ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোজাদারের ইফতার ও সেহ্রি খাবার

ডা. মো. ফারুক হোসেন

প্রকাশিত: ০১:০১, ২৬ মার্চ ২০২৪

রোজাদারের ইফতার ও সেহ্রি খাবার

রোজাদারের ইফতার ও সেহ্রি খাবার

ইফতার শুরু করা উচিত এক গ্লাস পানি দিয়ে। ডাবের পানি খাওয়া যেতে পারে। কৃত্রিম শরবতের চেয়ে লেবুর শরবত স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে এক গ্লাসের বেশি শরবত না খাওয়াই ভালো। খেজুর অবশ্যই খাওয়া যেতে পারে, এমনকি ডায়াবেটিস রোগীরা একটি বা দুটি খেজুর খেলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ খেজুরের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স তুলনামূলকভাবে কম।

ডায়াবেটিস রোগীরা চাইলে কম মিষ্টিযুক্ত খেজুর সংগ্রহ করতে পারেন। আলজেরিয়া থেকে আমাদের দেশে যেসব খেজুর আসে সেগুলোর মিষ্টি অনেক কম। শসা খাওয়া যেতে পারে যেহেতু এখন পর্যন্ত এর মধ্যে রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়নি। তরমুজ খেতে চাইলে সাবধানে খেতে হবে। কারণ তরমুজ টকটকে লাল রং করার জন্য অভিনব উপায়ে রঙিন রাসায়নিক পদার্থ তরমুজে প্রবেশ করানো হয়। তাই তরমুজ কেনার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পেট ভরে ইফতার করবেন না।

পেট ভরে ইফতার করলে পেটের সমস্যা ছাড়াও নামাজ এবং অন্যান্য ইবাদত করতে সমস্যা হবে। অনেক সুস্থ মানুষ এমনভাবে ইফতার করেন যে, পরের দিন ইফতার পর্যন্ত ক্ষুধা লাগার কথা নয়। এভাবে খাবার গ্রহণ রোজার আদর্শ বিরোধী। মনে রাখতে হবে রোজার মাসে সব কিছুর মাঝে সংযম থাকতে হবে। ইফতারের সময় রেস্টুরেন্ট এবং ফুটপাথে যে সব শরবত বিক্রি করা হয় তাতে বরফ মেশানো হয় যা মূলত সরবরাহ করা হয় মাছের জন্য ব্যবহৃত বরফ এমনকি মৃত মানুষ সংরক্ষণ করার জন্য ব্যবহৃত বরফ থেকে।

মাঝে মাঝে ছোটখাটো কারখানা থেকে নদীর দূষিত পানি দিয়ে বরফ তৈরি করে তা বাজারে সরবরাহ করা হয়। শুধু ইফতারের শরবত নয় বরং রমজান মাসে কেনাকাটা করার সময় মেয়েরা বিশেষ করে লাচ্ছি এবং ফালুদা খাবেই। লাচ্ছি এবং ফালুদাতে ও একইভাবে বরফ মেশানো হয়ে থাকে যা কখনো কারও কাম্য হতে পারে না। অথচ আপনি বাসায় সহজেই বিশুদ্ধ পানি দিয়ে এ বরফ তৈরি করতে পারেন। বাংলাদেশে একমাত্র ফাইভ স্টার হোটেল ছাড়া সম্ভবত কোথাও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বরফ তৈরি করা হয় না। অপ্রিয় হলেও সত্য একটু সাবধানে সব কিছু দেখে শুনে খেতে হবে।

আমাদের দেশে ইফতারিতে মুড়ি না হলে চলে? ইফতারের একটি অপরিহার্য অংশ মুড়ি। মুড়ি, ছোলা, পিঁয়াজু, ঘুগনি, জিলাপি, ধনেপাতা সবকিছু এক করে মিশিয়ে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাওয়ার মাঝে এক অন্য ধরনের আনন্দ রয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুড়িকে বড় এবং সাদা করার জন্য ইউরিয়া মিশানো হয়ে থাকে। ইউরিয়া মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

ইউরিয়া হজমের জন্য প্রয়োজনীয় ইউরিয়েজ এনজাইম মানব দেহে না থাকার জন্য মানুষ ইউরিয়া হজম করতে পারে না এবং ইউরিয়া দেহের অভ্যন্তরে থেকে যায়। ইউরিয়া খেলে এসিডিটির সমস্যা ছাড়াও বিভিন্ন জটিলতাসহ মৃত্যু পর্যন্ত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মুড়ি খেতে হবে রয়ে সয়ে এবং দেখে শুনে। সাদা মুড়ি বর্জন করে হাতে ভাজা মুড়ি খেতে হবে। ইফতারে কলা খেতে চাইলে কলা কেনার সময় দেখেশুনে কিনতে হবে যেন কলাতে কার্বাইড মেশানো না থাকে।

কার্বাইড পাকানো কলার বোঁটা হালকা সবুজ থাকে এবং কলার খোসা বা উপরিভাগ দাগহীন পরিষ্কার হলুদ রঙের হয়ে থাকে। স্বাভাবিক কলা কখনোই এরকম দাগহীন পরিষ্কার হলুদ রঙের হয় না। তবে মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম দেখা যেতে পারে। ছোট চিনিচম্পা কলা অথবা বিচি কলা কিনতে পারেন। দাম কম বলে এবং লাভ কম হয় বলে রাসায়নিক মিশ্রণের সম্ভাবনা কম থাকে। রমজান মাসে কেউ যদি হোটেলে খেতে বাধ্য হন তাহলে ভাতের সঙ্গে মুরগির মাংস না খাওয়াই ভালো।

ঢাকা শহরের অধিকাংশ হোটেলে ভালো মুরগির সঙ্গে মরা মুরগিও রান্না করা হয়। মাঝে মাঝে কিছু অভিযান চললেও সেটি আমাদের জাতীয় চরিত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না। তাই হোটেলে একান্ত খেতেই হলে মুরগির পরিবর্তে মাছ খাওয়াই উত্তম। সাহ্রিতে বেশি মসলা এবং লবণযুক্ত খাবার খাবেন না। এসব খাবার রোজা রাখা অবস্থায় পিপাসা বাড়িয়ে দেয়।
কিডনি রোগীরা যদি রোজা রাখেন তাহলে ইফতারের সময় ডালের তৈরি কোনো ইফতার সামগ্রী গ্রহণ করবেন না। বেগুনি না খাওয়াই ভালো। বিভিন্ন রঙিন জিলাপি খাবেন না। রঙিন জিলাপিতে কৃত্রিম রং মেশানো থাকে। এটি আপনার কিডনির অবস্থা আরও খারাপ করে ফেলবে। শুধু তাই নয় কৃত্রিম রং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। হালিম খাওয়া আপনার জন্য বিষের মতো। ইফতারের সময় কিডনি রোগীরা শুধু পানি দিয়ে ইফতার শুরু করবেন। ফলের মধ্যে আপেল, নাশপাতি খাবেন।

দু-একটি খেজুর খেতে পারেন। পালংশাক, পুঁইশাক, অথবা অন্য কোনো শাকের পাকুড়া খাবেন না। কাবাব জাতীয় খাবার খাবেন না। সামান্য ইফতার করে নামাজ পড়ার পর আপনি আপনার ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক রাতের খাবার খেয়ে নিবেন। তরকারি হিসেবে চিচিঙ্গা, ধুন্দুল এবং লাউ খেতে পারেন। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে আপনারা যারা রোজা রাখবেন তারা রোজা রাখা অবস্থায় দিনের শেষ ভাগে অবশ্যই সুগার মনিটর করবেন। কারণ অনেকের দিনের শেষে এসে রক্তের সুগার এত কমে যায় যে, হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।

আপনি যদি বারবার সুগার মনিটর করেন তাতে করে আপনার রোজার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। কিন্তু রক্তের সুগার অনেক কমে গেলে তখন দেরি না করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
যারা রোজা রাখবেন তারা সেহ্রি খাবার পর চা বা কফি পান করবেন না। এছাড়া কোমল পানীয় বা কোমল ড্রিংকস্ খাবার  সেহ্রির পর খাবেন না। এতে দিনের বেলায় আপনার শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যাবে। ডিহাইড্রেশন হতে পারে। তখন আপনার রোজা রাখতে বেশ কষ্ট হবে। যারা মুখের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন তারা সেহ্রি খাবার পর মলম জাতীয় ওষুধ মুখের অভ্যন্তরে ব্যবহার করবেন না। রোজারত অবস্থায় মলম গলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে রোজা ভেঙে যাবে।

রোজা রাখা অবস্থায় দিনের বেলায় টুথপেস্ট ব্যবহার করা যাবে না। মেসওয়াক করতে পারেন। রমজান মাসে খাবার বেশি না খেয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে ইফতার থেকে শুরু করে সেহেরি পর্যন্ত। যারা ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত তারা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোজা রাখবেন। 
লেখক : মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ
ইমপ্রেস ওরাল কেয়ার, বর্ণমালা সড়ক, ইব্রাহিমপুর, ঢাকা।  মোবাইল : ০১৮১৭৫২১৮৯৭ 
ই-মেইল : [email protected]

×