ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

গদ্যশিল্পের বুলবুল চৌধুরী

প্রণব মজুমদার

প্রকাশিত: ০১:২৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

গদ্যশিল্পের বুলবুল চৌধুরী

আইয়ুব আল আমিন

তিনিই প্রকৃত পাঠক, যিনি পঠনের মধ্যে সৃজনশীলতাকে আবিষ্কার করেন গভীরভাবে। অতলান্তিক মনে কাজকে যিনি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্য দেন। ফলে মনোযোগী সেই পাঠক চৈতন্যে মগ্নশীল হয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। স্নায়ু তৃপ্তিতে পুলকিত হয় তাঁর মনোজগত। সৃষ্টির উপাদান ও অনুষঙ্গ নিয়ে তিনি তখন প্রশান্তি লাভ করেন। ব্যক্তিক পরিচয় সেখানে মুখ্য হয় না তাঁর কাছে। সৃজনশীল কাজই বড়। মানব প্রকৃতির এসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সে পাঠকেই সৃষ্টিশীল ব্যক্তির পরম বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

সত্যিকার সৃজনশীল ব্যক্তির ভাবনা বোধ হয় এমনই। আমার দৃষ্টিভঙ্গিও তেমনি। পাঠের আত্মতুষ্টি নেব মনস্থিত বোধ দিয়ে। তারপর সৃজনশীল ব্যক্তির ব্যক্তিগত সঙ্গ। কথাশিল্পী বুলবুল চৌধুরীও মনে হয় তাই মনে করতেন। তাঁর প্রিয়জন ও শুভাকাঙ্খীরা প্রথমে তাঁর সৃষ্টির একনিষ্ঠ পাঠক, পরে পরম বন্ধু। আড্ডা দিতেন নির্বাচিত বন্ধুদের নিয়েই এবং গল্পের সে আড্ডা ছিল সাহিত্য ও ইতিহাস কেন্দ্রিক। বস্তুনিষ্ঠ ও জীবনঘনিষ্ঠ! হয়েছেও তাই। বন্ধুরা প্রথমে ছিলেন তাঁর সৃজন কর্মের দরদী পাঠক। যা পরে তাঁর কর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণে সে প্রমাণও রেখেছেন তাঁরা।

দেশের প্রখ্যাত প্রচ্ছদ শিল্পী এবং কথাসাহিত্যিক ধ্রব এষ যাপিত জীবনের কথাকার বুলবুল চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস ‘আমার একজন মানুষ’। জিনিয়াস পাবলিকেশন্স থেকে এবারের বই মেলায় উপন্যাসটি বেরিয়েছে। যে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বুলবুল চৌধুরী। কবি আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, আবিদ আজাদ, কথাশিল্পী কায়েস আহমেদ, শেখ আবদুল হাকিম, হরিপদ দত্ত, মাহবুব রেজা, কবি ও প্রাবন্ধিক পিয়াস মজিদ, হামিদ কায়সার, প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ, মাসুক হেলাল, অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, অনুবাদক ও সাংবাদিক আহসান হামিদ, অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক আহমেদ মাওলা প্রমুখ বুলবুল চৌধুরীকে চিনেন গভীর মনন ও পরম ভালবাসায়। কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, রাহাত খান ও কবি ও সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁরাও বুলবুল চৌধুরীর লেখার জগতকে গভীর চেতনায় অনুভব করেছেন।
অনেকটা উড়নচ-ী ও কথাবার্তায় অকৃত্রিম ও সহজাত বুলবুল চৌধুরীকে দেখলে মনে হতো, লম্বা চুলের ভারি কাঁচের চশমা পরিহিত মানুষটি যেন নির্ভেজাল রাশভারি ব্যক্তি! তাকে দেখি ১৯৮৮ সালে ডিসেম্বর মাসের এক সন্ধ্যায়, রাজধানীর আরামবাগে। কথাশিল্পী ও শিক্ষক হরিপদ দত্তের বাসায়। বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে সে আমার প্রথম দেখা। সে বাসায় কথাসাহিত্যিক মণীষ রায়ের সঙ্গেও আমায় পরিচয় করিয়ে দেন হরিপদদা! গলির মুখে এগিয়ে আসেন তিনি। দোকান থেকে জর্দা ও খয়ের দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে হরিপদ দত্তদা বললেন,‘বুলবুল চৌধুরীর গল্প টুকা কাহিনী পড়েছেন?’ সাপ্তাহিক বিচিত্রাতে প্রকাশিত মণীষ রায়ের কাক গল্পটা আমাকে বেশ ভাবিয়েছে তখন। বিষয়টি দত্তদা ও মণীষকেও বলেছিলাম।

কথাসাহিত্যে আমারগভীর পাঠাভ্যাসও লেখালেখির সংপৃক্ততাঁর কথা জানতেন হরিপদদা। তিনি পরামর্শ দিতেন বিশ^ সাহিত্য এবং দেশের বিখ্যাত লেখকের সেরা রচনা প্রসঙ্গে। হরিপদদার সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ থাকলেও বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। চেষ্টাও করিনি আমি। কিন্তু তাঁর লেখা টুকা কাহিনীর গল্পে গ্রামীণ কাদামাটির ঘ্রাণ এরই মধ্যে নিয়ে ফেলেছি আমি। বহুদিন পর পাঠ নিয়েছি গল্পগ্রন্থ পরমানুষ এবং মাছের রাত।
২০২০ খ্রিস্টাব্দের নবেম্বরে অতিমারীর মধ্যে কথাশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে পুনঃদেখা।

বাংলা বাজারের মান্নান মার্কেটের অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে কিনেছি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ইতু বৌদির ঘর। সদরঘাটে অবস্থিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পুথিনিলয়ে আমার গল্পগ্রন্থ বিস্মৃত পলক ও কাব্যগ্রন্থ কবিতাঁর বাড়ি প্রকাশনার টানা কাজ চলছে। দুপুরে আহার করতে গিয়েছি পুরান ঢাকা বাংলা বাজারের শ্রীশদাস লেনের ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোডিংয়ের হোটেলে। খাবারের বিল দিতে গিয়ে পাশের টেবিলে খেতে বসা বুলবুল চৌধুরী স্থির চাউনিতে তাকালেন আমার দিকে! বললেন, ‘ইতু বৌদিরে কই পাইলেন?’ সপ্রতিভ হলাম। বললাম-
-বাংলা বাজার থেকে কিনেছি। এও জানালাম সাড়া জাগানো তাঁর অনবদ্য সাবলীল শিল্পকথনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকদিন ধরে! খুশি হলেন শুনে। জিজ্ঞাসা করলেন আমার গন্তব্য। উনিও যাবেন পুথিনিলয় কার্যালয়ে। দুজন হাঁটতে লাগলাম। বললেন, তাঁর বাছাই কিশোরগল্প গ্রন্থের কাজ চলছে পুথিনিলয় এ। পথে যেতে যেতে হরিপদদা প্রসঙ্গ এবং তাঁর লেখা টুকা কাহিনী, এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে, যাও পাখি বলো তারে, তিয়াসের লেখন ও পরমানুষ পাঠের কথা হয়। চরিত্রগুলোর সঠিক নাম শুনেও তা তিনি রীতিমতো অবাক! বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে সে আমার শেষ দেখা।
প্রখ্যাত কথাশিল্পী বুলবুল চৌধুরী আমৃত্যু ছিলেন সম্পূর্ণ লেখক। বাংলা সাহিত্যে গদ্যের সুষম কারিগর। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যায় থেকেও তিনি ভেবেছেন তাঁর লেখার জগত নিয়ে। ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্ত্রী নাসরীন চৌধুরীর সহযোগিতায় পঠনপর্বে যুক্ত হয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা উত্তর কথাসাহিত্যে বুলবুল চৌধুরী নীরবে-নিভৃতে তাঁর অতুলনীয় গদ্যরীতিতে গল্প-উপন্যাসে যে আলাদা ধারা নির্মাণ করেছিলেন, তা আমাদের অনেক সাহিত্য সমালোচকদের কাছে অনালোকিত রয়ে গেছে।

সারাটা জীবন আড়ালেই থেকেছেন তিনি। আর দশজনের মতো নিজে উ™£ান্তের মতো বিক্রি হননি। নিজের সর্বস্ব কারও বা কোন গোষ্ঠীর কাছে নির্লজ্জ রকমের বন্ধক রেখে সাহিত্যচর্চা করেননি। নিজের মতো করে নিজের লেখাটাই সারাজীবন লিখে গেছেন। তাঁর প্রকাশে সারল্য আছে, কোন রাখঢাক নেই। যা বলেন স্পষ্ট। ক’ বছর আগে তাঁর ওপর প্রকাশিত নীতি দীর্ঘ এক সাক্ষাতকারে সে বয়ান উল্লেখযোগ্য। প্রতিথযশা দেশের এক কবিকে দেয়া কথাগুলো হুবহু এমন- ‘অনেকের মতো আমি লেখক হতে চাইনি। চিত্রপরিচালক হতে চেয়েছিলাম। সেজন্য এফডিসিতে ঘোরাঘুরি করতাম।

১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঢাকায় ‘জোনাকি’, ‘ঝিনুক’ ও ‘চিত্রকল্প’ নামে তিনটি সিনে ম্যাগাজিন বেরোত। আমি ‘জোনাকি’র চিত্র সাংবাদিক ছিলাম। ‘আমি পুরান ঢাকার জুবিলী স্কুলের ছাত্র ছিলাম। লেখার ইচ্ছেটা তখন হয় নাই। ইচ্ছে ছিল সিনেমা বানানোর। এর মধ্যে আমার বন্ধু কায়েস আহমেদ বলল, তুই গল্প লেখ! একদিন সে আমাকে বিউটিতে নিয়ে গেল। বিউটি বোর্ডিং তখন কবিদের আড্ডা। আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, কায়েস আহমেদের দলে ভিড়ে গেলাম। আর আমার তখন পয়সা ছিল। সরকারী একটা চাকরি ছিল। ৩১২ টাকা বেতন।

চাকরির পয়সা আর বাড়ির ধানের পয়সায় এগুলো দিয়ে বেশ ভালই চলত তখন। হঠাৎ মনে হলো, আমি যদি লিখতে না পারি, তাহলে এদের সঙ্গে দল বাঁধলাম কেন? হাসানকে ধরলাম। সে তো বাঁদরের হদ্দ! তো একটা কবিতা লিখলাম। ‘রঘুবংশীর বাংলাঘরে’ নামে সেই কবিতা পড়ে হাসান বলল, কবিতাটা তো ভালই। কিন্তু তুমি এর নাম দাও ‘প্রাকৃত কবিতা’। আমি চিন্তা করলাম, কবিতা লিখে ওদের সঙ্গে পেরে উঠব না, আমাকে গদ্যই লিখতে হবে।’ ‘আমার লেখা প্রথম বেরোয় ১৯৬৭-তে।

ওই সময় জগন্নাথ কলেজ একটা গল্প লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আমার গল্পের নাম ছিল ‘জোনাকি ও সন্নিকট কেন্দ্র’। লেখাটা দ্বিতীয় হয়। ওই গল্প পরে কামাল বিন মাহতাব সম্পাদিত  ‘ছোটগল্প’ পত্রিকায় ছাপা হয়।’
বন্ধুত্ব বা আড্ডার আসরে ব্যক্তিগতভাবে শিল্পী বুলবুল চৌধুরীকে না চিনলেও সাহিত্য পাঠে আমি তাঁকে জানি ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকেই। পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে’ উপন্যাসটি পড়েছি একাধিকবার। প্রথম পড়া ক’ বছর আগে কোন এক ঈদ সংখ্যায়। সুখের সন্ধানে টালমাটাল নারীর জীবন কথার উপন্যাসটি সাবলীলভাবে উত্তম পুরুষে বর্ণিত। নিশিপুর রেল স্টেশনে ঢাকা যাত্রায় অপেক্ষমাণ শিক্ষক হিতেশ আচার্য।

কেন্দ্রীয় চরিত্র কান্নারত শিশু লক্ষ্মী হিতেশের পা জড়িয়ে ধরে। গৃহ আশ্রয় চায়। ঢাকায় না যেয়ে শিক্ষক বাড়ি ফিরে স্ত্রী যশোদা দেবীর হাতে লক্ষ্মীকে তুলে দেন। বলেন- ‘একে আমাদের সন্তানের মতো মানুষ কর যশোদা!’ দুই মেয়ে ও এক ছেলে থাকা সত্ত্বেও সংসারে বড় হতে থাকে লক্ষ্মী। বোনের মতো লক্ষ্মী পায় কৃত্তিকা ও মিনতি দেবীকে। শিক্ষকের ছোট মেয়ে মিনতির সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোয় লক্ষ্মী। যতই বড় হয় সে ততই তাঁর রূপ ঝিলিক মারে। লক্ষ্মীর জবানিতে অসংখ্য ঘটনার সমষ্টি এই উপন্যাস।

কাহিনীর পটভূমি প্রায় সবটায় বিষম রহস্যঘেরা! আদর ও মমতায় বেড়ে ওঠা সাত বছরের লক্ষ্মী বৃষ্টিমুখর এক দুপুরে পুকুরে ¯œানরত পালক মা বাবার চুম্বন দৃশ্য দেখে শারীরিক শিহরণ অনুভব করে! সেভাবে ‘বেশ তো বড় হয়েছি, তা না হলে শরীর এমন চমকে উঠবে কেন?’ ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় লক্ষ্মীমিনতিকে দেখেছে একসঙ্গে ৩ তরুণের সঙ্গে প্রেম করতে। তাতে প্রেমের জন্য তাঁর মন টলেনি। যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার পর যে ২ জন তরুণকে লক্ষ্মীর ভাল লেগেছে, নাগালের মধ্যে পেয়েও তাদের ওপর ঢলে পড়েনি সে। দুজনের মধ্যে ঘরে থাকা ভালবাসার পুরুষ শিক্ষক পুত্র ধীমানকে বহুবার একান্তে পেয়েছে সে।

পরিণয়ে মেনে নেবে না আচার্য পরিবারের কেউ। সম্মান রক্ষায় সে পথে যায়নি লক্ষ্মী। অথচ রূপোজীবী মেয়ে লক্ষ্মী অবশেষে দেহপসারিণী হলো কেন? পাঠক হিসেবে আমারও বড় এক জিজ্ঞাসা! প্রবাসে থাকা ৩ ভাইবোনের অনুপস্থিতিতে বৃদ্ধ মা-বাবার পালিত কন্যা লক্ষ্মীর হিতেশ ও যশোদার পছন্দের পাত্র বিভাস আচার্যের সঙ্গে বিয়ে হয়। কিন্তু লক্ষ্মীর বাসররাত বিভীষিকাময় হয়ে দেখা দেয়! উত্তম পুরুষে ব্যক্ত তাঁর বয়ান- আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল, একটা সরল অভাগিনীর অমঙ্গল-আশঙ্কায় আমি কাতর হয়ে পড়লাম।

স্বামীর শুধু বয়স বেশি নয়, সে শুধু মাদকাসক্ত নয়, বাসর রাতে সে শুধু জাগে না তাও নয়-সেপুরুষোচিতও নয়। সচেতন পাঠক হিসেবে যে কেউ লক্ষ্মীর স্খলনকে সমর্থন দেবে! লক্ষ্মীর ভরা যৌবনের দেহ রসায়ন বলে কথা! সে তো অর্থ লালসায় নয় বরং গিয়েছে যৌনতার ক্ষুধায়। উপন্যাসে লক্ষ্মীর বোধও তেমন দেখি আমরা। সে উপলব্ধি থেকে লক্ষ্মী বলে- ‘আমি নারী। আমি ফুরিয়ে যাইনি। ভরা যৌবনের সকল ঝলক আমাতে পুঞ্জীভূত আছে!

তাহলে স্বামীর ঘরে গিয়েও এভাবে নিজেকে কত বঞ্চিত রাখব? আমার শরীর কি গুমরে কাঁদে না? শ^শুরবাড়িতে কামকষ্টে কাতর প্রয়াত শ^শুরের বন্ধু বয়স্ক গৌর কিশোরের সঙ্গে লক্ষ্মীর শরীর সুখকে সমাজ ঘৃণ্য চোখে দেখলেও লেখকের মতো আমিও তা অস্বাভাবিক মনে করি না! শিশু লক্ষ্মীকে স্টেশনে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল। প্রায় ২ যুগ পর স্বামী খুন করে ফেলবে এই ভয়ে রূপোজীবী রূপসী লক্ষ্মী সে স্থানেই এসেই দাঁড়িয়েছে।
‘ইতু বৌদির ঘর’ উপন্যাসটিসেন নিবাসকে নিয়ে। মনোজগতের আলো-আঁধারি এবং মন বিনিময় এখানেই শুরু। উত্তম পুরুষ বুলবুল চৌধুরী চরিত্রে তাই ভিন্ন ধারা পরিলক্ষিত হতে দেখি। কারণ লেখক হয়ে ওঠার তীব্র আকাক্সক্ষা তিনি গোপন করেননি নিজেকে। অবলোকন করেন নির্লিপ্ততায় লেখক শেখ আবুল রায়হান ওমরকে। কেন আত্মহননই তাঁর জরুরী ছিল? পাশাপাশি দেখা হয় সেন নিবাসের উত্তরসূরি দেবাশীষকে, যে ভালবাসার মেয়ে মিতুয়ারী দাসকে নিয়ে পালাতে গিয়ে মাঝপথে পৌঁছে দেখে ‘ভুল মানুষ’ উঠে এসেছে গাড়িতে। এ যে প্রেমিকার যমজ বোন ইতুয়ারী দাস! রোমন্টিকতার কী অভিনব বিস্ময়!
বদলে যেতে থাকে দেবাশীষ। তাই  সেন নিবাসের পুত্রবধূ হিসেবে ইতু স্বীকৃতি ও মর্যাদা পেলেও অপ্রাপ্তির হাহাকার তাঁর দীর্ঘতর হয়। দ্বন্দ্ব জন্মায় তাঁর মধ্যে। তবু সে সাধন করতে চায় উত্তম পুরুষের হৃদয়। সরল স্বীকারোক্তিও অসামান্য কালো ওই বউটির কণ্ঠে  আকুতি- ‘পরজনমে তোমাকে চিনব কেমনে বুলবুলদা?’
২০১১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ব্র্যাক ব্যাংক ও সমকাল পুরস্কারপ্রাপ্তিতে কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরীর দায়িত্ব যেন বেড়ে যায়।
কর্কট রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই তিনি চেয়েছিলেন লেখালেখিতে অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করে যাবেন। চেয়েছেন আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিগদ্য আপননামা, মেঘমেদুর ছেলেবেলা, বাল্যবেলার সহপাঠী বন্ধু প্রয়াত কায়েস আহমেদ এবং ভাওয়াল রাজাকে নিয়ে লিখবেন। পুথিনিলয় এর স্বত্বাধিকারী প্রকাশক শ্যামল পালকে বুলবুল চৌধুরী সে পরিকল্পনার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু আর হলো না! যে আগস্ট মাসে তাঁর পৃথিবীতে প্রথম আলোর দৃষ্টি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দের সে মাসেই সৃজনশীল মানুষটির অমর্তলোকে যাত্রা! ভাবি রাষ্ট্র ও লেখক সমাজ স্বীকৃত এমন জীবনবাদী গদ্যশিল্পীর আয়ুষ্কাল ৭৩ বছর না হয়ে শতাধিক হলো না কেন?

×