ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

নাজনীন বেগম

বদরুদ্দীন উমর ॥ বর্ণাঢ্য জীবনগাথা

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১৩ মে ২০২২

বদরুদ্দীন উমর ॥ বর্ণাঢ্য জীবনগাথা

বদরুদ্দীন উমর এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে সুহৃদ সতীর্থদের হৃদয় নিঃসৃত অর্ঘ্য ‘বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কাজ’ স্মারক গ্রন্থটি প্রকাশ পায় ২০২২ সালের ভাষার মাসে। অসংখ্য দেশবরেণ্য প্রাজ্ঞজনের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার সম্ভার গ্রন্থটির সম্পাদনা পরিষদও বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব দ্বারা পরিবেষ্টিত। সম্পাদনা পরিষদে আছেন সি আর আবরার, গোলাম মোস্তফা, চৌধুরী মুফাদ আহমদ এবং উমর তারেক চৌধুরী। ‘বাঙালা গবেষণা প্রকাশনা’ কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। এই অসম সাহসী মননযোদ্ধাকে নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে জ্ঞানী-গুণী ও বিদগ্ধ জনেরা। নব্বই বছরের দীর্ঘ জীবন অতিক্রম করা এই অকুতোভয়, নির্ভীক কলম সেনানী আমাদের ঐতিহ্যিক ভাষা আন্দোলনের একজন প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা, অনমনীয় পর্যবেক্ষক এবং আদর্শিক ন্যায়নিষ্ঠতায় সমর্পিত এক লড়াকু জীবন সংগ্রামী। অর্থ, বিত্ত কিংবা যশ খ্যাতিকে দুরন্ত অভিগমনে ডিঙিয়ে সত্যবচনের দুঃসাহসিক ক্লান্তিহীন পথিক যে মাত্রায় সমাজ সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তা যেন সেই সময়ের এক অভাবনীয় কর্মোদ্দীপনা। কর্মবীর আর অক্লান্ত শক্তিময়তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে তার জ্ঞান ঐশ্বর্যের এক নির্মল ধারা। সবচাইতে উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনকে সম্মুখ সমরে যাচাই করতে গিয়ে আপন অভিজ্ঞতালব্ধ পা-িত্যে যেভাবে অনুধাবন করেছেন তা বাঙালীর অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ। বঙ্গীয় উচ্চবর্গের মুসলমানরা কোনভাবেই বাঙালীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে এক হতে পারেনি। আর সেই কারণে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব নবসৃষ্ট পাকিস্তানের জন্য কতখানি প্রাসঙ্গিক ছিল সেটাই এই মননশিল্পীর ক্ষুরধার কলমে শাণিত হতেও সময় লাগেনি। নির্দ্বিধায়, অকুণ্ঠচিত্তে, দুঃসাহসিক মনোবলে বলতে ভাবতেও হয়নি- ‘ভাষা আন্দোলন বাংলার মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংগ্রাম। যারা এতদিন নিজ দেশে পরবাসী হয়েছিল। এই বিজ্ঞ শৈল্পিক বোদ্ধাকে নিয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা। খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদসহ আরও অনেকে। স্বল্প সময়ে সব কিছু বলার অবকাশও থাকে না। বরং বিশিষ্ট এই ব্যক্তিত্বের জীবনালেখ্যের আলোকিত পর্যায় নির্দেশিত করাও এক আবশ্যিক দায়বদ্ধতা। আর তিনি যদি পরিচিতও জানা শিক্ষাবিদ হয়ে থাকেন। ১৯৩১ সালে বর্ধমানে জন্ম নেওয়া বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম এই অঞ্চলের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় সংগঠক ছিলেন। সঙ্গতকারণে পুত্র উমরের মধ্যে শৈশবকাল থেকেই স্বাধীনতা এবং ন্যায়নিষ্ঠতার বীজ উপ্ত হতে সময় লাগেনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পিতা-পুত্রের সম্পৃক্ততা বাংলার ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল পর্ব। কারণ আমরা দেখি আন্দোলন পরবর্তীতে মাতৃভাষাকে আপন শৌর্যে বিচার বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে কি অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি আর পদ্ধতিগত উপকরণ সঙ্গে অক্লান্ত শ্রমে গবেষণায় নিজেকে সমর্পণ করেন। যেখানে শুধু আর্থসামাজিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণই শুধু নয় শেকড়ে গ্রথিত সংস্কারের মর্মমূলকেও অনুধাবনে নিজের সর্বশক্তি ও জ্ঞান উজাড় করে দেন। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পকে ভেতর থেকে উৎপাটনের যে অভিঘাতে নেমেছিলেন সেখানেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। জ্ঞানের সম্মিলিত আধারের এই প্রাজ্ঞজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান শেষ অবধি সমাজ বিজ্ঞান বিভাগেও সচেতন দায়বদ্ধতায় শিক্ষকতার নজির উপস্থাপন করেছিলেন। নব্বই স্পর্শ করার শুভক্ষণে তাঁর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা এবং প্রাণঢালা অভিনন্দনে অভিষিক্ত করলাম এমন বরেণ্য জ্ঞান তাপসকে। গ্রন্থটি বিদগ্ধসমাজই শুধু নয়, উদীয়মান প্রজন্মের জন্যও এক বিশিষ্ট উপহার। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার বিশ্লেষণে বদরুদ্দিন উমরের যে অনমনীয় দৃঢ়তা, আদর্শিক লড়াই এবং সাংস্কৃতিক শক্তিময়তা যে মাত্রায় পাঠকের সামনে হাজির হয় তা যেন এক নজরে সার্বিক বাংলাদেশের অনন্য চিত্র। সম্পাদকম-লী ও প্রকাশককে অশেষ কৃতজ্ঞতা এমন একটি মূল্যবান বই পাঠক সমাজকে নিবেদন করায়। বদরুদ্দিন উমরের দীর্ঘায়ু এবং বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
×