
ছবি: সংগৃহীত
ঘুমের সমস্যা আজকাল সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ রাতে ঘুমাতে দেরি করেন, আবার কেউ মাঝরাতে উঠে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ জেগে থাকেন। অনেকে ম্যাগনেসিয়াম বা মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্টের দিকে ঝুঁকছেন, কিন্তু কোনটি বেশি উপকারি? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আপনার ঘুমের সমস্যার ধরন ও জীবনযাত্রার ওপর।
মেলাটোনিন কীভাবে ঘুমে সাহায্য করে?
মেলাটোনিন একটি প্রাকৃতিক ঘুম হরমোন, যা মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় এবং দেহের সার্কাডিয়ান রিদম তথা ঘুম-জাগরণ চক্র নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত সন্ধ্যার পর যখন চারপাশে আলো কমে আসে, তখন মেলাটোনিনের মাত্রা শরীরে বাড়তে থাকে এবং তা মস্তিষ্ককে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের তিন ঘণ্টা আগে ২-৪ মিলিগ্রাম মেলাটোনিন গ্রহণ করলে ঘুমে যাওয়ার সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এবং ঘুম আরও গভীর ও টেকসই হয়। বিশেষ করে যাদের ঘুমে যেতে দীর্ঘ সময় লাগে বা যারা "ডিলেইড স্লিপ ফেজ সিনড্রোম"–এ ভোগেন, তাদের জন্য এটি কার্যকর হতে পারে।
টাইম জোন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেমন জেটল্যাগ, কিংবা যারা রাত্রিকালীন শিফটে কাজ করেন, তাদের জন্য মেলাটোনিন বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে। এটি ঘুমের অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে (বডি ক্লক) পুনরায় সঠিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে।
এছাড়াও, প্রাইমারি ইনসমনিয়ায় যারা খুব ভোরে উঠে যান এবং তারপর আর ঘুমাতে পারেন না, তাদের ক্ষেত্রে রাতে মেলাটোনিন গ্রহণ ঘুমের সময়কাল দীর্ঘায়িত করতে পারে। যদিও এই ধরনের ইনসমনিয়ার সব উপসর্গে মেলাটোনিন সমানভাবে কাজ নাও করতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে একটি সতর্কবার্তাও রয়েছে। অতিরিক্ত মেলাটোনিন গ্রহণ করলে শরীরের নিজস্ব মেলাটোনিন উৎপাদন কমে যেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে সাপ্লিমেন্টের ওপর নির্ভরতা তৈরি করতে পারে। এছাড়া, মেলাটোনিন কিছু ওষুধের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যেমন ব্লাড থিনার, সেডেটিভ ও এন্টিডিপ্রেসেন্ট। তাই যেকোনো সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
সার্বিকভাবে, মেলাটোনিন শরীরের ঘুমের স্বাভাবিক চক্রকে সহায়তা করলেও, এটি কোনো ম্যাজিক পিল নয়। বরং এটি সঠিকভাবে গ্রহণ করলে ঘুমের গুণগত মান উন্নত করতে পারে। তবে ঘুমের জন্য নির্ভরযোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পেতে হলে জীবনধারায় স্বাস্থ্যকর ঘুম-অভ্যাস গড়ে তোলাই শ্রেয়।
ম্যাগনেসিয়াম কীভাবে কাজ করে?
ম্যাগনেসিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, যা মানবদেহে ৩০০ এর বেশি এনজাইম্যাটিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ঘুমের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু নির্দিষ্ট কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যাগনেসিয়াম ঘুমের গুণগত মান উন্নত করতে বিশেষভাবে সহায়ক, বিশেষ করে যারা স্ট্রেসজনিত ইনসমনিয়ায় ভুগছেন তাদের জন্য।
প্রথমত, ম্যাগনেসিয়াম কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কর্টিসল যখন বেশি মাত্রায় নিঃসৃত হয়, তখন শরীরের রিল্যাক্সেশন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং ঘুম আসতে দেরি হয়। ম্যাগনেসিয়াম এই কর্টিসলের মাত্রা কমিয়ে শরীর ও মস্তিষ্ককে স্বস্তিতে আনে, যা ঘুমে সহায়তা করে।
দ্বিতীয়ত, ম্যাগনেসিয়াম GABA (Gamma-Aminobutyric Acid) নামক একটি নিউরোট্রান্সমিটারের উৎপাদন এবং কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। GABA মূলত মস্তিষ্কের অতিরিক্ত উত্তেজনা বা "mental chatter" কমিয়ে শান্ত পরিবেশ তৈরি করে, যা ঘুমে সহায়ক হয়। ম্যাগনেসিয়াম এই GABA রিসেপ্টরগুলোকে উদ্দীপিত করে শরীরকে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করে।
যদিও ম্যাগনেসিয়ামের ঘুম-বর্ধক প্রভাব নিয়ে গবেষণা এখনো সীমিত, তবে অনেক পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা পর্যাপ্ত মাত্রায় ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণ করেন তাদের ঘুমের মান তুলনামূলকভাবে ভালো। বিশেষ করে যারা উদ্বেগ, মানসিক চাপ বা হালকা ঘুমের সমস্যায় ভোগেন, তাদের জন্য ম্যাগনেসিয়াম একটি প্রাকৃতিক বিকল্প হতে পারে।
তবে এক্ষেত্রেও সতর্কতা প্রয়োজন। অতিরিক্ত ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণে ডায়রিয়া, পেটের গণ্ডগোল বা অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এছাড়া কিছু চিকিৎসাজনিত অবস্থায় ম্যাগনেসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
সার্বিকভাবে, ম্যাগনেসিয়াম সরাসরি ঘুমের হরমোনের মতো কাজ না করলেও, এটি ঘুমের পরিবেশ সৃষ্টি ও মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে যদি ঘুমের সমস্যা মানসিক চাপ বা স্নায়বিক উত্তেজনা থেকে উদ্ভূত হয়।
কোনটি আপনার জন্য উপযুক্ত?
উপসর্গ | সাপ্লিমেন্ট |
---|---|
জেটল্যাগ, রাত জেগে থাকা | মেলাটোনিন |
স্ট্রেস, উদ্বেগজনিত ঘুমের সমস্যা | ম্যাগনেসিয়াম |
ঘুমে যাওয়ার সময় বেশি লাগে | মেলাটোনিন |
বারবার ঘুম ভেঙে যায় | ম্যাগনেসিয়াম |
মুমু ২