ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

ইলিয়াস বাবর

‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’

ইতিহাসের ইতিবাচক প্রেক্ষাপটে যে কোন সময়ে প্রথম হওয়াটা চ্যালেঞ্জমুখর। পূর্বসূরিদের কাজ ও ভবিষ্যতের অনির্ণেয় সময়গুলো তখন বার বার আক্রমণ করে, টলাতে চায়। বাঙালী জাতির দীর্ঘ ও ঝঞ্ঝামুখর ইতিহাসে আমরা সাক্ষ্য পাই নানা কিছিমের কাজেরÑ কাজের সঙ্গে সময় ও স্বভাবের। কিন্তু প্রথম হওয়াটাকেÑ হোক তা মাঝারি মানের কিংবা সময়ের চেয়ে পিছিয়ে তবুও তাতে আবেগ আর বিশ্বাসের মাখামাখি থাকে। সমুখের পথ নির্মাণে, পথের দিশা দেখাতে এবং বহুকাল পরেও দিকভোলাদের, রবীন্দ্রনাথের মতে, আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচাতে উদাহরণ হিসেবে আনতে হয় ওই প্রাতঃস্মরণীয় প্রথম কাজটিকে। তাতে মনের খচখচানি দূর হয় সহজে, অনুপ্রেরণা আর আশাবাদী হওয়ার উপলক্ষ তো আছেই। আমরা অনেকেই চর্যাপদ হয়ত পড়ে দেখিনি, পরীক্ষায় পাসের জন্য কিংবা দরকারে যদ্দুর পড়া দরকার ঠিক তদ্দুরই, তবুুও বাংলা ভাষার ইতিহাস চর্চার কথা আসলে অথবা বিবর্তনমান সময়কে ইঙ্গিত দিতে হলেও চর্যাপদের নাম মুখে নেই, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে সালাম ঠুকে। ইতিহাসে প্রথম হওয়া এ এক সৌভাগ্য; কখনও কখনও প্রথমটা ভেস্তে যায় দুর্মুখোদের খেয়ালের দরুন, দেশ ও সময়-বিরোধী হওয়ার কারণে। নানা শাসন, শোষণ এবং চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ যেন বা একটি আদর্শ জীবন সংগ্রামের নমুনা! সুকান্ত ভট্টাচার্য্যরে ‘দুর্মর’ কবিতার অমর চারটি লাইন সমুখে রেখে পর্যালোচনায় বসলে অবশ্য আমাদের খানিক সুবিধা হয়Ñ ‘শাবাশ, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়ঃ/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ শোষিত হতে হতে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার ঠিক আগেই বাঙালী জেগে উঠেছেÑ ইতিহাসের পাতায় পাতায় তার নমুনা দৃশ্যমান। ভাষার দাবিতে, দেশের দাবিতে, গণতন্ত্রের দাবিতে কিংবা কুলঙ্গারদের বিচারের দাবিতে বার বার সোচ্চার হয়েছে এদেশের গণমানুষ। বুকের তাজা খুনে বাংলাকে মাতৃভাষা মর্যাদায় আসিন করেছে বিরল ইতিহাস সৃষ্টি করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তো মহাকাব্যিক ইতিহাস। এখানেও বাঙালীরা বিজয় ছিনিয়ে আনে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েÑ যাদের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য মোড়ল পরাশক্তিও। কিন্তু ন্যায়যুদ্ধে, ভূগোলকে নিজেদের করে নেয়ার হিসাবে, নিজেদের পতাকা ও মানচিত্রকে চিহ্নিত করার লৌহকঠিন শপথে বাঙালি জয় এনেছে নয়মাসের রক্তনদী পেরিয়ে। বাঙালির সবচে গৌরবময় এ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া মহান পুরুষকে একাত্তরের কিছুদিন পরেই প্রাণ দিতে হয় বাঙালিদের হাতে! দুঃখজনক হলেও সত্য, জনকের শাহাদাতের পর তাকে নিয়ে কথা বলা, তার নামে স্লোগান দেয়া কিংবা অন্যান্য সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকা- একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। জনকের দেয়া দেশে, জনকেরই নুন খাওয়া কতিপয় বিপথগামী কুলঙ্গারদের সার্বক্ষণিক চোরা-নজরদারির ভেতরেও কেউ এগিয়ে এসেছেন ইতিহাস সৃষ্টি করতে, পিতা হত্যার বিচার চাইতে, কেউবা আত্মগোপন করলেন প্রতিবেশী দেশে। আকালের ভেতরে, অন্ধকারের অমানিশায় কতিপয় সাহসী সন্তান ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সূর্য তরুণ গোষ্ঠী প্রকাশ করে ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রকাশিত এ কবিতা সঙ্কলনের সঙ্গে ফারাক রয়েছে আমাদের অন্যান্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত প্রথম সংকলনগুলোর। একুশের প্রথম সংকলন হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কিংবা আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গল্প সঙ্কলন ‘বাংলাদেশ কথা কয়’র সঙ্গে ‘এ লাশ রাখব কোথায়’-এর ফারাক উদ্ধারে আমাদের প্রত্যেকটি সঙ্কলন প্রকাশের সময়ে ফিরে যেতে হয়। ভাষা আন্দোলনের সময় দেশ স্বাধীনের কথা সেভাবে উচ্চারিত হয়নি, ফলে সেই সময়ের লেখকেরা কিংবা সাহিত্যকর্মীদের মাথায় পরাধীন দেশের নাগরিক ভাবনাটা না-আসাই স্বাভাবিকÑ তারা প্রতিকূল পরিবেশে হলেও কাজ করেছেন উদ্যমে, হৃদয়ের গভীরতম আবেদনে। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র বুক তাই তাই রক্তে ¯œাত হলেও ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার গৌরবে ছিল উজ্জ্বল। ‘বাংলাদেশ কথা কয়’ প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়েই, প্রতিবেশী দেশ থেকে। উদ্ধাস্তু একটা ভাব আমাদের লেখককুলে ছিল তখন, বিশেষত যারা অগ্নিগর্ভ সময়ে ভারতের আশ্রয়ে ছিলেন। নতুন দেশ পাওয়ার অভিপ্রায়, রক্তের ভেতর দিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের বোধ ও বিশ্বাসকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, কেউবা কলম ফেলে ধরেছিলেন অস্ত্র। ফলত, ‘বাংলাদেশ কথা কয়’ প্রকাশের প্রেক্ষাপট একেবারেই অভূতপূর্ব। কিন্তু ‘এ লাশ রাখব কোথায়’? পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে কার্যত সাংস্কৃতিক অন্ধসময়ই অতিবাহিত হচ্ছিল সেনাচাউনি আর স্বৈরশাসকের ইচ্ছায়। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে এদেশের গণমানুষ তখন প্রায় বোবা, আবেগ আর কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে অচিন্তনীয় এক পরিস্থিতি যেন গ্রাস করে যাচ্ছিল যাবতীয় সুন্দর ও সুকুমার কর্মকা-কে। স্বাভাবিকভাবেই, ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’-এর সময় আবেগ আর কান্নার মিশেল ছিল, উদ্যম তো ছিলই না, কেবলই বুকের ভেতর জ্বলেছিল আগুনÑ এই আগুন নিয়ে স্বৈরশাসনের ভেতর সৃজনশীল কাজ করাটা ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য তরুণ গোষ্ঠী এই মহান ও স্মরণীয় কাজটি করেছিল অশ্রু আর রক্তের শপথ নিয়ে, পিতাকে স্মরণ করে, জ্বলজ্যান্ত মীরজাফরিপনাকে পেছনে পেলে। এখানেই মূলত ইতিহাসের অন্যান্য মহৎ সঙ্কলনগুলোর সঙ্গে ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’-এর ব্যবধান। মোট ত্রিশটি ছড়া-কবিতায় ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’-এর শরীর ভরা। নির্দিষ্ট বিষয়Ñ বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে ত্রিশ লেখকই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন নিজেদের পর্যবেক্ষণ-বিশ্বাস-দর্শন। সময়ের দাবি মিটিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শাশ্বত মন্তব্য দিয়েছেন, হৃদয়ের আকুতি পেশ করেছেন, বঙ্গদেশের দেশপ্রেমিক সন্তানদের আহাজারিকে সামনে আনার প্রয়াস চালিয়েছেন। এখানে আমাদের প্রচলিত সাহিত্যচর্চার ধরনের সাথেও যোজন দূরত্ব বিরাজ করে এই অর্থেÑ সঙ্কলভুক্ত লেখকদের সামনে ছিল না অনুকরণের সুযোগ, ছিল না চর্বিত-চর্বনের সুবিধা, ফলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মৌলিক লেখায় ভাস্বর ছিল ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’। ঋতুভিত্তিক কোন সঙ্কলন হলে কিংবা পার্থিবের হাজার সোনাদানার কোন একটা টুকরো নিয়ে হলে চট করে লেখা যেত যে কোন কিছু। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে? তা ছাড়া দেশ স্বাধীনের কিছুকাল পরেই একজন পিতা, একজন নেতা এভাবে শাহাদাত বরণ করতে পারেন, তারই সন্তানদের হাতেÑ যাদের প্রতি কি না জনকের ছিল অগাধ বিশ্বাস। অকল্পনীয় পরিস্থিতি, নিদারুণ শোক আর শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে লেখকদের বসতে হয়েছিল লেখার টেবিলে। এমন বেদনাবহ সময়ে পিতাকে নিয়ে লেখাÑ সঙ্কলন করাÑ তারুণ্যের অমৃতশক্তি বলেই সম্ভব হয়েছিল সূর্য তরুণ গোষ্ঠীর। সঙ্কলনের প্রথম লেখা অন্নদাশংকর রায়ের বিখ্যাত লেখাটি দিয়েÑ ‘যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরী যমুন বহমান/ তত দিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবর রহমান।/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্ত গঙ্গা বহমান/ নাই নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় মুজিবর রহমান।’ লেখার সত্য, সৃজনকারের কল্পনার সত্যকে সত্য প্রমাণ করে আমরা দেখতে পাই ইতিহাসের চক্রমান সময়ে একদা বিচার হয় জনকহত্যাকারী কুলাঙ্গারদের। এবং যারা চেয়েছিল জনকের চিহ্ন মুছে দিতে, যারা সপরিবারে নির্বংশ করতে চেয়েছিল জনকের রক্তকে তারা ভুল প্রমাণ হয়েছে। মিথ্যার বেসাতি তারা উড়াতে চেয়েছিল বটে, সাময়িক অট্টহাসি তাদের পরাজিত হয়েছে সত্যের কাছে, গণমানুষের আর্তির কাছে। সঙ্কলনের পরের লেখাটিতেই দিলওয়ার যেন এ কথাটিরই প্রতিধ্বনি করেন এভাবেÑ ‘নয় জনতা হারামখোর/ বলরে খুনী, আরাম তোরÑ/ রাখবি এবার কোন জালায়?/ দেখনা ওরা বাণ চালায়।/ বঙ্গবন্ধু আট কোটি/ খুলবে এবার দাঁত ক’টি।’ বলাবাহুল্য বাংলাদেশের জনসংখ্যা আট কোটির দ্বিগুণের বেশি হয়ে, কঠিন স্বরে-সংগ্রামে পিতার হন্তারকদের দাঁত ক’টি তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিচার হয়েছে জানোয়ারদের। পিতা মুজিব বারবার জিতে গেছেন সন্তানদের ন্যায়যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে। আজকে টুঙ্গিপাড়ায় পিতা শুয়ে থেকেও মিশে আছেন বাংলার ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে। বাংলাদেশের যে কোন অর্জনে, সন্তানদের যে কোন গৌরবে পিতা মিটিমিটি হাসেন টুঙ্গিপাড়া হয়ে সারাদেশে। এদেশের সব সড়ক মিশে গেছে টুঙ্গিপাড়ায়, ন্যায়যুদ্ধ আর আলোটুকু মিলে গেছে টুঙ্গিপাড়ার শেখবাড়িতে। ঋতুবৈচিত্র্যের এদেশে, নানা রঙের এদেশে বঙ্গবন্ধু মিশে আছেন তার সবটুকু হৃদয় দিয়ে। ‘বকুল গন্ধ বাঘের চোখে’ নামক লেখায় মাহমুদুল হক লেখেনÑ ‘ঘুমিয়ে আছে ঝিল্লিরবে/ বকুল গন্ধে মাছের চোখে,/ ঘুমিয়ে আছে ঘাসের বুকে/ ধুলায় ধূসর মায়ের কোলে;/ জেগে থাকে বাঘের চোখে/ লক্ষ মুজিব দামাল ছেলে/ জেগে থাকে ধানের খেতে/ ঘূর্ণিঝড়ে বানের জলে।’ সরলতার সবটুকু আবেশ দিয়ে তিনি থাকেন পিতার বিশাল হৃদয় নিয়ে, দুর্দিনে-দুশ্চিন্তায় তিনি থাকেন তার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে, নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে। এ বাংলার প্রতিটি ইঞ্চিতে পিতা থাকেন সতেজ-সজাগ। ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’ এর ঐতিহাসিক মূল্য বিপুল। আমাদের এই রুচিহীন সময়ে, গলাবাজি আর ডিগবাজির সময়ে বঙ্গবন্ধু চর্চায় এ সঙ্কলনটির আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতা অপরিসীম। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, পঁচাত্তর পরবর্তী দুঃসময়ে এবং আজকের যে কোন চরম সঙ্কটে মেধার যুদ্ধের পরিবর্তে অস্ত্রের ঝনঝনানি, কবিতার বদলে কথার বাহাস, গোলাপের স্থানে কাঁটাদের আস্ফালন দৃশ্যমান হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর দুটো আত্মজীবনী, তাকে নিয়ে বহু সঙ্কলন-গবেষণা গ্রন্থের ভেতরেও ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’-এর স্থান অনন্য। প্রথম হবার গৌরবে সিক্ত এ সঙ্কলন, প্রতিকূল সময়ে ভালবাসার নমুনা এ সঙ্কলন, দুরন্ত সাহস আর বুদ্ধিভিত্তিক প্রতিবাদের চিহ্ন এ সঙ্কল্প প্রকাশে জড়িত বীরদের, লেখকদের জন্য অফুরান শ্রদ্ধা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধুকে শোকাবহ আগস্টে হৃদয়ের গভীর সালাম ও শ্রদ্ধা।
×