সন্ধ্যাবেলা বাবা বললেন, ‘আজ থেকে তুমি দাদুর কাছে শোবে।’ বাবার কথায় আমি খুশি হয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে বাবা।’
আমি পড়াশোনা করি রাত দশটা পর্যন্ত। মা বললেন, ‘পাপাই তাড়াতাড়ি পড়াশোনা করে খেতে আসবে।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে।’
দাদু লাঠি ভর দিয়ে এসে আমার পড়ার টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন। আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘তাহলে তুই আজ থেকে আমার কাছে শুবি?’
‘জি, দাদু।’
দাদু বললেন, ‘ওসাম।’
মা এসে বললেন, ‘বাবা ভাত খাবার আগের ওষুধ খেয়েছেন?’
‘বুঝতে পারছি না বৌমা। হয়ত খেয়েছি। অথবা খাইনি।’
মা একটু মেজাজ দেখিয়ে বললেন, ‘এ রকম করলে তো হবে না বাবা।’
‘আজকাল খুব একটা মনে থাকে না মা।’
মা চলে গেলেন। আমি দাদুকে বললাম, ‘আজ থেকে আমি তোমাকে ওষুধ খাওয়াব। দেখি তোমার প্রেসক্রিপশনটা আনো তো।’ দাদু খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার প্রেসক্রিপশনটা কোথায় রেখেছেন ভুলে গেছেন।
কিছুক্ষণ পর খাটের নিচে প্রেসক্রিপশনটা পাওয়া গেল। আমি সব ওষুধ ও প্রেসক্রিপশন নিয়ে বসলাম। ওষুধ মিলিয়ে দেখলাম। কোনটা কখন খেতে হবে বুঝে নিলাম।
‘ওটা তাহলে রাতে খাওয়ার?’
দাদু হেসে বললেন, ‘আরে নারে বোকা। এটা দুপুরের।’
পরদিন থেকেই আমার ডিউটি শুরু হয়ে গেল। এখন বাবা বা মা দাদুকে জিজ্ঞেস করে না। ওষুধ খেয়েছে কি না। আমাকেই জিজ্ঞেস করে।
‘কি পাপাই দাদুকে ওষুধ খাইয়েছো?’
আমরা থাকি ময়মনসিংহ শহরে। আমার দাদি মারা গেছেন দু’বছর আগে। দাদি মারা যাওয়ার পর দাদা যেন আরও বুড়ো হয়ে গেছেন। আরও অসুস্থ হয়ে গেছেন। দাদু আগে মাঝে মাঝেই গুনগুন করে গান গাইতেন। এখন একদম গান না। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি আমার দাদির ফটোতে হাত বোলান। ফটোর সামনে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকেন।
সকাল বেলা দাদু বললেন, ‘আজকের পত্রিকাটা দিয়ে যা তো।’
আমি সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও পত্রিকা পেলাম না। মাকে বললাম, ‘মা আজকের পত্রিকাটা কোথায়?’
মা বললেন, ‘হকারকে তো পত্রিকা দিতে নিষেধ করা হয়েছে।’
‘কেন মা?’
‘কেন আবার, তোর বাবা পত্রিকা অফিস থেকেই পড়ে আসে। আমারও যতটুকু পড়ার অফিসেই দেখে নেই। তোর দাদুও তো পত্রিকা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে রেখে দেয়। তাছাড়া তোর বাবার পত্রিকার প্রয়োজন হলে নেটেই দেখে নেয়।’
আমি দাদুর কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনা বলি। দাদু সব শুনে মন খারাপ করলেন। বললেন, ‘আরে সারাদিন তো আমি পত্রিকা নিয়েই থাকি। ওটাই তো আমার সঙ্গী। তুই যাস স্কুলে। তোর বাবা-মা যায় অফিসে। তখন তো আমার কথা বলার সঙ্গী ওই একমাত্র পত্রিকা।’
দাদুর কথা শুনে আমারও মন খারাপ হলো। আমি মুহূর্তে জয়কালি মন্দির এলাকা থেকে পত্রিকা এনে তার হাতে দিলাম।
দাদু খুশি হয়ে আমার দিকে তাকালেন।
‘কোথায় পেলি?’
‘দাদু সময় নেই। আমি স্কুলে যাচ্ছি। পরে এসে কথা বলব।’
বাবা-মা অফিসে। পাপাই স্কুলে। এই সময়টাই সবচেয়ে খারাপ লাগে দাদুর। তার সময় কিছুতেই কাটতে চায় না। সারাক্ষণ ছটফট করতে থাকেন।
পরের দিন হকার এসে পত্রিকা দিল। দরজার ফাঁক দিয়ে পত্রিকা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মা দরজা খুললেন। হকারকে বললেন, ‘তোমাকে না পত্রিকা দিতে নিষেধ করেছি?’
‘আপনার ছেলেই তো বলল। এক মাসের অগ্রিম টাকাও দিয়েছে।’
পাপাইকে ডাকল মা। পাপাই এসে দাঁড়ায় মায়ের সামনে।
‘তুই টাকা পেলি কোথায়?’
‘গত ঈদের সালামির টাকা ছিল।’
‘টাকা থাকলেই নষ্ট করতে হবে?’ মা পত্রিকা নিয়ে দাদুর ঘরে গেলেন।
‘বাবা আপনি কি পত্রিকা পড়েন?’
দাদু আস্তে আস্তে বললেন, ‘না। না। জাস্ট একটু উল্টাই-পাল্টাই।’
‘এই নিন আপনার পত্রিকা।’
নাশতার টেবিলে বাবা বললেন, ‘তাড়াতাড়িই বাবার চোখের ছানি কাটানো দরকার। অনেক দেরি হয়ে গেল। তুমি কি ছুটি নিতে পারবে?’
মা রেগে বললেন, ‘ছুটি নেয়ার কোন দরকার নেই। যেদিন কাটবে ওইদিন, তো ছেড়ে দেবে।’
দাদু বললেন, ‘এ বয়সে আর ছানি কেটে কি হবে? আমার দিব্যি চলে যাচ্ছে।’
অনেক রাত হয়েছে।
ঘুমিয়ে গেছি আমি একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। লাল টকটকে একটি ঘোড়া। সেই ঘোড়ার পিঠে আমি চড়ছি। ঘোড়া ছুটে চলেছে মেঘের ওপর দিয়ে। ঠিক সেই সময় দাদু ডাকলেন, ‘পাপাই, ওঠ তো দেখি। আমার হিসি পেয়েছে।’ আমি খাটে উঠে বসলাম।
দাদু বললেন, ‘আমাকে ধর। ধরে বাথরুমে নিয়ে যা।’
দাদু তো একা একাই বাথরুমে যায়। তাহলে কি দাদু অসুস্থ হয়ে পড়ল। সকালে বাবাকে বললাম, ‘বাবা দাদুকে বাথরুমে ধরে নিতে হয়েছে। আমার কথা শুনে বাবা চিন্তায় পড়লেন।
বললেন, ‘তুই ধরে নিতে পারলি?’
‘হ্যাঁ, পারব না কেন? কমোডে বসিয়ে দিয়ে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।’
সকালে দাদু বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না। মাকে বললাম, ‘মা নাশতা দাও। আমি দাদুকে খাইয়ে দিই।’
মা চুপচাপ বসে থাকলেন কিছুই বললেন না। বাবা ধমকের সুরে বললেন, ‘তুই নিজে নিয়ে যেতে পারিস না নাশতা। মাকে বলছিস কেন?’
মা-বাবার সঙ্গে রাগারাগি হলে মূলত বাবা এ রকম ব্যবহার করেন। আমি নাশতা নিয়ে গিয়ে দাদুকে খাইয়ে দিলাম। দাদু শুয়ে শুয়ে খেলেন। হঠাৎ তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
‘পাপাই টিসু দে দেখি। চোখ দুটো জ্বলছে।’
আমি বুঝতে পারলাম। দাদু কাঁদছেন। বাবা-মা অফিসে চলে গেলেন। আমি স্কুলে না গিয়ে দাদুর পাশে বসে থাকলাম। সকাল দশটায় দাদু বললেন, ‘পাপাই আমার বাথরুম পেয়েছে।’
দাদুকে অনেক কষ্টে বিছানা থেকে উঠলেন। আমার কাঁধে ভর দিয়ে তিনি বাথরুমে গেলেন।
ফিরে এসে তিনি বেতের চেয়ারে বসলেন। আমি তার দিকে পত্রিকাটা এগিয়ে দিলাম। তিনি পত্রিকাটা ছুঁয়েও দেখলেন না।
‘দাদু চা খাবে?’
আমার কথা শুনে দাদু হাসলেন। বললেন, ‘তার আগে আমার ওষুধগুলো দে। আগে ওষুধ খেয়ে নিই।’
ওষুধ খাওয়ানোর পর আমি চা বানিয়ে আনলাম। জীবনে প্রথম আমি চা বানালাম।
দাদুকে বললাম, ‘খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে?’
দাদু বললেন, ‘ওসাম।’
বললাম, ‘গুল মারছো না তো।’
দাদু বললেন, ‘নারে পাপাই, না। গুল মারব কেন? সত্যিই বলছি।’
মা বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরেছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘তুই আজ তাড়াতাড়ি ফিরলি যে?’
‘ফিরব কি? আমি তো স্কুলেই যাইনি।’
কথা শুনে মা বেজায় ক্ষেপে যান। ‘কেন, স্কুলে যাসনি তুই?’
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি।’
মা বলেন, ‘কিরে কথা বলছিস না কেন?’
দাদু বললেন, ‘বৌমা, আমিই ওকে স্কুলে যেতে নিষেধ করেছি। ভাবলাম একা বাসায় থাকব.?’
মা বললেন, ‘বাবা কাজটা আপনি ঠিক করেননি।’
দাদুও আমার মতো চুপ করে গেলেন। কিছু বললেন না মাকে। ওইদিন দাদুকে আমি কিছুতেই ওষুধ খাওয়াতে পারলাম না। রাতে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার সঙ্গে খুব একটা কথাও বললেন না।
অনেক রাতে দাদু আমাকে ডাকলেন। ‘ঘুমিয়ে পড়েছিস পাপাই।’ আমি জেগে উঠলাম। দাদু বললেন, ‘ভীষণ গরম লাগছে আমার। আমাকে একটু নদীর ধারে নিয়ে যাবি?’
‘দাদু এত রাতে যাবে নদীর ধারে?’
‘হ্যাঁ, যাব।’
দাদু আমার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরই আমরা নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাদুর মন ফুরফুরে হয়ে উঠল। নদীতে মাছ ধরার নৌকা। জেলেরা মাছ ধরছেন।
দাদু ডাকলেন, ‘এ্যাই। কি মাছ ধরলে?’
এক জেলে উত্তর দিল, ‘এত রাইতে ক্যাডা ডাকে...?’
নৌকাটা তীরে ভিড়ল। জেলে লোকটা একটা বিরাট বোয়াল মাছ নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়াল। দাদু খুশি হয়ে বলল, ‘ওসাম।’
‘আমার ছেলে বোয়াল মাছ খেতে পছন্দ করে।’
মাছটা কিনে ফেললেন দাদু। মাছটা অনেক কষ্টে বাসায় নিয়ে এলাম। দাদু তার লাঠি দিয়ে বাবার ঘরের দরজায় ঠকঠক শব্দ করলেন। মা-বাবা দুজনই লাফিয়ে উঠলেন। দরজা খুলে দেখলেন আমি একটা বিরাট বোয়াল মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
দাদু বললেন, ‘বৌমা। মাছটা ভাল করে রান্না কর। পাপাইয়ের বাবা বোয়াল মাছ খেতে পছন্দ করে।’
মা দাদুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নির্ঘাত আপনার মাথা খারাপ হয়েছে বাবা। এই গভীর রাতে কেউ মাছ কিনে আনে?’
দাদুর মন খারাপ হয়ে গেল। বাবা বললেন, ‘আমি বোয়াল মাছ খেতে পছন্দ করি কে বলেছে তোমাকে?’
আমি আর দাদু ঘরে ঢুকলাম। মাছটা রেখে দিলাম মেঝেতে। মাছটা তখনও মুখ নাড়ছে। দাদু সেদিকে তাকিয়ে হি হি করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘দেখ, দেখ পাপাই। বোয়াল মাছটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ। যেন তোর দাদি পান চিবাচ্ছে। হাঃ হাঃ।’
পাশের ঘর থেকে মা ডাকলেন, ‘পাপাই ঘুমিয়ে পড়। কাল স্কুলে যেতে হবে।’ বাবাকে আস্তে আস্তে বললেন, ‘তোমার ছেলে এবার নির্ঘাত ফেল করবে। ক্লাশ সেভেন থেকে এইটে আর উঠতে হবে না।’
বাবা বললেন, ‘তাই তো মনে হচ্ছে।’
অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার