ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদের স্বপ্নে রাঙানো ৭০ হাজার গাছ 

আশরাফ আহমেদ

প্রকাশিত: ১৭:০৪, ১৭ জুলাই ২০২৫

এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদের স্বপ্নে রাঙানো ৭০ হাজার গাছ 

ছবি: জনকণ্ঠ

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ। টিলাঘেরা ক্যাম্পাসটির রূপ-লাবণ্য মুগ্ধ করে সবাইকে। প্রকৃতি যেন উদার করে ভরিয়ে দিয়েছে তৎকালীন আসাম প্রদেশের একমাত্র এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে। শতবর্ষী কলেজটিকে আরো নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে ক্রমাগত ব্যতিক্রমী সব উদ্যোগ নেওয়ার ধারাবাহিকতা সব প্রশাসনই করে গিয়েছে। এরমধ্যে এমসি কলেজের ৪৭ তম অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহাম্মদ সালেহ আহমেদকে নিয়ে ছোট্ট একটি গল্প তুলে ধরার সামান্য প্রয়াস ৷ সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার সৈয়দপুরের সন্তান সালেহ আহমেদ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমসির ভাইস প্রিন্সিপাল এবং পরবর্তীতিতে প্রিন্সিপাল হন। অধ্যক্ষের চেয়ারে বসার পর থেকেই তার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করতে থাকেন। স্যারের সাথে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল দীর্ঘদিনের আস্থা আর বিশ্বাসে ভরপুর। যেকারণে নানা বিষয়ে শেয়ার করতেন। 


নিরাপত্তার স্বার্থে সিসি ক্যামেরা দ্বারা পুরো কলেজটিকে নজরদারির আওতায় আনার কাজ শেষ করেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও বঙ্গবন্ধুর  জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোকে সাজিয়ে তুলেন  প্রেরণা আর সচেতনতামুলক বিভিন্ন সাইনবোর্ডে।১০ তলা একাডেমিক ভবনের কাজও দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তার৷  এসবের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দের খবর ছিল শতবর্ষী কলেজটিতে  ৭০ হাজার বৃক্ষ রোপণের কাজটি।


এমসি কলেজের ১৪৪ একর জায়গার অনেকাংশই টিলাবেষ্ঠিত। বিশেষ করে কলেজের ছাত্রবাস, ছাত্রী হোস্টেল, অধ্যক্ষের বাংলো এবং একাডেমিক কাম পরিক্ষা ভবনের পেছনের টিলাগুলো। সালেহ স্যার এইসব টিলা এবং কলেজের অন্যান্য খালি জায়গাগুলোতে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেন। কিন্তু আপত্তি সাজলো বাজেট নিয়ে। বিশাল টিলাগুলোকে গাছ দিয়ে পূর্ণ করতে বড় অংকের টাকার প্রয়োজন৷ কলেজের ফান্ডে এইখাতে খরচ করার মতো এত টাকাও নাই। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও এত বাজেট গাছ লাগানোর কাজে দিতে রাজী না।  কি করা যায়? এই যখন অবস্থা  তখন সালেহ স্যারের সাথে  সিলেট বনবিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম যোগাযোগ করেন।এবং এমসি কলেজে গাছ লাগানোর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। মেঘ না চাইতেই যেন বৃষ্টি। স্যার এই প্রস্তাবে অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। পরে বনবিভাগের কর্মকর্তারা কলেজ পরিদর্শন করেন। এর কিছুদিন পর বনবিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। কলেজ প্রশাসনের সাথে চুক্তি হয় ৭০ হাজার গাছ লাগানোর। পরবর্তীতে ২০২০ সালের শুরুর  দিকে  ছাত্রবাসের ৪ তলা নতুন ভবনের সামনে দেড় বিঘা জমির উপর  প্রায়  এক লক্ষ ২০  হাজার বিভিন্ন ধরনের ফলদ,বনজ এবং ঔষধি গাছের বীজ বপন করে নার্সারি করা হয়। এর মাসতিনেক পর চারাগুলো বড় হয়ে গেলে গাছ লাগানো শুরু হয়। কলেজের মূল ক্যাম্পাস, বিভিন্ন টিলা, ছাত্রাবাস, ছাত্রী হোস্টেল, খেলার মাঠসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ৭০ হাজার গাছ রোপণ করা হয়। এবং বাকি চারাগুলোর মধ্যে ২০ হাজার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ২০ হাজার জালালাবাদ ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে রোপণ করা হয়৷ গাছের চারাগুলো রোপন করার আগে ক্যাম্পাসের আঙিনা আর টিলাগুলোতে থাকা ঝোপঝাড়গুলো পরিষ্কার করা হয়।


'দেশের বায়ু দেশের মাটি, গাছ লাগিয়ে করবো খাঁটি' স্লোগানকে সামনে রেখে পরবর্তীতে নির্দিষ্ট দূরত্ব ও নিয়ম মেনে চারাগুলো রোপন করা হয়।  উঁচুনিচু টিলায় সারি সারি গাছ ১৪৪ একরের ঐতিহ্যবাহী ক্যাম্পাসটির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। 
যার মাধ্যমে  এমসি কলেজের সবুজ আঙিনায়  একজন অধ্যক্ষের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হয়।এসময় এমসি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে কলেজের বিভিন্ন জায়গায় আরও কিছু গাছ লাগানো হয়েছিল।


কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. সালেহ আহমদ এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিশাল এই প্রজেক্টটা বাস্তবায়ন এবং পরবর্তীতে দু'বছর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে সিলেট বনবিভাগ। ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে  এমসি কলেজের ইতিহাসে এর আগে  এতো বড় পরিসরে বৃক্ষ রোপন হয় নি। 


বিষয়টি নিয়ে সিলেটের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটির  অধ্যক্ষ বলছিলেন, ১২৯ বছরের পুরোনো এই বিদ্যাপীঠের অনেকগুলো টিলা আছে। যেগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন  আগাছা গজে উঠেছে। এই টিলাগুলো পরিষ্কার করে গাছ লাগানোর বিষয়টা প্রথম থেকেই মাথায় ছিল। সিলেট  বনবিভাগ আন্তরিকভাবে কাজটি করে। প্রফেসর মো. সালেহ আহমদ বলেন, গাছগুলো বেড়ে উঠলে সিলেটের এই ক্যাম্পাসটি দেখতে আরো বেশি চমৎকার লাগবে। 


তৎকালীন এমসি কলেজের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা কর্মচারী বিশাল এই কাজটা বাস্তবায়ন করতে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। বিশেষ, করে ভাইস প্রিন্সিপাল পান্না রানী রায়, কলেজ শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক ও অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তোতিউর রহমান, গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দিলিপ চন্দ্র রায়, কলেজের প্রধান অফিস কর্মকার সঞ্জিত রায় অন্যতম। বিশেষ করে বিশাল এই কাজটি সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন  রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন।শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে মহতি এই কাজে সালেহ স্যার আমাকে রেখেছিলেন। 


গাছগুলো লাগানো যখন শেষ তখন  ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ রাত ৯ টার দিকে স্যার আমাকে কল দিয়ে বললেন আশরাফ সুযোগ করে একবার আমার সাথে দেখা কর। পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর  সকাল ১০ টার দিকে স্যারের অফিসে যাই৷ তখন স্যার বললেন, আলহামদুলিল্লাহ গাছ তো লাগানো শেষ, এখন এগুলো প্রচার করলে কেমন হয়?  উত্তরে বললাম, স্যার ভালোই হবে, সবাই জানলো, এবং উৎসাহ পেল।স্যার বললেন, তুমি দায়িত্ব নিয়ে  সবকিছু করবে, ঠিক আছে? জী স্যার বলে সম্মতি দিলাম। এরপর সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ যমুনা টেলিভিশনের  শাহিন আহমেদ ভাইকে নিয়ে সকাল ৯ টায় কলেজ যাই। পরে অধ্যক্ষ স্যারসহ একসাথে নাস্তা করি। এসময় গণিত বিভাগের দিলিপ স্যারও আসেন। এরপর স্যারের গাড়ি নিয়ে আমরা ৪ জন কলেজের বিভিন্ন জায়গার ছবি ভিডিও করি। সালেহ স্যার পুরোটা দিন নানান বিষয়ে গল্প করেন। স্যারকে এদিন খুব প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। গাছের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত অনেক ছবিও তুলা হয়। এরপর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে প্রতিবেদন লিখে পত্রিকাগুলোতে মেইল করি। অনেকগুলো জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় খবরটি গুরুত্ব দিয়ে ছাঁপা হয়েছিল।  স্যার দেখে অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। 


সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার সৈয়দপুর গ্রামে ১৯৬৩ সালে জন্ম নেওয়া প্রফেসর সালেহ আহমেদ ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।  গুণী এই শিক্ষক পৃথিবীতে নেই, কিন্তু তার চেষ্টায় লাগানো গাছগুলো আপন গতিতে বেড়ে উঠছে। প্রাণীকুলের অক্সিজেনের জোগান দিচ্ছে, ভারসাম্য বজায় রাখছে পরিবেশের।কলেজের টিলাগুলোকে দিয়েছে পূর্ণতা। কলেজের পাশ দিয়ে মাঝে মধ্যেই যখন ঘুরতে যাই, গাছগুলো দেখে খানিকটা থাকিয়ে সালেহ স্যারের কথা মনে হয়। গাছগুলো যখন বাতাসের সাথে দোল খায়, তখন মনে হয়  একজন অধ্যক্ষের স্বপ্নের পূর্ণতার গল্প। যার স্বপ্নের কারণেই আজকে হাজারো গাছে ভরে উঠেছে শতবর্ষী এমসি কলেজ।

শিহাব

×