
ছবিঃ সংগৃহীত
ভ্রমণ শুধু মানচিত্রে দেশের সংখ্যা বাড়ানো নয়। এটি ভিন্ন সংস্কৃতিতে ডুবে যাওয়া, অজানা খাবার উপভোগ করা, আর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের এক অভিজ্ঞতা।
এই পৃথিবী অসাধারণ সব জায়গায় পরিপূর্ণ। আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু স্বপ্নের গন্তব্য থাকে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, কিছু দেশ আছে, যেখানে জীবনে অন্তত একবার ভ্রমণ করা উচিত।
এই দেশগুলো শুধুই পর্যটন গন্তব্য নয়। এগুলো জীবন বদলে দেওয়া যাত্রা—যা আত্মায় গভীর ছাপ ফেলে।
তাই আজ আমি নিয়ে এসেছি এমন ১০টি দেশ, যেখানে না গেলে জীবনটাই অপূর্ণ থেকে যাবে।
ভ্রমণপিপাসু মন প্রস্তুত তো? চলুন শুরু করা যাক।
১) ইতালি
ইতালি শুধু একটি দেশ নয়, এটি একটি অভিজ্ঞতা।
ভাবুন তো, আপনি একটি ব্যস্ত পিয়াজ্জায় বসে আসল ইতালিয়ান এসপ্রেসো পান করছেন। অথবা রোমের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ঘুরে দেখছেন, যেখানে একসময় সম্রাট আর গ্ল্যাডিয়েটররা পা ফেলতেন।
খাবারের কথা তো বলতেই হবে। ক্রিমি জেলাটো থেকে শুরু করে জিভে জল আনা পিৎজা—ইতালি হচ্ছে খাবারপ্রেমীদের স্বর্গ।
তবে ইতালি শুধু রোম আর খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানেই আছে টাসকানির পাহাড়ি দ্রাক্ষাক্ষেত্র, ভেনিসের রোমান্টিক খাল আর আমালফি উপকূলের নাটকীয় সৌন্দর্য।
প্রত্যেকের জন্যই এখানে কিছু না কিছু আছে। আর আপনি বারবার গেলেও, প্রতিবার নতুন কিছুতে প্রেমে পড়বেন।
২) জাপান
জাপান আমার হৃদয়ের বিশেষ এক জায়গায় অবস্থান করে।
আমি আজও মনে করতে পারি, প্রথমবার টোকিওতে পা রাখার অভিজ্ঞতা। শহরের চমকপ্রদ আলো, আধুনিকতা আর ঐতিহ্যের মিশ্রণ—সবকিছুই ছিল অভূতপূর্ব। শিবুয়ার ঝলমলে ক্রসিং, মেইজি মন্দিরের প্রশান্তি, মুখে গলে যাওয়া সুসি—সবই ছিল চমৎকার।
কিন্তু আসল জিনিসটা ছিল জাপানি মানুষদের মধ্যে। তাঁদের ভদ্রতা, ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা, নিখুঁত সব কিছুতে মনোযোগ—এটা আমাকে সত্যিই অভিভূত করেছিল।
আর কিয়োটোর কথা না বললেই নয়। প্রাচীন মন্দির আর গিশা জেলার সৌন্দর্য আপনাকে অন্য জগতে নিয়ে যাবে। হিরোশিমাও এক অসাধারণ উদাহরণ, যেটি ধ্বংসের মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
জাপানে যাওয়া ছিল এমন এক অভিজ্ঞতা, যা আমাকে ভেতর থেকে বদলে দিয়েছে।
৩) দক্ষিণ আফ্রিকা
‘রেইনবো নেশন’ নামে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকা হলো বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের এক দেশ।
কেপ টাউনের টেবিল পর্বত থেকে শুরু করে স্টেলেনবসের দ্রাক্ষাক্ষেত্র পর্যন্ত—এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়ার মতো। আর বন্যপ্রাণীর কথা ভুলবেন না। এখানেই পাবেন বিখ্যাত "বিগ ফাইভ"—সিংহ, চিতা, গণ্ডার, হাতি আর কেপ মহিষ।
জানেন কি, দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছে আটটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান? এর মধ্যে রয়েছে মানবজাতির উৎপত্তিস্থল "ক্র্যাডল অফ হিউম্যানকাইন্ড" আর রবিন আইল্যান্ড, যেখানে নেলসন ম্যান্ডেলা ১৮ বছর কারাবন্দি ছিলেন।
আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী হন বা ইতিহাস জানতে ভালোবাসেন, দক্ষিণ আফ্রিকা আপনার তালিকায় থাকতেই হবে।
৪) অস্ট্রেলিয়া
"ডাউন আন্ডার" নামে পরিচিত অস্ট্রেলিয়া এক অনন্য অভিজ্ঞতার জায়গা।
সূর্যভেজা সমুদ্র সৈকত থেকে শুরু করে পর্বত, মরুভূমি—এ দেশের প্রকৃতি চমকে দেয়। এখানে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবাল প্রাচীর, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। সিডনির অপেরা হাউস আর হারবার ব্রিজও চোখ ধাঁধানো।
মিস করবেন না উলুরু বা আয়ার্স রক—অস্ট্রেলিয়ার মাঝখানে থাকা এক রহস্যময় প্রাকৃতিক গঠন।
এছাড়াও রয়েছে বিশেষ প্রাণী—ক্যাঙারু, কোয়ালা, আর ডিম পাড়া প্ল্যাটিপাস ও ইচিডনা।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এখানকার মানুষ। অস্ট্রেলিয়ানরা খুব বন্ধুবান্ধব ও সহজ-সরল। এখানকার জীবনযাপনই এক আলাদা আনন্দ।
৫) গ্রিস
ইতিহাস আর পুরাণে ভরপুর গ্রিস এমন একটি দেশ, যেখানে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আর চোখজুড়ানো দ্বীপের সৌন্দর্য মিলেমিশে আছে।
আপনি যদি এক্রোপলিস ঘুরে দেখেন, সান্তোরিনির অলিগলিতে হাঁটেন, বা গ্রিক খাবারের স্বাদ নেন—প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতা হবে স্মরণীয়।
এজিয়ান সাগরের স্বচ্ছ নীল জল আর সাদা-নীল গম্বুজওয়ালা বাড়িগুলো যেন পোস্টকার্ড থেকে উঠে এসেছে।
গ্রিসের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব। পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্মস্থান এই দেশটি চোখে দেখার মতোই এক শিক্ষা।
৬) নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ড, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অতিথিপরায়ণতার দেশ।
সাউদার্ন আল্পসের পর্বতমালা থেকে শুরু করে বে অফ আইল্যান্ডসের নিরিবিলি সমুদ্রসৈকত—প্রত্যেক কোণায় কোণায় প্রাকৃতিক বিস্ময়।
তবে যা এই দেশকে আলাদা করে তোলে তা হলো এখানকার মানুষ। ‘কিউই’ হিসেবে পরিচিত তারা, বিশ্বে অন্যতম অতিথিপরায়ণ ও প্রাকৃতিপ্রেমী জাতি।
আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে থাকেন, প্রকৃতি ভালোবাসেন, বা নতুন সংস্কৃতি জানতে চান—নিউজিল্যান্ডে সবই আছে।
৭) ফ্রান্স
আমি যখন প্রথম ফ্রান্স যাই, তখন এক তরুণ, কৌতূহলী পর্যটক ছিলাম। প্রথম গন্তব্য ছিল প্যারিস—আলোয় মোড়া শহর—and it was love at first sight.
ক্যাফে আর বুটিকে ভর্তি রাস্তাগুলো থেকে শুরু করে মন্টমার্তের পাথরের অলিগলি—সবই মুগ্ধ করেছিল।
আইফেল টাওয়ার, লুভর, নটর-ডেম—প্রতিটি নিদর্শন একেকটি বিস্ময়।
কিন্তু আমি প্যারিসেই থামিনি। গিয়েছিলাম গ্রামাঞ্চলে—দেখেছি দ্রাক্ষাক্ষেত্র, প্রাচীন দুর্গ, আর খেয়েছি আসল ফরাসি খাবার। সেই ভ্রমণ আমার মধ্যে ভ্রমণ ও সংস্কৃতির জন্য গভীর ভালোবাসা তৈরি করেছিল।
৮) ভুটান
হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ছোট্ট রাজ্য ভুটান—প্রথমে মনে না আসলেও, এটা আপনার তালিকায় থাকা উচিত।
ভারত আর নেপালের মতো বিখ্যাত প্রতিবেশীদের পাশে ভুটান প্রায়ই উপেক্ষিত। কিন্তু জানেন কি, ভুটানই একমাত্র দেশ যারা জাতীয় সাফল্য মাপে "গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস"-এ!
এখানে দেখা যাবে পর্বতের চূড়ায় থাকা মঠ, সবুজ উপত্যকা আর শান্তিপূর্ণ বৌদ্ধ সংস্কৃতি।
আর যারা ট্রেকিং ভালোবাসেন, ভুটানের মতো সুন্দর আর নির্জন ট্রেকিং রুট খুব কমই আছে।
৯) কানাডা
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা, বৈচিত্র্য আর সৌন্দর্যের এক অনন্য উদাহরণ।
নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল থেকে শুরু করে আলবার্টার রকি পর্বতমালা—প্রতিটি প্রাকৃতিক দৃশ্য একেকটি বিস্ময়।
তিমি দর্শন, অরোরা দেখা, বা ব্যানফ-জ্যাসপারের মতো জাতীয় উদ্যান ঘোরা—প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বপ্নের ঠিকানা কানাডা।
শহরগুলোও দারুণ—টরন্টো, মন্ট্রিয়াল, ভ্যাঙ্কুভার—প্রতিটি শহরের নিজস্ব স্বাদ আছে।
আর কানাডিয়ানদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ভ্রমণকে করে তোলে আরও আনন্দদায়ক।
১০) ব্রাজিল
ব্রাজিল কেবল একটি দেশ নয়—এটি এক রঙিন জীবনের উৎসব।
সাম্বার সুর, অ্যামাজনের গহন অরণ্য, রিও দে জেনেইরোর খ্রিষ্ট প্রতিমা, সালভাদরের বর্ণময় ভবন, আর ইগুয়াজু জলপ্রপাত—সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।
তবে আসল সৌন্দর্য হলো ব্রাজিলবাসীদের মধ্যে। তাদের সঙ্গীত, নাচ, ফুটবল ভালোবাসা আর প্রাণবন্ততা সত্যিই সংক্রামক।
এই গন্তব্যগুলো হোক আপনার অনুপ্রেরণা। কারণ ভ্রমণ শুধু কোথায় যান তা নয়, আপনি কী নিয়ে ফিরছেন সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
মারিয়া