ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ফিলিস্তিনী ডায়াস্পোরা সাহিত্য

ওয়াসাম আল-আসাদি, অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

ফিলিস্তিনী ডায়াস্পোরা সাহিত্য

ফিলিস্তিনি অভিধানে ভীষণ অনুনাদী

(ওয়াসাম আল আসাদি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ শারজাহর পূর্ণকালীন শিক্ষক। ২০০৪ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ট্রান্সলেশন অ্যান্ড ইন্টারপ্রিটেশন বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাজ্যের এক্সেটার ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ অ্যারাব অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের পিএইচডি ডিগ্রিধারী আসাদির পড়াশোনা ও গবেষণার মূল ক্ষেত্র ট্রান্সলেশন স্টাডিজ, ইন্টারকালচারাল স্টাডিজ, জেন্ডার স্টাডিজ এবং পোস্টকলোনিয়াল লিটারেচার।)
১৯৪৮ সাল আল-গুরবা (নির্বাসন)-এর শুরু এবং আল-নাকবা (ধ্বংস বা বিপর্যয়) হিসেবে চিহ্নিত।

শব্দ দুটি ফিলিস্তিনি অভিধানে ভীষণ অনুনাদী। এটা এমন একটা চূড়ান্ত তারিখ, যার সঙ্গে ‘-পূর্ব’ অথবা ‘-উত্তর’ প্রত্যয় যোগ করা যায় দিব্যপ্রকাশক মুহূর্তকে চিহ্নিত করতে। এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অক্ষে একটা নতুন শূন্যতার জগত আকৃত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে, বিতাড়ন ও পলায়ন মিলিয়ে, সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি প্রতিবেশি আরব দেশগুলোয় শরণার্থী হয়েছে। এক লাখ ফিলিস্তিনি থেকে গিয়েছে তাদের ভিটেয়। আর তার পর থেকে ‘ফিলিস্তিনি হওয়া মানে বোঝায়, অংশত লালিত-পালিত হওয়ার সূত্রে, অংশত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার নিরিখে, পরিব্রাজক, নির্বাসিত, চাঁদে-পাওয়া পাগল হওয়া, যে কিনা অন্যদের থেকে সব সময় কিছু-না-কিছু আলাদা। ১৯৪৮-এর পরে আমরা যে নাম পেয়েছি- বলা হচ্ছে আমাদের কোনো জাতি ছিল না- তা অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিতে ততটা জাতীয়তার পরিচায়ক নয়।’ [টারকি, এফ. (১৯৯৪)। এক্জাইল্স রিটার্ন : দ্য মেকিং অফ এ প্যালেস্টিনিয়ান আমেরিকান। নিউইয়র্ক : দ্য ফ্রি প্রেস]
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আত্মপরিচয় ও প্রত্যাবর্তনের থিম আবিষ্কারের মাধ্যমে এরা ফিলিস্তিনি সাহিত্যের সেই পদ্ধতিগুলোকে তুলে ধরেন যাতে আজকের ফিলিস্তিনি নির্বাসনের বাস্তবতা মূর্ত হয়। তারা নির্বাসনভূমি (এইক্ষেত্রে আমেরিকা) এবং ফিলিস্তিনের সঙ্গে নির্বাসিত ফিলিস্তিনি ও তাদের অধঃস্তনদের সম্পর্ককে প্রতীকায়িত করেন। একবিংশ শতাব্দীতে ফিলিস্তিনি আমেরিকানরা যে বাস্তবতার মুখোমুখি হন তার প্রেক্ষাপটে এই সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ; এই বাস্তবতা হচ্ছে একজন ‘নির্বাসিত’ ব্যক্তির নিজস্ব শারীরিক বা রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবোধের কষ্ট, বা বিকল্প হিসেবে, একজন ব্যক্তির অন্তর্গত আস্তিত্বিক দ্বন্দ্বরূপে প্রকাশিত সামষ্টিক যন্ত্রণা।

যেহেতু ফিলিস্তিন এখনো একটা জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি, সেহেতু শারীরিক নির্বাসন, এবং আরও বিশেষভাবে আধুনিকতাবাদী ব্যক্তিগত ‘নির্বাসন’, উভয়বিধ অস্তিত্বমূলক অনুধ্যানের কারণে নামটা পৃথিবীতে অলীক বস্তু হয়ে থাকে। [স্যালাইতা, এস. (২০০৩)। স্ক্যাটার্ড লাইক সিড্স : প্যালেস্টিনিয়ান প্রোজ গোজ গ্লোবাল (ক্রিটিক্যাল এসেজ)। ইউএসএ: ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া প্রেস] ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের ধ্বংসকর সামরিক বিজয়ের পর, রাজনৈতিক প্রপঞ্চকে ব্যক্তি-সংশ্লিষ্ট এবং রূপকে আবৃত করা আরও সর্বসাধারণিক প্রবণতার অংশ হয়ে গেছে।

‘ফিলিস্তিনি নির্বাসনের টুকরো টুকরো ব্যক্তিক বিশিষ্টতার মধ্যে শক্তিশালী আকর্ষণ তৈরি হয়েছে, এবং তার ফলে, সাহিত্যিক আধুনিকতাবাদ, একটা সৌন্দর্যতাত্ত্বিক প্রপঞ্চ, ভূমি এবং সম্পদ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের লেখালেখির অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত আঙিকে পরিণত হয়েছে।’ [স্যালাইতা, এস. (২০০৩)। স্ক্যাটার্ড লাইক সিড্স : প্যালেস্টিনিয়ান প্রোজ গোজ গ্লোবাল (ক্রিটিক্যাল এসেজ)। ইউএসএ: ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া প্রেস]
সাঈদের স্মৃতিকথা আউট অফ প্লেস (ঙঁঃ ড়ভ চষধপব) ফিলিস্তিনি ট্র্যাজিডির হৃৎপি- এবং আত্মাকে দক্ষতার সঙ্গে ধারণ করেছে। এতে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের শিকার নয়, বরং স্বাভাবিক মানবসত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাদের ব্যক্তিগত জীবন, ইতিহাস, পরিচিতি এবং নাম ছিল এবং আছে। 
আউট অফ প্লেস যৌবনের স্মৃতিকথা; জীবন, পরিবার এবং বন্ধুদের নিয়ে অন্তরঙ্গ জীবনিগ্রন্থ; এতে রয়েছে সাঈদের জেরুসালেমের জন্মস্থান, কায়রোর স্কুল, বৈরুতের পাহাড়ের গ্রীষ্মকাল, এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বোর্ডিং স্কুলের কথা; উন্মোচিত হয়েছে সমৃদ্ধ ও বর্ণিল চরিত্র এবং প্রাচ্যীয় ভূপ্রকৃতির অকল্পনীয় জগত। এর ভেতরে গেঁথে দেওয়া হয়েছে তরুণ সাঈদের আত্মপরিচয়ের সংকটকে, তিনি যার মুখোমুখি হয়েছেন আমেরিকান নাগরিক, খ্রীস্টান এবং ফিলিস্তিনি (শেষ পর্যন্ত হয়েছেন আসলে একজন দলছুট) হতে গিয়ে।

জন্মের পর থেকেই সাঈদ বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ও বহুভাষী পরিবেশে বাস করেছেন। তার স্মরণে নেই তিনি ইংলিশ না আরবি, কোনো ভাষায় প্রথম কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছেন যে, ‘এই দুইটি (ভাষা) সব সময়ই আমার সঙ্গে ছিল, একটার মধ্যে আরেকটা প্রতিধ্বনিত হতো, কখনো ব্যাঙ্গাত্মকভাবে, কখনো স্মৃতিকাতরতার সঙ্গে, প্রায়শই পরস্পরকে সংশোধন করত, পরস্পরের ওপর মন্তব্য করত।’ [সাঈদ, এ. (১৯৯৯)। আউট অফ প্লেস। নিউইয়র্ক : কèফ] স্থানচ্যুতির বিষয়ে তার অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে সাঈদ উচ্চারণ করেন-
‘আমার হঠাৎ-হঠাৎ নিজেকে বহমান স্রোতের গুচ্ছ বলে মনে হয়। একটা নিরেট সত্তার ধারণার চেয়ে আমি এই ধারণাকেই বেশি পছন্দ করি এই স্রোতধারাগুলোকে তাদের সর্বোত্তম রূপে; তাদের কোনো পুনর্মিলন বা ঐকতান প্রয়োজন নেই। তারা ‘দূরবর্তী’, এবং স্থানচ্যুতও হতে পারে, কিন্তু নিদেনপক্ষে তারা সব সময় গতিমান।’ [সাঈদ, এ. (১৯৯৯)। আউট অফ প্লেস। নিউইয়র্ক : কèফ] 
সাঈদের স্মৃতিকথা পড়তে গিয়ে যে কেউ তার মধ্যে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিসৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের উপস্থিতি খুঁজে পাবেন। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ভূ-রাজনিতি এবং আমেরিকার বিদেশনিতির সমালোচনার সঙ্গে যুক্ত করেন।
স্ক্যাটার্ড লাইক সিড্স (ঝপধঃঃবৎবফ খরশব ঝববফং)একটি আত্মজীবনিমূলক উপন্যাস। জাফর আলম নামের এক ফিলিস্তিনি আইনজীবী ও আনবিক পদার্থবিদের মধ্যপ্রাচ্যে ফেরার গল্প বলার মধ্য দিয়ে এতে নির্বাসিত ফিলিস্তিনিদের আত্মপরিচয়ের সংকটকে আবিষ্কার করা হয়েছে। তার স্ত্রী মেরি প্যাট একজন আইরিশ আমেরিকান, তাদের চার ছেলেমেয়ে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের পর আমেরিকান সমাজে তার আত্মীকরণ প্রশ্নের সম্মুখীন হয় এবং একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে তার পরিচয়ের সঙ্গে তাকে পুনরায় আবশ্যিকভাবে দ্বন্দ্বে নামতে হয়।

অ্যালেনবাই ব্রিজে (পশ্চিম তীরের অধিকৃত এলাকা এবং জর্দানের মধ্যকার সীমান্ত পার হওয়ার সময়) জাফরকে উলঙ্গ করে পরীক্ষা করার পর পশ্চিম তীরে তার মাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকার করা হয়। এই ভ্রমণ জাফরের আদর্শিক রূপান্তরের বাঁকবদল সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। আরব বিশ্বের বাস্তবতার সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খাওয়নোর জন্য তাকে ক্রমান্বয়ে তার দর্শন বদলে নিতে হয়। একজন ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদীর নতুন অবস্থানে চূড়ান্ত পর্যবসনের আগে জাফর এই রাজনৈতিকীকরণের বিরোধিতা করেছে। ‘ওই (অ্যালেনবাই) ব্রিজে যা ঘটেছে তাই তোমাকে বদলে দিয়েছে, তুমি জানো সেটা এর শুরু বৈরুতে, শরণার্থী শিবিরে তারপর সুহাইলিয়ার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, তোমার স্বদেশী সে, তোমার মধ্যেকার ঘুমন্ত প্রেমাবেগ জাগিয়ে তোলে।

কিন্তু ব্রিজের ওই অপমান এবং মাকে দেখতে যেতে না পারাটাই তোমাকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছে।’ [দালাল, এস. (১৯৯৮)। স্ক্যাটার্ড লাইক সিড্স। সাইরাকিউজ: সাইরাকিউজ ইউনিভার্সিটি প্রেস] অবশ্য আত্মপরিচয় এবং সংগ্রামে তার ভূমিকার ব্যাপারে তার মধ্যে সংশয় থেকে যায়। ফিলিস্তিনি-আমেরিকান জীবনের বিবেচনায় জাফরের অভিজ্ঞতার তুলনায় তার সন্তানদের লড়াই বরং আরও প্রতীকী। ক্রমান্বয়ে, উপন্যাসে তাদের ভূমিকা ইঙ্গিত দেয় নির্বাসন ফিলিস্তিনিদের কিভাবে পরিবর্তিত করে দিয়েছে।

এটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, কলেজছাত্র কলিন এবং অ্যান্ড্রু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়াকে অগ্রাধিকার দেয়, এবং কিশোরবয়সী ক্যাথারিন এবং সিয়ান মধ্যপ্রাচ্যে জীবন কাটাতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বিনিয়োগ এখনো এমন যথেষ্ট নয় যে সেটাকে জীবনযাপনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভাবতে হবে। (স্যালাইতা, ওই) আরও গুরুতর বিষয় এই যে, তাদের কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায় যে ফিলিস্তিনি অভিবাসী এবং আমেরিকায় জন্ম নেওয়া ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে। (চলবে...)

×