![জীবন সঙ্গিনী বাছাইয়ে বউমেলা জীবন সঙ্গিনী বাছাইয়ে বউমেলা](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023May/Oparajita-3-2312071936.jpg)
জীবন সঙ্গিনী বাছাইয়ে বউমেলা
দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর হাজারো লোকজন। নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, নওগাঁ জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।
মূলত বর-কনে পছন্দের জন্য মেলায় ভিড় জমায় তারা। সঙ্গে অন্য অভিভাবকরাও থাকেন। বাদ্য-বাজনার মাতাল হাওয়ায় নাচের তালে চলে বউ বাছাইয়ের উৎসব। মাদলের তালে ভাটা পড়ে না পছন্দের মানুষকে খোঁজার কাজটি। এ উৎসব শুধু নৃ-গোষ্ঠীর কিছু মানুষকেই আনন্দ দেয় না। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও আসে আনন্দে শরিক হতে। পরিণত হয় মিলনমেলায়। বার্ষিক এ মেলার সঙ্গে পরিচিত সেখানকার মানুষ। আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাদের জীবনমান, খাদ্য, ভাষা, কৃষ্টি-কালচারে পরিবর্তন এলেও ঐতিহ্য হারায়নি কয়েক শ’ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বউমেলার আকর্ষণ।
প্রথাগত কারণে নিজ গোত্রের মধ্যে বিয়ের রেওয়াজ নেই আদিবাসী সাঁওতাল এবং ওড়াও সম্প্রদায়ের। হাঁসদার সঙ্গে হাঁসদা, মার্ডির সঙ্গে মার্ডি অথবা কিস্কুর সঙ্গে কিস্কু সম্প্রদায়ের বিয়ে হয় না। এমন টাইটেল ওড়াওদের আছে ২৫ থেকে ৩০টি এবং সাঁওতালদের ৫০ থেকে ৬০টির মতো। পাত্র-পাত্রী ভুল করে অথবা ভালোবেসে হৃদয়ের টানে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কাউকে বিয়ে করলে তাদের এলাকা ছাড়তে হয়। করা হয় সমাজচ্যুত। অবশ্য পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় এসবেও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া।
কত শত বছর আগে এ বউ মেলার শুরু তা বলতে পারেননি এলাকার মানুষ। কম জনবসতির এ অঞ্চল ছিল বন-বাদাড়ে ভরা। এসব বনে বাস করত আদিবাসী সাঁওতাল ওড়াও মাহালিসহ বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন। গভীর বনে কারও সঙ্গে তেমন যোগাযোগ বা দেখা-সাক্ষাৎ হতো না তাদের।
আদিবাসী সাঁওতাল এবং ওড়াও সম্প্রদায়ের লোকেরা জীবনসঙ্গী বেছে নেন কয়েকটি উপায়ে। ১. সরাসরি বেছে নেওয়া এবং প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে; ২. পছন্দের পাত্রীর শরীরে সিঁদুর ছিটিয়ে দিয়ে (এটা অন্যতম জটিল একটি কাজ); সিঁদুর না থাকলে ধুলামাটি ছিটিয়ে দিলে ওই পাত্রীকে আর কেউ বিয়ে করতে পারে না। এ নিয়ে রয়েছে নানান বিধিবিধান।
মেলায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়াও হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি ছিল বেশ। এর ফলে, পুরো এলাকার আশপাশে প্রচুর মানুষের সমাগম লক্ষ্য করা যায়।
হাজার হাজার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ উপস্থিত হন। সেখানে বাজনার তালে তালে একক ও দলগতভাবে পরিবেশন করা হয় তাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গান। আর অন্য পাশে চলে তরুণ-তরুণীদের পছন্দের জীবনসঙ্গী বাছাই চলে।
২০১২ সালে অনুষ্ঠিত এমন মেলার মাধ্যমে যাদের বিয়ে হয়েছিল এমন দম্পত্তিকে দেখা গেছে এই মেলায়। তারা তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে মেলার আনন্দ উৎসবে অংশ নেয়। লদীকি টুডু নামে এক নারী বলেন, মেলায় বাচ্চাদের নিয়ে এসেছি। অনেক কিছু খেলাম, আনন্দ করলাম। পূজার পর প্রতি বছর মেলাটি বসে। অনেক আনন্দের মধ্য দিয়ে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আবার শেষ হলে মন খারাপ হয়। বেঁচে থাকলে আবার আসব। এই মেলা আমাদের সংস্কৃতির গানের আসর বসে। নাচ গান হয়, খুবই ভালো লাগে।
এ ছাড়া গত বছর ২০২২ সালে এই মেলায় এসে যে পাত্র-পাত্রীদের বিয়ে হয়েছিল তারাও এসেছিল মেলায়। এক বছর আগে বিয়ে হওয়া ৬/৭ দম্পতি হাসি খুশিভরা মনে তাদের সুখী ভরা সংসারের কথা তুলে ধরেন। তবে এরা এখনো সন্তানাদী নেয়নি। আগামী বছর সন্তান নেওয়ার কথা ভাবছেন তারা।
তরুণী জেসমিন টুডু বলেন, আমি ও আমার বোন মেলায় গিয়েছিলাম। আমরা সিঙ্গেল। নানি-দাদিদের কাছে শুনেছি এ মেলায় নাকি আদিবাসীরা জীবন সঙ্গী খুঁজে পান। আমরাও খুঁজছি। যদি পছন্দ হয় তাহলে বাড়িতে জানাব।
সামকে টুডু নামের এক তরুণ জানান, সেজেগুজে মেলায় যাই। একজন তরুণীর নজরে পড়েছি। এবার এই মেলায় ৭জন পাত্রপাত্রীর পছন্দ পর্ব হয়। তাদের পরিবারের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। অচিরেই আন্ষ্ঠুানিকভাবে তাদের বিবাহ বন্ধনের অনুষ্ঠান হবে। এতে কোনো ঘটকের প্রয়োজন হয় না।
এবার ওই মেলায় অংশ নেওয়া নীলফামারীর নরেন মার্ডি বলেন, একটা সময় এই মেলায় জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব বদলে গেছে। এখন এই রীতিতে ভাটা পড়েছে। জয়পুরহাট জেলার বাসিন্দা নীলিমা হাসদা বলেন, সময়ের সঙ্গে আদিবাসীদের জীবনযাত্রায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। বেশিরভাগ আদিবাসী ছেলেমেয়ে এখন স্কুলমুখী হয়েছে। তাই পুরনো ঐতিহ্যগুলো অনেকটাই মুছে যেতে বসেছে।
পঞ্চগড়ের বাসিন্দা রীতা হেমরম বলেন, বর্তমান সমাজে আধুনিকতার ছোঁয়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তরুণদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে। আদিবাসীদের জীবন যাত্রায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। বেশিরভাগ আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা এখন বিদ্যালয়মুখী হয়েছে। তাই পুরনো ঐতিহ্যগুলো অনেকটাই মুছে যেতে বসেছে।
মেলা আয়োজক কমিটি বীরগঞ্জ থানা আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির সভাপতি শীতল মার্ডী জানান, এক সময় এ মেলার নাম ছিল বউমেলা। এখন এ মেলা আদিবাসী মিলনমেলা হিসেবে পরিচিত। এখনো অনেকে এ মেলা থেকে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়। সদস্য শ্যাম লাল মুরমু বলেন, পূর্বপুরুষেরা এই মেলা শুরু করেন। আমরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছি। তবে কবে থেকে এ মেলার প্রচলন শুরু হয়েছে সেটি সঠিকভাবে বলা যাবে না। কয়েক শত বছর ধরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বলে বাপ-দাদার কাছে শুনেছি। মেলার সময় এলাকার সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
এ বছর মেলা ঘিরে ছিল অন্যরকম উৎসব। মেলা দেখতে হাজির হয়েছিলেন দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল, জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ ইফতেখার আহমেদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বীরগঞ্জ সার্কেল) খোদাদাদ হোসেন, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাজকুমার বিশ্বাস, মরিচা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম চৌধুরী হেলাল প্রমুখ।