ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০

একটি শোকসংবাদ

হাবিবুল্লাহ রাসেল

প্রকাশিত: ০১:৪০, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

একটি শোকসংবাদ

একটি শোকসংবাদ

একটি শোকসংবাদ শুনুন...। বড় রাস্তা থেকে মাইকের ধ্বনি ভেসে আসায় আমরা চায়ের কাপ টেবিলের ওপর রেখে পরবর্তী বাক্য শোনার জন্য একসঙ্গে কান খাড়া করি। নদীর বাঁধের ওপর ঘোড়া জামালের টংঘরে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম কজন। যদিও জামালের সামনে ঘোড়া শব্দ উচ্চারণ করলে আরবি ঘোড়ার মতোই লাফিয়ে ওঠে চার হাত, তারপর তেড়ে আসে। বয়সে কনিষ্ঠ এমন কেউ ডাকলে আর সুযোগ পেলে কানপাকা এক চড় লাগিয়ে দিতে ভুল করে না। সার্কাসের ঘোড়ার পিঠে চড়তে গিয়ে পড়ে আহত হলে নাম উঠে যায় ঘোড়া জামাল। কদিন যেতে না যেতে বাপ-দাদার রাখা জামাল নামটা লুপ্ত হয়ে কেবল ঘোড়া নামটি প্রচার পায়। এখন আমরাও বলি, চল ঘোড়ার দোকানে চা খাই। বা মানুষজনও বলে ঘোড়ার দোকান থেকে এটা নিয়ে আয়, সেটা নিয়ে আয়।
গ্রামের মানুষের স্বভাব হয়ে গেছে সুযোগ পেলেই নামের সঙ্গে একটা বিশেষণ যুক্ত করে দেওয়া। কবুতর পালে বলে নাম উঠেছে কৈতর আজিজ, কদিন বেজি পালন করেছে বলে নাম উঠেছে বেজি খালেক, প্রচুর তালগাছ লাগিয়েছে বলে নাম উঠেছে তাল কাদের। এভাবেই তেল মতি, চাপা রুস্তম, আন্ডা মজিদ, আরো কতো কি!
ঘোড়া জামালের দোকানে বসে চা খেতে খেতে আমাদের আড্ডাটা যখন জমে উঠেছে তখন মাইক সালামের কণ্ঠ ভেসে এলে আমাদের আড্ডার আনন্দ হঠাৎ নিভে যায়। নামের সঙ্গে মাইকজুড়ে গেলেও মাইকিং করা তার পেশা না। মাইকে সালামের কণ্ঠ ভেসে এলে এখন ছোট-বড়, আন্ডা-বাচ্চা এমনকি দুধের শিশুও বুঝতে পারে- কেউ মারা গেছে। সালাম অবশ্য মারা যাওয়া শব্দটি উচ্চারণ করে না। সালাম বলে, ইন্তেকাল করেছেন। আমরা মারা গেছে বা মৃত্যুবরণ করেছে বললেও সালাম বলে, মারা যায় অন্য প্রাণী, মানুষ করে ইন্তেকাল। আমরা দূরে বসে মাইক সালাম বললেও কাছে এলে ভাই বলে ডাকি।  
সালাম ভাই রিক্সা চালায়। রিক্সা চালানোই তার জীবিকার একমাত্র উৎস। গ্রামে একটি মাত্র পাকা রাস্তা থাকলেও সালাম যাত্রী নিয়ে কাঁচা রাস্তায়ও যায়। উঁচু-নিচু ভাঙা কাঁচা রাস্তায় রিক্সা চালাতে গিয়ে চাকা প্রায়ই টাল হয়। কিন্তু যাত্রী নিয়ে কাঁচা রাস্তায় যেতে কখনো আপত্তি করে না সালাম। সালামের প্রবল ইচ্ছাশক্তি উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে যাত্রী নিয়ে সাই সাই করে ছুটে চলে। কিন্তু আপত্তি করে বৃষ্টি। বর্ষাকাল এলে কাঁচা রাস্তা কাদায় একাকার হয়ে যায়; লাঙল দিয়ে মই দেওয়া জমির সঙ্গে তার কোন পার্থক্য থাকে না। বীজ ছিটালে ফসল হতে পারে বেশ; কিন্তু জমি সদৃশ রাস্তার ওপর দিয়ে পথচারীদের হাঁটু ডুবিয়ে চলাচল করতে হয় বলে বীজ ছিটানোর আর উপায় থাকে না।
ফলে বর্ষাকাল এলে সালামের কোন ইচ্ছা শক্তিই আর কাজে আসে না। তখন তাকে কেবল পাকা রাস্তায় গ্রামের এক মাথা থেকে বন্দর পর্যন্ত রিক্সা চালিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তবে কেউ যদি শহরে যেতে চায় তবে তিন গ্রাম পরে বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য সালামের রিক্সাই ভরসা।
রিক্সা চালানো সালামের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম হলেও তাকে প্রায়ই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। তার নিজের একটি মাইকসেট আছে।

গ্রামের কেউ মারা গেলে সে নিজেই রিক্সায় করে সমস্ত গ্রাম প্রচার করে বেড়ায়। তখন কেউ যাত্রী হয়ে আসলেও, যতো টাকাই দিতে চায় না কেনো, কোনো কাজ হয় না; এলাকার কেউ মারা গেলে তার একমাত্র কাজ ‘শোকসংবাদ’ প্রচার করা। প্রচারের জন্য মরহুম/মরহুমার আত্মীয়স্বজন কেউ কোনো অর্থ-সম্মানী প্রদান করতে চাইলে তা নিতে একদম অপারগ সালাম।
কেউ যদি জোরাজুরি করে, ‘তোমার তো খরচ আছে মিয়া, এই মাইকটার পিছনে খরচ আছে না কও? তুমি যে তোমার কাম-কাজ ফেলে এই কাজ করলা, তার তো কোনো পারিশ্রমিক দিই নাই, শুধু মাইকের খরচ...’
সালামের এক জবাব, ‘আমি গরিব মানুষ, মানুষের তো কোনো উপকার করতে পারি না, এই প্রচার করে মানুষের জন্য যদি সামান্য কিছু করতে পারি, আমারে তা করতে দেবেন না?’
‘আহা, করতে দেবো না কেনো, তোমার ভালো কাজের সঙ্গে আমরা কিছুটা শরিক হই?’
‘এই প্রচার করে আমার যদি সামান্য ছওয়াব হয়, তা থেকে আমারে বঞ্চিত কইরেন না।’
এই কথার পর আর কারো কথা থাকে না।  
মৃত ব্যক্তির বাড়িতে দোয়ায় দুই হাজার লোকের আয়োজনে যেমন তার দাওয়াত থাকে, আবার কেবল দুই জন হুজুরসহ কবর খনন ও গোসলের দায়িত্বে থাকা জনকয়েকের অংশগ্রহণে আয়োজিত দোয়া ও দুপুরের খাবারেও তার দাওয়াত থাকে। বাড়তি নেকির আসায় দোয়া অনুষ্ঠান কখনোই মিস কররে না সালাম।
এক সময় সালামের রিক্সা ছিলো না, তখন নৌকা চালানো ছিলো তার জীবিকা নির্বাহের বৃত্তি। তখন তার মাইক ছিলো না। কেউ মারা গেলে মুখে মুখে প্রচার করে বেড়াতো পাড়ায় পাড়ায়। এই প্রচার করতে পারাটাই ছিলো তার সুখ। জোরে জোরে আওয়াজ তুলতে তুলতে কখনো তার কণ্ঠ বসে যেতো। তবু ক্লান্তি নেই সালামের। তখন পাড়ায় পাড়ায় ঘনঘন এতো মসজিদ ছিলো না। অনেক দূরে দূরে দু-একটি মসজিদ থাকলেও তাতে মাইক ছিলো না। পরবর্তীতে ঘনঘন মসজিদ হলেও, আর মসজিদে মসজিদে মাইক এলেও এবং সে মাইকে শোকসংবাদ প্রচার হলেও সালামের প্রচারের মতো অতো দরদ আসে না।
স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পরে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ালেন পাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা শমসের চাচা। প্রচার চালানোর জন্য তিনি অনেক টিনের চোঙা বানিয়ে দিলেন। সালামও প্রচারের জন্য পেল একটি চোঙা। রাতে শমসের চাচার বাড়ি পড়ে থাকে আর সারাদিন প্রচার করে, ভোট দিন ভোট দিন শমসের ভাইকে ভোট দিন।

ভোট দিন ভোট দিন হুক্কা মার্কায় ভোট দিন। প্রচার ভালো হলেও শমসের চাচা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পাকিস্তানের দালাল লুডু দেলোয়ারের কাছে হেরে যায়। সালাম তখন অবাক হয়, যুদ্ধের সময় লুট করার কারণে যার নামের সঙ্গে মানুষ লুডু যোগ করে দেয় তাকেই আবার মানুষ ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান বানায়! মুক্তিযুদ্ধ করেও শমসের চাচা চেয়ারম্যান হতে পারেন না, কিন্তু হুক্কা মার্কায় দাঁড়িয়েছে বলে আড়ালে মানুষ তাকে হুক্কা শমসের বলে ডাকে।
ভোট শেষে সালামকে আর মুখে মুখে শোক সংবাদ প্রচার করতে হয় না। শমসের চাচার চোঙা দিয়ে কণ্ঠে অধিক দরদ ঢেলে গ্রামের কাঁচারাস্তা ধরে শোক সংবাদ প্রচার করে বেড়ায়- ‘একটি শোকসংবাদ শুনুন, একটি শোকসংবাদ শুনুন, স্থানীয় হাওলাদার বাড়ি নিবাসী আজগর হাওলাদারের বড় ছেলে, মোবারক হাওলাদার, অদ্য সকাল ১০ ঘটিকার সময় তার নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬২ বছর। মরহুমের জানাজার নামাজ বাদ আছর হাওলাদার বাড়ি জামে মসজিদ মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত জানাজার নামাজে সকলকে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষভাবে আহ্বান করছি। একটি শোকসংবাদ...।’
চোঙাটি পেয়ে সালাম খুশি হয়, খালি মুখে বলার চেয়ে অনেক জোরে আওয়াজ হয়, সে আওয়াজ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় আর বেশি মানুষ শুনতে পায়।
গ্রামের প্রধান রাস্তার সাঁকো উঠে গেলে সালাম নৌকা চালানো ছেড়ে দিয়ে একখানা রিক্সা কেনে। গ্রামে প্রথম রিক্সা এলে মানুষ উৎফুল্ল হয়। নৌকা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও যেখানে যাত্রীর দেখা পাওয়া যেতো না, সেখানে রিক্সায় বেশ যাত্রী পায় সালাম। একটি মাইকের স্বপ্ন দেখে সে। ভাবে, একটি মাইক থাকলে কতো সুন্দর করে শোক সংবাদগুলো প্রচার করতে পারতো। নিজের রিক্সায় করে অল্প সময়ের ভেত দুই-চার গ্রাম ঘুরে আসতে পারতো। অল্প সময়ের ভেতর দূর-দূরান্তের মানুষ জেনে যেত শোকসংবাদ।
পরিবারের জন্য কম খরচ করে, একটু একটু টাকা জমিয়ে আর বাবার লাগানো একটি গাছ বিক্রির অংশ দিয়ে দু’বছরের মাথায় ব্যাটারিসহ একটি মাইকসেট কিনে ফেলে সালাম। ততোদিনে বন্দরে বিদ্যুত এসে গেছে। বন্দরের শিল্পী ব্যাটারিঘর থেকে কিছুদিন পরপর চার্জ দিয়ে আনে। স্থানীয় মসজিদের হুজুর ডেকে কোরান পাঠ করায়। পাড়ার ছেলেমেয়েরা আনন্দ নিয়ে সুরা পাঠ করে, হামদ্-নাথে রসুল গায়।   
শমসের চাচার মৃত্যুতে সালাম কষ্ট পেলেও তার মনে আনন্দ লাগে এই ভেবে যে, তার ইলেকশনের চোঙা দিয়ে কতো শোক সংবাদ প্রচার করেছে, আর চাচা ইন্তেকাল করলে মাইক দিয়ে সর্বপ্রথম চাচার শোক সংবাদ প্রচার করতে পারছে। আরও আনন্দ হয়, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার শোক সংবাদ প্রচার করতে পারছে।
মাইকে সালামের কণ্ঠে যেন আরো দরদ ফুটে ওঠে- প্রিয় এলাকাবাসী; ‘একটি শোকসংবাদ শুনুন, একটি শোক সংবাদ শুনুন, স্থানীয় তালুকদার বাড়ি নিবাসী মোশারফ তালুকদারের মেঝ ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা শমসের চেয়ারম্যান আজ ভোর ৫ ঘটিকায় বার্ধক্যজনিত কারণে ৮৬ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহুমের জানাজার নামাজ বাদ আছর হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত জানাজার নামাজে সকলকে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষভাবে আহ্বান করছি। একটি শোকসংবাদ শুনুন...’। শমসের চাচা নির্বাচনে চেয়ারম্যান হতে না পারলেও অনেক বছর পর তার মৃত্যু সংবাদের সাথে চেয়ারম্যান শব্দটি জুড়ে দিয়ে সালাম অপার প্রশান্তি পায়।
এভাবে মাইকে শোক সংবাদ প্রচার করতে করতে কখন যেন সালামের নামই হয়ে গেল মাইক সালাম। মাইক সালাম বললে সাত গাঁয়ের মানুষ তাকে চেনে। হাতে মাইক উঠেছে তাও প্রায় এক দশক হলো। হাতে মাইক ওঠার পর তার কণ্ঠে শোক সংবাদ নতুন এক মাত্রা পেয়েছে। শোক সংবাদ বলেন, মনে হয় কিছু আবৃত্তি করছেন। সে আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠ থেকে মায়া ঝরে পরে; সে মায়ায় ছেয়ে যায় পথ-প্রান্তর, শস্য ক্ষেত, নদী; নদী পেরিয়ে দিগন্তের আকাশ। তার শোকবিদ্ধ মায়াকণ্ঠে বাতাস ঝাউবন কাঁপিয়ে হু-হু করে উঠে; বিদ্ধ হয় প্রতিটি শ্রোতার অন্তর।  
কিন্তু আজ শৈত্যপ্রবাহ মিশ্রিত মাঘের দুপুরে, যখন সূর্যের মুখ একদম দেখা যায় না, শরীরে একটু উত্তাপ নিতে ঘোড়া জামালের টং ঘরে বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছি, আর সোয়েটার-চাঁদরে শরীর ডেকে হাসি-ঠাট্টার ওম নিচ্ছি, আর ঠিক এই মুহূর্তেই মাইক সালামের মাইকটা কেঁদে উঠলোÑ ‘একটি শোকসংবাদ শুনুন...’।  সালামের কণ্ঠে মায়া ঝরে, কিন্তু আজ যেন দুনিয়ার সব মায়া ঝরে পড়ছে। যেন শোক নামছে সপ্ত আসমান থেকে। শীত আসছে সাইবেরিয়া থেকে, এন্টার্কটিকা থেকে। সালামের কণ্ঠ কাঁপছে, চোখ দিয়ে ঝরছে আজর ধারা। ‘একটি শোকসংবাদ শুনুন; আমার প্রিয় এলাকাবাসী একটি শোক সংবাদ শুনুন; মাঝি বাড়ি নিবাসী মরহুম আলতাফ মাঝির সহধর্মিণী আজ সকাল ১০ ঘটিকার সময় তার নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিলো আনুমানিক ৭৮ বছর। তিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন রোগে ভুগতে ছিলেন। মরহুমা সম্পর্কে আমার মা। সন্তান হয়েও আমি তার যথাযথ চিকিৎসা করাতে পারিনাই। মরহুমার নামাজের জানাজা বাদ আছর বায়তুল আমান জামে মসজিদ মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। মেহেরবানি করে আপনারা আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন। একটি শোকসংবাদ শুনুন...।’
আমাদের চোখ দিয়ে জল নেমে এলো। আমরা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেওয়া ভুলে গেলাম। আজ সূর্য তার মুখ দেখায়নি ভুলে গেলাম, শৈত্য প্রবাহের কাঁপন ভুলে গেলাম।
সপ্তাহদেড়েক পরের এক সন্ধ্যা। ঘোড়া জামালের দোকানে বসে অলস সময় পার করছি। দেখি মাইক সালাম যাত্রীবিহীন রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে বড় রাস্তা দিয়ে। আমি জোরে জোরে ডাকি, ‘সালাম ভাই...; ও সালাম ভাই...।’
সালাম ভাই রিক্সা থামায়। জিজ্ঞেস করে, ‘যাবা কোথাও?’
‘না। চা খেয়ে যাও।’
সালাম ভাইয়ের চায়ে আগ্রহ কম। কিন্তু আজ রিক্সাটা রাস্তার পাশে রেখে কাছে এলো।
জামাল আদা-লবঙ্গ দিয়ে চা দেয়। আমরা চায়ে চুমুক দিই।
জিজ্ঞেস করি, ‘কেমন আছো সালাম ভাই?’
‘না রে, মা ইন্তেকাল করার পরে মনটা একদম ভালো নাই।’
সালাম ভাইয়ের কথায় আমাদের মনও বিষণœ হয়ে ওঠে। হঠাৎ করে যেন কুয়াশা নামে। সদ্য চা খেলেও শীত নামে শরীর জুড়ে। কাঠের গুঁড়োয় জ্বলা উত্তপ্ত চুলোও যেন শীতে কাঁপছে।
বিষণœ পরিবেশ স্বভাবিক করতে সালাম ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘সালাম ভাই, আপনি তো বহু বছর ধরে শোকসংবাদ প্রচার করছেন; তা এভাবে শোকসংবাদ প্রচার করার চিন্তা কিভাবে আপনার মাথায় এলো?’
এই প্রশ্ন অবশ্য অনেক দিন ধরে সালাম ভাইকে করতে চেয়েছি, কিন্তু যথাযথ পরিবেশের অভাবে তা আর হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু আজ সুযোগ পেয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললাম।
সালাম ভাই বলেন, ‘শুনবা?
আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে বলি, ‘বলেন সালাম ভাই।’
সালাম ভাই টুলের ওপর পা তুলে আরাম করে বসেন, ‘আজ পর্যন্ত এই কথা কেউ জিজ্ঞেস করে নাই, আমিও বলি নাই। শোনো তবে, স্বাধীনের বছর আমার বয়স আর কতো, ৯/১০ হইবে। মিলিটারির সংবাদ পাইলেই আমরা জঙ্গলের ভেতর পালাইয়া পালাইয়া থাকি। শেষ দিকে কার্তিক-অঘ্রাণ মাসে তো মিলিটারি আর রাজাকারের উৎপাত খুব করে বাড়লো। বন্দরে ক্যাম্প করলো মিলিটারি। দিনের বেলা আমরা তখন একদম আর বাড়ি থাকি না। ভোর ফোটার আগেই জঙ্গল আর ধান ক্ষেতে আশ্রয় নিই। একদিন হইলো কি, চিড়ার পোটলাটা ভুলে ফালাইয়্যা আসি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় প্রত্যেকের হাতেই কিছু না কিছু থাকতো। এই যেমন: পানির কলসি, শুকনা খাবার, গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র, ৩ মাসের ছোট ভাইটার কাঁথা-কাপড়। মা মনে করছে আব্বায় চিড়ার পোটলা লইছে, আবার আব্বায় মনে করছে মায় লইছে। কিন্তু বেলা বাড়লে ক্ষুধা লাগলে দেখি চিড়ার পোটলা নাই।
মা নিষেধ করলেও আব্বা বাড়িতে যায়। আমরা অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু আব্বায় আসে না। বাড়ির দিক থেকে গুলির শব্দ আসে। বিভিন্ন দিক দিয়ে গুলির শব্দ আসে। আমরা ভয়ে লাতা-পাতার মধ্যে লুকিয়ে থাকি, আব্বার জন্য কাঁদতে থাকি। দোয়া-দরুদ পড়ি, আয়তাল কুরছি পড়ি, আল্লা আল্লা করতে করতে গলা শুকিয়ে যায়। তারপর বিকাল যায় সন্ধ্যা গড়িয়ে আসে। ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরি। সব অপরিচিত লাগে। আমাদের বাড়িটা চেনা যায় না। সব কিছু তছনছ। রক্ত মাখা আব্বার লাশটা পড়ে আছে উঠানের এক কোণে।’
এইটুকু বলে সালাম ভাই থামে। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। সালাম ভাই চোখ মুছে। জগ দিয়ে ঢেলে পানি খায়। তারপর বলতে থাকে, ‘আব্বার দাফন করার মানুষ পাই না, তখন জীবিতরা পালিয়ে আছে আর যারা পালাতে পারেনি তাদের রক্তমাখা লাশ আব্বার মতো পড়ে আছে। আমরা দুই ভাই কবর খনন করি, যা কবর না হয়ে গর্ত হয়ে যায়। দুই ভাই ওজু করে জানাজার মতো দাঁড়াই, জানাজার নামে ভুলভাল দোয়া পড়ি। টেনে-হিঁচড়ে মাটি চাপা দিই আব্বাকে। যখনই মনে পড়ে বুকটা কেঁদে ওঠে। আমার আব্বার জানাজা হয় নাই। যুদ্ধ শেষ হইলে আব্বাকে স্মরণ করি, ভাবি, প্রত্যেকের জানাজায় যেন অধিক মানুষ হয়। তাই শোকসংবাদ প্রচার করি। প্রচার করে আব্বার জানাজা না হওয়ার দুঃখ্খ ভুলিÑ শান্তি পাই।’
সালাম ভাই একটু থামে। আমরা তার মুখের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকি। সালাম ভাই বলে, ‘তোমরা আমারে একটি অনুরোধ কখনো করবা না।’
আমরা অবাক হই, ‘কী অনুরোধ সালাম ভাই?’
‘পাকিস্তানের দালাল লুডু দেলোয়ারের মৃত্যু সংবাদ আমারে প্রচার করতে বলবা না।’
আমরা খেয়াল করি, মানুষের মৃত্যুকে সালাম ভাই সব সময় ইন্তেকাল বললেও লুডু দেলোয়ারের বেলায় তা বলেন না।
সালাম ভাই আমাদেরকে ৮৬ বছর বয়সী লুডু দেলোয়ারের মৃত্যু সংবাদ প্রচারের অনুরোধ করার কোনো সুযোগই দেয় না। লুডু দেলোয়ারের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা বা না করার সিদ্ধান্তের ওপর কোনো হাতই থাকে আর সালাম ভাইয়ের।
আষাঢ়-সন্ধ্যায় খবর আসে সালাম ভাই হঠাৎ মারা গেছে। আমাদের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। খারাপ হয় এটা ভেবেও, যে লোক জীবনভর সবার মৃত্যু সংবাদ কতো সুন্দর করে সারা গাঁ ঘুরে ঘুরে প্রচার করলো, তার মৃত্যু সংবাদ আজ অতো সুন্দর করে কে প্রচার করবে? এই কথা আমরা ঝুম বৃষ্টিতে ঘরে বসে ভাবি, আর একে আপরকে বলাবলি করি। বৃষ্টি যেন ঘরের চালা ছিদ্র করে দেয়। সালাম ভাইয়ের মৃত্যুতে আকাশও কি কাঁদছে? হঠাৎ আমাদের সকল ভাবনাকে ভূ-কম্পনের মতো ঝাঁকুনি দিয়ে, বৃষ্টির শব্দ ছিন্ন-বিছিন্ন করে মাইকে সালাম ভাইর কণ্ঠ বেজে ওঠে, ‘একটি শোকসংবাদ শুনুন, একটি শোকসংবাদ শুনুন; মাঝি বাড়ি নিবাসী মরহুম আলতাফ মাঝির মেজ ছেলে সালাম মাঝি ওরফে মাইক সালাম ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। একটি শোকসংবাদ শুনুন...।’

শীর্ষ সংবাদ: