ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির কোলে স্বর্গীয় অনুভব:খৈয়াছড়া ভ্রুমণ

হাবিবুর রহমান সুজন,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার,সাজেক,রাঙামাটি

প্রকাশিত: ১৯:১৫, ৪ জুলাই ২০২৫

মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির কোলে স্বর্গীয় অনুভব:খৈয়াছড়া ভ্রুমণ

খৈয়াছড়া ঝর্ণা যেন প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা অপরূপ এক ছবি। এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ ভ্রমণপিয়াসীরা।
জানালার বাইরে ভেসে চলা চা-বাগানের বাতাসের ঢেউ, অন্ধকারাচ্ছন্ন কুয়াশায় মোড়া সবুজ পথ আর ছায়াময় বনভূমি যেন আমায় আগেই খৈয়াছড়ার গহীনে নিয়ে যেতে চাইছিল। এই নীরব প্রস্তুতিই বলে দিচ্ছিল, সামনে অপেক্ষা করছে এক দারুণ অ্যাডভেঞ্চার।

 কুশল বিনিময় করে উষ্ণ অভ্যর্থনার পর স্থানীয় রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা খেয়ে সেখান থেকে বাসে চড়ে যাত্রা মীরসরাইয়ের দিকে, যেন প্রকৃতির কোলে ফিরে যাবার এক নীরব প্রস্তুতি। ৪০ মিনিট পর মীরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারের আগে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের কাছে পৌঁছে সিএনজিতে করে ছুটলাম সেই স্বপ্নীল গন্তব্যের দিকে, যার নাম শুনলেই ট্রেকিংপ্রেমীদের চোখে চমক জ্বলে ওঠে—খৈয়াছড়া জলপ্রপাত। আকার, আকৃতি ও গঠনশৈলির দিক দিয়ে এটি নিঃসন্দেহে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং মনোমুগ্ধকর ঝর্ণাগুলোর একটি। শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে সবুজের নিবিড় আলিঙ্গনে হারিয়ে যাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পৌঁছালাম খৈয়াছড়ার প্রবেশপথে।

খৈয়াছড়া, নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজে ঘেরা পাহাড় আর ঝিরিঝিরি জলের অবিরাম ধারা। এখানে পা রাখা মাত্রই যেন প্রাণ জুড়িয়ে গেল স্নিগ্ধ পাহাড়ি বাতাসে। চারপাশের নিস্তব্ধতা আর পাখির সুমধুর কলতান এক অন্যরকম পবিত্রতার অনুভূতি এনে দিল। ঘন জঙ্গল, আকাশছোঁয়া বিশাল বৃক্ষরাজি আর অজস্র লতাপাতা যেন এক সবুজ গালিচায় ঢেকে রেখেছে চারপাশ। সিএনজি থেকে নেমে যখন ঝিরিপথের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম, তখন থেকেই রোমাঞ্চের শুরু। এটি কোনো মসৃণ পথ নয়, বরং পুরোটাই পাথুরে আর আঁকাবাঁকা। কোথাও পিচ্ছিল কাদা, কোথাও হাঁটু অবধি শীতল জল, আবার কোথাও বিশাল পাথরের চাই ডিঙিয়ে যেতে হচ্ছিল। এ যেন এক অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি, যা মনকে আরও বেশি উত্তেজিত করে তুলছিল।

কিছুক্ষণ পর এই ট্রেকিং পথেই দেখা মিলেছে প্রকৃতির অপার বিস্ময়। অসংখ্য পশু-পাখির দল গাছের ডালে ডালে চঞ্চলভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ছুটোছুটি আর দুষ্টুমি দেখে মনটা আরও সতেজ হয়ে উঠল। পথের দু’ধারে বুনোফুলের সমারোহ আর অচেনা সব পাখির কিচিরমিচির শব্দ যেন মনে এক দারুণ ছন্দ তৈরি করছিল। খৈয়াছড়া ঝর্ণার মূল রূপে পৌঁছানোর আগে অতিক্রম করতে হয় ৯টি ধাপ। প্রতিটি ধাপেই প্রকৃতির এক নতুন, সতেজ এবং আরও মুগ্ধকর রূপের দেখা মেলে। ছোট ছোট ঝর্ণার ধারাগুলো যেন একেকটি শিল্পকর্ম, পাথরের গা বেয়ে নেমে আসা জলের শব্দ কানে এক মধুর সুরের মতো বাজছিল। অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ, যা বাংলাদেশের আর কোন ঝর্ণাতে এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। তাই ‘খৈয়াছড়া’-কে বলা হয় বাংলাদেশের ‘ঝর্ণা রাণী‘।

বলে রাখা ভালো, ভেতরে ঢোকার আগে অনেকগুলো দোকান আছে। সেখানে ছোট একটা ব্যাগ ছাড়া বাকি সবকিছু আমরা দোকানির কাছে জমা রেখে গিয়েছিলাম। সেখানে আবার গোসলেরও সুব্যবস্থা আছে। তাছাড়া দোকানগুলোতে অগ্রিম খাবারের অর্ডার করে রেখে যেতে হয়, রেডিমেড খাবার পাওয়া যায় না। আমরাও দুপুরের খাবার অর্ডার করে ঝিরিপথ, গিরিপথ ও পাহাড়ে বেয়ে ওঠার জন্য ২০ টাকা করে কয়েকটি ৫-৬ ফুট লম্বা চিকন ছোট্ট বাঁশ কিনলাম এবং পায়ে পরার জন্য ১০ টাকা দামের এক জোড়া হেলমেট জাতীয় চটি কিনলাম, যাতে পিচ্ছিল জায়গায় সহজে পা দিয়ে পার হওয়া যায়। এই সামান্য প্রস্তুতিই আমাদের কঠিন পথের পাথেয় হয়ে উঠল।

ছবিতে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, একটি বিশাল সবুজ শেওলায় ঢাকা পাথরের উপর বসে আমি প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছি। আমার পেছনে সবুজের প্রাচুর্য আর নিচে শান্ত জলরাশি – এ যেন প্রকৃতির বুকে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। এখানকার জল এতই স্বচ্ছ আর শীতল যে, মুহূর্তেই ভ্রমণের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এখানে এসে এক দিনের জন্য হলেও প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে দেয় পর্যটকদের জন্য। উল্লেখ, অসাধারণ ছবিটি তুলেছে তানিম।

কথিত আছে, শত বছর ধরে এই ঝর্ণা তার আপন গতিতে বয়ে চলেছে, মানুষের অগোচরেই সে তার সৌন্দর্য মেলে ধরেছিল। মনে হয় যেন কেউ তার নিজ হাতে এতো সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গা পর্যটকদের জন্য বানিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ সরকার এই অঞ্চলটিকে ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্পের আওতায় এনে এর সংরক্ষণ ও পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে কিছুটা বটে তবে প্রকৃতির নিজস্বতা অক্ষুণ্ণ রয়েছে এখনো।

আমাদের অভিযাত্রার সত্যিকারের পরীক্ষা শুরু হলো যখন আমরা প্রথম ধাপটি পেরিয়ে উপরে ওঠার জন্য প্রস্তুত হলাম। কেবল লাঠির সাহায্যেই নয়, কোথাও কোথাও খাড়া পাথরের গা বেয়ে রশি ধরে উপরে উঠতে হয়েছে। প্রতিটি ধাপ ছিল যেন এক একটি চ্যালেঞ্জ, তবে প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আর শীতল বাতাস ও জলের হাতছানি আমাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছিল। আমার সাহস জুগিয়েছিল ভাবি (নাসিফ ভাইয়ের ওয়াইফ), যিনি মেয়ে হয়েও এতো সাহস দেখিয়েছেন যা আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। একটু ভুল হলেই নিচে পরে গেলে মারাত্মক দুর্ঘটনা, পরিস্থিতি এমনই ছিল। নিচে তাকাতে রীতিমতো ভয় লেগেছিল, যেন অতল গহ্বর হাতছানি দিচ্ছে। তবু পাহাড়ের বুক চিরে সাদা ফেনার মতো জলধারা নেমে আসছে অবিরাম, সেই দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝা কঠিন। প্রতিটি ধাপে কিছুক্ষণ থেমে প্রকৃতির রূপসুধা পান করতে ইচ্ছে করে।

অবশেষে যখন শীর্ষের দিকে পৌঁছালাম, তখন শরীর ছিল পুরোপুরি ক্লান্ত। প্রতিটি পেশী যেন বিদ্রোহ করছিল। তবে এতটুকু উচ্চতায় উঠে আসাটাই যেন এক বিশাল জয়, এক অসাধারণ প্রাপ্তি। চূড়ায় পৌঁছে কিছুক্ষণ শুয়েই বিশ্রাম নিলাম, প্রাণভরে ঝর্ণার স্ফটিক শীতল জলে গোসল করলাম এবং ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করলাম এই অপূর্ব দৃশ্যাবলি।

যখন প্রকৃতির এই রূপসুধা পান করে, প্রতিটি ধাপের সৌন্দর্য উপভোগ করে আবার নিচে নামতে শুরু করলাম, তখন ঘড়িতে ১১টা বেজে গেছে। সকাল ৭টায় শুরু হওয়া আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চার প্রায় চার ঘন্টারও বেশি সময় ধরে আমাদের অসাধারণ প্রকৃতির মাঝে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিল। নামার পথটাও ছিল সমান চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু ফেরার পথে কলা ও লেবুর শরবতের স্বাদ ছিল অমৃতের মতো! এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে, উপরে শুয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিতে হয়েছিল, এমনকি নিচের দোকানের বেঞ্চে বসার বদলে শরীর এলিয়ে শুয়েই পড়তে হলো! ক্লান্তির এমন অনুভূতি সচরাচর হয় না, কিন্তু সেই ক্লান্তিও যেন আনন্দের অংশ হয়ে গিয়েছিল।

অবশেষে আমাদের প্রধান হোটেলে ফিরে এসে স্নিগ্ধ জলে গোসল করে শরীর জুড়ালাম। ক্লান্তির ভারে ফোন চার্জে দিয়ে যখন দুপুরের খাবার খেলাম, তখন খাবারের মান ছিল অভাবনীয়! যা আশা করিনি, তার চেয়েও বেশি সুস্বাদু খাবার আর আতিথেয়তায় হোটেলের কর্মীরা ছিল দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ। পেট ভরে খেয়ে, দীর্ঘক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, আর গল্পগুজব করে যখন দুপুর ২টার দিকে আবার বের হলাম, তখন শরীরের সব ক্লান্তি যেন উধাও।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল মনোমুগ্ধকর বাওয়াছড়া লেক। সেখানে নৌকা ভ্রমণ করে লেকের শান্ত জলে ভেসে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল এক ভিন্নরকম প্রশান্তি। সবুজ পাহাড়ের মাঝে লেকের স্বচ্ছ জল, আর তার উপর দিয়ে ভেসে চলা নৌকা – সব মিলিয়ে এক স্বপ্নময় দৃশ্য। সূর্যাস্তের আলোয় বাওয়াছড়ার সৌন্দর্য আরও মায়াবী হয়ে উঠেছিল।

এক দিনের এই ছোট্ট ভ্রমণ আমার স্মৃতিতে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে গেল। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এই অভিজ্ঞতা সত্যিই অসাধারণ। এই নীরব সৌন্দর্য, এই স্নিগ্ধ বাতাস আর জলের অবিরাম গর্জন  সব মিলিয়ে এক অন্য জগৎ। যারা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন এবং প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে চান, তাদের জন্য খৈয়াছড়া একটি আদর্শ গন্তব্য। সবুজের মাঝে শীতল জলের পরশ আর পাখির গানের মূর্ছনা – এ যেন এক অন্য জগৎ, যেখানে মনের সব ক্লান্তি ধুয়ে যায় নিমিষেই। আমি নিশ্চিত, এই রূপের রাণী খৈয়াছড়া সকলের মন ছুঁয়ে যাবে এবং বারবার ফিরে আসার অনুপ্রেরণা জোগাবে। প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ আমাদের সকলেরই যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা উচিত, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এর অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।

Jahan

×