শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। যাঁকে আলাদাভাবে চেনার কোন প্রয়োজন পড়ে না। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ যারা পড়েছেন তারা জানেন কি দুঃসাহিক চেতনায়, বলিষ্ঠ কণ্ঠে, সন্তান হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে ১ মার্চ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসের রক্তঝরা ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নিবেদিত প্রাণ জাহানারা ইমাম যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দায়ত্বি ও কর্তব্যের নিষ্ঠা দেখিয়েছেন তা আজও আমাদের শ্রদ্ধায় অভিভূত করে। শুধুমাত্র লেখনী দিয়ে নয়, প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞে দেশের প্রতি যে দায়বদ্ধতা জাহানারা ইমাম অনুভব করেছিলেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’ তারই একটি প্রচ্ছন্ন দলিল।
১৯২৯ সালে জন্ম নেয়া জাহানারা ইমাম ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ১৯৪৫ সালে। এই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৪৭ সালে। ১৯৬০ সালে বিএড ডিগ্রী নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন। সেখান থেকে ১৯৬৪ সালে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে তিনি বেছে নেন সবচেয়ে মহৎ পেশা শিক্ষকতাকে। ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়, ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক এবং সবশেষে খ-কালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
’৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বরের বিজয় অর্জিত হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিনের ঘটনাবলীর এক অনুপম বর্ণনায় সমৃদ্ধ জাহানারা ইমামের এই যুগান্তকারী গ্রন্থটি। পাক সেনাদের নৃশংস অত্যাচার থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা, তৎকালীন রাজনৈতিক সামাজিক অঙ্গনের বিশদ বিবরণ থেকে পারিবারিক আবহে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখার আকাক্সক্ষা ফুটে ওঠে লেখনীর যত্রতত্র। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় গাথার বর্ণনা যেমন আছে গ্রন্থটিতে, তেমনি আছে ’৭১-এর প্রতিদিনের পাক সেনাদের মানুষ হত্যা এবং নির্যাতনের পাশবিক ঘটনা। ছেলে রুমী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। রুমীর প্রতিদিনের নানা দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় মা জাহানারা ইমাম মুগ্ধ হলেও অনেকটাই বিচলিত থাকেন। নানা বিপদের আশঙ্কায়। সমস্ত সঙ্কট কাটিয়ে কিভাবে রুমী স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনার সংগ্রামে সংযুক্ত হবে সেটা যেমন রুমীর ভাবনা একইভাবে তা তার মায়েরও চিন্তু। মা প্রথমে আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত রুমীকে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুমতি এবং অনুপ্রেরণা দুটোই দেন।
’৭১-এর ২৯ আগস্ট, রবিবার সেই ভয়াবহ রাতটির কথা মা জাহানারা ইমাম জীবনে কখনও ভুলতে পারেননি। সে রাতে পাক সেনারা রুমী, জামী এবং স্বামী শরীফকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। অনেক অত্যাচার আর নির্যাতনের পর ছোট ছেলে জামী আর স্বামী শরীফকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেও রুমীকে পাক সেনাদের নজরবন্দীতেই রেখে দেয়। সেই রুমী আর কখনও ফিরে আসেনি।
আর ১৩ ডিসেম্বর রাতে স্বামী শরীফ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সুস্থ অবস্থায় আর বাসায় ফিরতে পারেননি। প্রয়োজনীয় ডাক্তারের উপস্থিতিতেও এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা যান শরীফ। তৎকালীন সামরিক জান্তার বেপরোয়া কার্যকলাপ, কারণে-অকারণের ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করে দেয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র না পাওয়া- সব মিলিয়ে স্বামীর চিকিৎসা সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার মাত্র ২দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর সকাল দশটায় স্বামীর মরদেহ এসে পৌঁছায় বাসায়। স্বামীর শেষ যাত্রার দৃশ্য জাহানারা ইমামের লেখনীতে করুণভাবে বিধৃত করা আছে।
‘বাড়ির পাশের খালি জায়গাতে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জান লোক দুপুর সাড়ে বারোটায় জানাজায় শামিল হলেন। চার পাঁচটা গাড়িতে করে জনাকুড়ি লোক গোরস্তানে গেলেন। বাবা একেবারে নির্বাক হয়ে তার ইজিচেয়ারে পড়ে রয়েছেন।’
আর মুক্তিযোদ্ধা ছেলে রুমীর শেষযাত্রা দেখার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য কোনটাই মা জাহানারা ইমামের হয়নি। সেই যে রুমী গেল বাড়ি থেকে পাক সেনাদের জিম্মায়- আর কখনও ফিরে আসেনি। স্বামীহারা, পুত্রহারা জাহানারা ইমাম শোকে পাথর হয়েও স্বাধীনতার সূর্যকে ম্লান হাসিতে সম্ভাষণ জানালেন। আমরা দেখেছি পরবর্তীতে সেই শোক কিভাবে শক্তিতে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর যুদ্ধাপরাধীদের পুনরায় রাষ্ট্রযন্ত্রে পুনর্বাসিত হতে দেখে জাহানারা ইমাম নতুন উদ্যোমে জেগে ওঠেন। তারই প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে গড়ে ওঠে ’৭১-এর ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটি এবং গণআদালত। জাহানারা ইমামের সক্রিয় ভূমিকায় ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে সংগঠনটির শুভযাত্রা শুরু হয়। গণআদালতের জনসমুদ্রে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামের আমির গোলাম আযমের বিচার সম্পন্ন করে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে খালেদা জিয়া সরকার জাহানারা ইমামসহ অংশ নেয়া দেশবরণ্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রোদ্রোহের মামলা করে। জামিনে অব্যাহতি পেয়ে সবাই কোন মতে এই মামলা থেকে রেহাই পান। ঠোঁট এবং মুখের ভেতরে ১৯৮২ সালেই জাহানারা ইমাম ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা সেরে আসতেন। ১৯৯৪ সালের ২ এপ্রিল চিকিৎসার জন্য তিনি পুনরায় যুক্তরাষ্ট্র গমন করেন। কিন্তু আর ফেরেননি। ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় আমেরিকার মিশিগানে এই মহীয়সী নারী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। যাওয়ার প্রাক্কালে ও জনগণের কাছে এই বাণী রেখে যান- ‘অবশ্যই জয় আমাদের হবে।’ বর্তমান সরকারের যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং রায় কার্যকরের যুগান্তকারী ইতিহাস জাহানারা ইমামের জীবনব্যাপী লালন করা স্বপ্নেরই মূর্ত প্রকাশ। এই বিচার যতই কার্যকর হবে দেশ ততই কলঙ্কমুক্ত হবে এবং অগণিত শহীদ জাননীর আত্মা শান্তিতে ভরে উঠবে।