফারিত হবে। ফলে পাঠকের কাছে পর হবে আপন, দূর হবে নিকট, অপরিচিত বস্তু হবে পরিচিত বস্তুর মায়াম-িত। অতিতুচ্ছ ও অবহেলিত বস্তুর মধ্যে ফুটে উঠবে অসাধারণ মহিমা- যেন শুষ্ক মরুর বুকে প্রাণ ফিরে আসবে। তখন কবি যা লিখবেন, তা-ই সত্য বলে মনে হবে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন:

‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, কবি তব মনোভূমে
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’

গ্রন্থপঞ্জি (সাহিত্যসূত্র) :
বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিসিজম : অধ্যাপক গৌর মোহন মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্য বিচার : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, অধ্যাপক বিমল কুমার মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ : অধ্যাপক কুন্তল 
চট্টোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ

×