কবিতায় নতুন স্বর
সাহিত্যের একাধিক মাধ্যমে যারা কাজ করেন সেসব লেখকের বেলায় দেখা যায় যে কোন একটি পরিচয়ে খ্যাতিমান হয়ে উঠলে তাদের অন্য পরিচয়গুলো সুবিচার পায় না। এটা আমাদের মতো গরিব দেশের সমস্যা। পশ্চিমে এসব নেই। রাজু আলাউদ্দিনের কবিতা নিয়ে লিখতে বসে শুরুতে আমার একথাই মনে এলো। অন্যূন পঁয়ত্রিশ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় রাজু মনস্বী প্রাবন্ধিক হিসেবে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এবং মাঝখানে জীবনের দীর্ঘ দশটি বছর বিদেশে বসবাসকালে, গবেষণার সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি থাকায়, তার ওই পরিচয়ে নতুন মাত্রা যোজিত হয়েছে।
ধারণা করি, বাংলাদেশের অগ্রসর সাহিত্য পাঠকমাত্রই এ বিষয়ে জ্ঞাত। কিন্তু অনেকেই এখনও যেটা জানেন না তা হচ্ছে, রাজু আলাউদ্দিন প্রথমত এবং মূলত একজন কবি। আমাদের অনেকেরই মতো আরও কবি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে আশির দশকের কোন এক সময়ে। মেক্সিকোয় পাড়ি দেয়ার আগ পর্যন্ত গদ্য রচনার পাশাপাশি তার কবিতাও ছাপা হতো নিয়মিত। অবশ্য একথা ঠিক, উত্তরকালে গদ্যচর্চার প্রাচুর্যের কারণে তার কার্যসাধনা খানিকটা ব্যাহত হয়েছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তিনি কবিসত্তাটি হারিয়ে ফেলেছেন।
সম্প্রতি রাজুর বেশ কিছু কবিতা পড়ে বোঝা গেল, তিনি ভেতরে ভেতরে কতটা পরিণত হয়েছেন আর কতখানিই বা বিবর্তিত হয়েছে তার কল্পনা ভাবনা প্রতিভা! এবং ‘আকাক্সক্ষার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি’ (২০১৭) নামের কাব্যগ্রন্থটি আদ্যোপান্ত পড়বার পর আমি রীতিমতো চমৎকৃত। আগা-গোড়া দু’বার নিবিড় পাঠের পর আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের অজস্র মাঝারি মানের কবিতাগ্রন্থের ভিড়ে এটি একটি নিঃসঙ্গ অত্যুজ্জ্বল গ্রন্থ।
আরও ভেবেছি, তার প্রবন্ধ বা ওই জাতীয় রচনা যে মান-এ পৌঁছেছে, তার সেরা কবিতাগুলোর মান তার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। পাঠকের সুবিধার্থে এখন আমি তার কয়েকটি কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেব-
১. সবুজে বিলীন হয় আমার আত্মার অভিসার/জীবনের পূর্বাপর জোনাক পোকার মতো জ্বলে আর নেভে
২. হও শান্ত স্থির আগুনের শিখা/যেন উপবিষ্ট গৌতম; দেখেছে যে মৃত্যুর ওপার/ধ্যানের পলিতে বোনো সৃষ্টির বীজ,/আগুনেরে করে তোল আলোর জননী
৩. নদীর সেতারে আমি একাকী ধ্বনিত হবো পৃথিবীর নিজস্ব গানে
৪. বহুদূরের আকাশ আসে ভেসে/কলকলিয়ে আমার উদ্দেশে/যেন গুণীর সুরের শুশ্রƒষায়/বিক্ষত এ জীবন প্রান্তর/জাগাতে চায় অগ্নি-পিপাসায়
৫. তোমার চুম্বনগুলো এই রাতে আয়াতের মতো ঝরে পড়ে/আমার শরীরে
৬. তবু প্রতি রাতে/সিসিফাস নিরবে একাকী/চাঁদের সাবান দিয়ে আমাদের/কদাকার দিনগুলি পরিষ্কার করে/পৃথিবীর ঘাসের উপর ছড়িয়ে দেয় শুকানোর জন্য...
‘আকাক্সক্ষার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি’-র কবিতাসমূহ গড়ে উঠেছে নানারকম বিষয় নিয়ে। কিন্তু দেশপ্রেম, প্রেম, প্রগতি ও ইতিহাস-চেতনা, আত্মপরিচয়, নিঃসঙ্গতা, মৃত্যুবোধ ঘরেফিরে এসেছে থিম হিসেবে। গ্রন্থে উচ্চমানসম্পন্ন কাব্য বেশ কটি আছে। ‘তুমি আমার পৃথিবী’ তেমনি একটি রচনা। আমার মনে হয়েছে, একবিংশ শতাব্দীতে দেশপ্রেম অবলম্বনে রচিত বিশ্বের সেরা কবিতাগুলোর একটি এই রচনা।
কবিতাটি শেষ হয়েছে এভাবে- ‘আমি যত দূরে যাই/আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।/বড় হতে হতে ক্রমে আমার নিকটে চলে আসে।/যখন নিকটে আসে, কানে কানে বলি তাকে :/যত ছোট মনে হয় তুমি তত ছোট নও, শোনো,/তুমি পৃথিবীর যে কোন দেশের মতো বড়,/তুমি এই পৃথিবীরই মতো,/তুমি আমার পৃথিবী।’
শেষ পঙ্ক্তি দুটি কবিতাটির ওজন বাড়াতে সাহায্য করেছে নিঃসন্দেহে। লেখক ভাগ্যবান।
অনেক বছরের প্রবাসী জীবন কাটাতে না পারলে তার পক্ষে এমন কবিতা লেখা সম্ভব হতো না। যদি আমরা গত একশ’ বছরের কবিতার চালচিত্র লক্ষ্য করি, দেখতে পাব, যত না বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশরীতির অভিনবত্ব আধুনিক কবিতাকে ঋদ্ধ করেছে। রাজু তার প্রেমের কবিতাগুলোতেও নিজত্বচিহ্নিত বাকভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন সাধ্যমতো- ক. আমি শুধু তোমার আননে/আমার আকাক্সক্ষার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি।/একান্তে পেয়েও আমি কোনদিন বলতে পারিনি:/তুমি ডুবো-পাহাড়ের মতো পরোক্ষ সমুদ্রের তলে বসে আছ। (ভালোবাসার ওক্সিসোরন)
খ. মেলাবো আজ তোমার একাকিতায়/এই আমাকে যে থাকে অন্তরে;/মহাকাশের গভীর মমতা। (তৃতীয় স্বর)
গ. অকস্মাৎ তুমি এই জালেম শাসিত পৃথিবীর/ আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে এসে নাজেল হয়েছ/ আমার মতন এক দীনহীন আশেকের কোমল হৃদয়ে।/সুতরাং অন্য কোন গ্রন্থ নয় প্রিয়তমা তুমিই আমার একমাত্র আসমানী কিতাব। (তুমিই আমার আসমানী কিতাব)
ঘ. সময় ছিল না বলে ভালোভাবে ভালোবাসা হলো না তোমাকে (সময় ছিল না)
অন্যদিকে কয়েকটি কবিতায় বাঙালী হিসেবে লেখকের আত্মপরিচয় ও মৃত্যুচেনতার প্রকাশ ঘটেছে একান্ত ভাবনিবিড় ভঙিতে। আর, তার মৃত্যুবোধকেন্দ্রিক কবিতায়, লক্ষ্য করছি, ভিন্নতর জীবনভাবনা যা একই সঙ্গে ব্যতিক্রমী উচ্চারণে বিশিষ্টও বটে-
১. পৃথিবীর সবগুলো সমুদ্র গান গায় আমার জাতীয় সঙ্গীত।/পৃথিবীর সকল সবুজ আর মরুতে অঙ্কিত আমার পতাকা/ পৃথিবীর চিরায়ু কবিতাগুলো আমার মাতৃভাষা। (আত্মপরিচয়)
২. এইসব মৃত্যুগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে প্রতিদিন।/আমার মৃত্যুগুলো জ্যামিতিকহারে ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে দেশে ও বিদেশে/আমার মৃত্যুগুলো ঘুমে ও নিদ্রায় আমাকে ক্লান্ত করে শুধু।/সুজলাসুফলা মৃত্যুতে ভরে গেছে আমার হৃদয়। (অসংখ্য মৃত্যু নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল)
সম্ভবত কবিতাই হচ্ছে সেই শিল্প মাধ্যম যা অনায়াসে সমস্ত মানববিদ্যাকে আত্মসাৎ করে নিতে পারে। দার্শনিকদের জীবনদর্শন বিশেষ ধরনের দর্শন। কিন্তু কবিতার মধ্যে যখন ‘দর্শন’ এসে যায় তাতে যুক্ত হয় অন্যরকম ব্যাঞ্জনা। তার কারণ, একজন কবির কাছে আছে জীবনানন্দকথিত ‘কল্পনাপ্রতিভা’ যা দার্শনিকের নেই। রাজুর কয়েকটি কবিতায় কবিসুলভ জীবনদর্শন দেখতে পাচ্ছি আমরা।
‘আলোকপ্রাপ্তির যুগ’ শিরোনামের কবিতায় তিনি বলছেন ‘মানুষের সকল উদ্যম/আলোর গরিমা নিয়ে চিরন্তন আঁধারের/পিছে ধেয়ে যায়।’ আবার ‘মাইগ্রেশন’ কবিতার একটি পঙ্ক্তি এরকম- ‘হয়তো কোন দেশ নেই মানুষের, আছে শুধু ঘর’।
দুই থেকে আট পঙ্ক্তি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বইয়ের গোটা দশেক কবিতা। এগুলোতে তার ভাব-কল্পনা অনেক বেশি সংহত। কবির সৃজনশীলতা তুঙ্গস্পর্শী হয়েছে ছোট কবিতাগুলোতেই। সে তুলনায় পুরো এক পৃষ্ঠা বা দেড়/দু’পৃষ্ঠাব্যাপী রচিত কবিতাসমূহে শিল্প সফলতা কম। ব্যতিক্রম ‘তুমি আমার পৃথিবী’, ‘মাইগ্রেশন’, ‘অসংখ্য মৃত্যু নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল’ এবং ‘অভিন্ন আলাদা’ নামধারী কবিতাগুলো। চার পঙ্ক্তিবিশিষ্ট দুটি কবিতা এখানে সম্পূর্ণ তুলে দিচ্ছি-
ক. গোলাপের পাঁপড়ির ভাঁজে ভাঁজে কার এই রক্তিম ছায়া?/স্তরে স্তরে গড়ে ওঠা একি শুধু আমারই করোটি?/করোটির ভিতরে যে পরিপক্ব লাল অন্ধকার/সেখানে কি পড়ে আছে আমার কঠিন পারাপার? (গোলাপ-করোটি)
খ. আমাদের আকরিক স্বপ্নের বিরুদ্ধে ওড়ে প্রতিদিন/আকাশের কালসিটে নীলসালু/নক্ষত্র জনগণ তার নীল কোমল শরীরে/আলপিনের মত লেগে আছে। (নীল সালু)
গ্রন্থভুক্ত ছত্রিশটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন বিনয় বর্মন। আমি দশ/বারোটি কবিতার ইংরেজি-রূপ পড়েছি। বিনয় নিজে কবি। যার ফলে অনুবাদ সাবলীল হয়েছে। অনুবাদক মুলানুগ যাকার চেষ্টা করেছেন তার সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে।
উরভভবৎবহঃ ধহফ নৎধাব ঢ়ড়বঃৎু শিরোনামের ভূমিকাটিতে কবি ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিক এক জায়গায় রাজুর কবিতা সম্বন্ধে বলেছেন His poetry nonetheless is Bangla poetry, emanating from the same river that Bangla poetry feeds on; he is just a different tributary. Rich and dynamic. Assets of our culture. আমি অকুণ্ঠচিত্তে তার সঙ্গে সহমত পোষণ করছি।
সত্যিই রাজুর আলাদা স্বাদের এইসব সাহসী কবিতা আমাদের সাহিত্যের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে। বহুপাঠে অভিজ্ঞ আর পৃথিবীর বহু ভাষার বিচিত্র ধরনের উন্নত কবিতা আস্বাদনে সমৃদ্ধ রাজু আলাউদ্দিন প্রমাণ করলেন, তিনি নিজেও তার প্রজন্মের গুটিকয়েক অগ্রসর কবিদের একজন। ‘অপরপ্রবণ’ শিরোনামের কবিতায় রাজু অকপটে বলেছেন ‘কেন মন মজে আছে অন্য কবির কবিতায়?’ তার এই উপলব্ধির সূত্র ধরে বলতে চাই, সম্প্রতি বাংলাসহ আরও কয়েকটি ভাষার যে অল্প কয়েকজন কবির কবিতা আমার বিশেষভাবে ভাল লেগেছে রাজু আলাউদ্দিন তাদেরই একজন।