ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

গ্রামের বিয়ের সেই কলা গাছের গেট বিলুপ্ত প্রায়

শরিফুল রোমান,মুকসুদপুর,গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০:২৯, ৪ জুলাই ২০২৫

গ্রামের বিয়ের সেই কলা গাছের গেট বিলুপ্ত প্রায়

বিলুপ্ত প্রায় কলা গাছের গেট। আগেকার গ্রামের বিয়ে মানেই কলা গাছের গেট। কিন্তু এখন আর চোখে পড়ে না। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের আগেকার সময়ের পুরাতন সংস্কৃতি। আগেকার সময় গ্রামের প্রতিটি বিয়ে বাড়িতে ছিল আমোদ-প্রমোদের আয়োজন। বাড়ির ছোট বড় সবাই আনন্দ, উল্লাসে ও হেঁসে খেলে বেড়াতো। সেই আশি নব্বই দশকে কোন বাড়িতে যখন বিয়ের হতো বরযাত্রীর জন্য কলাগাছ, বাঁশ ও রঙ্গীন কাগজ দিয়ে চমৎকারভাবে সাজানো হতো গেইট। বাজার থেকে বিভিন্ন রং এর রঙ্গীন কাগজ এনে তা কেটে চমৎকার শিকল ও বিভিন্ন প্রকার ফুল তৈরি করা হতো। বাঁশের মাথার সাথে দড়ি বাধা হতো। দড়ির সাথে থাকতো রঙ্গীন কাগজের নিশান। তখন হয়তো বর্তমান সময়ের মত মানুষের হাতে এত বেশি টাকা ছিলো না কিন্তু ভালোবাসা, আবেগ, সহমর্মিতা, দরদ ছিল। তখনকার সময়ে গ্রামের প্রায় বিয়ে বাড়িতেই মা, খালা, চাচি,ভাবি বড় বোন বুবুরা মিলে গাইতো বিয়ের গান। সপ্তাহ ব্যাপী বানানো হতো নানা ধরনের পিঠা, জামাই পিঠা,কাটাকোটি পিঠা, নকশি পিঠা, কোন বাড়িতে বাজতো কলের বাশি রেকর্ডিং।

ইতিহাস বলে খ্রিষ্টপূর্ব ৮ হাজার বছর আগেও কলাগাছ পাওয়া যেত। পৃথিবীর ১০৭টি দেশে কলাগাছ জন্মায়। কলাগাছ কয়েক প্রকার হয়ে থাকে যেমন সবরি, মদনা, সাগর, আনাজি, বীচি কলা, কবরি কলা প্রভৃতি। কলাগাছের প্রয়োজনীয়তা বললে শেষ হবার নয়। কলাগাছের ফুল, ফল, কান্ড, মোচা সবকিছুই খাওয়া যায়। পাতা ব্যবহার করা হয় বাসন হিসেবে। কলাগাছ হাতির প্রধান খাদ্য। কলা বানর মহারাজের প্রিয় খাদ্য। কলাগাছ না হলে গনেশ ঠাকুরের কলাবৌ হবে কে? কলা ছাড়া পুজোর ঘটটি যেন ভালো লাগে না। পুজোর মধ্যে কলাগাছের মাইজ পাতা না হলে কেমন জানি অসম্পূর্ণ মনে হয়। কলাগাছের ভাদাইল (থোড়) ছারা নিরামিষটিও মজা হয় না। দুধ-ভাতে কলা খেলে পেটটি ভরে যায়।

বর পক্ষ কনে পক্ষের বাড়িতে সড়ক পথে গেলে সাড়ি বেধে ছাতা মাথায় দিয়ে বরযাত্রী যেতো। আবার নদী পথে নৌকা যোগে ( কেরাই সৌকা)গেলে নৌকার ছাদে চারদিকে কলাগাছে রঙিন কাগজ দিয়ে নিশান দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হত। তারপর নৌকায় মাইক বাজিয়ে বর পক্ষ কনে পক্ষের বাড়িতে যেত। খাওয়া দাওয়ার পর বিয়ে হতো গভীর রাতে। আড়াই দিন থাকতে হতো কনের বাড়িতে। বিয়ের পরের দিন ছিল কাল রাত্রি সেই দিন বর কনে সাক্ষাততো দুরের কথা মুখ দর্শন পর্যন্ত হতো না।

কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির ছোয়ায় গেইট নির্মান করা হয় ডেকোরেটরের মাধ্যমে। দুই বাড়িতে আলিশ্বান গেইট নির্মান করা হলেও আগেকার বিয়ে বাড়ির ঐতিহ্য কলাগাছের গেইট এখন আর চোখে পড়ে না। সেই সময় কলা গাছের গেইট সাজানোর জন্য নানান রঙ্গের রঙ্গিন কাগজ দিয়ে নকশা তৈরী করে গেইট সাজানো হতো। কনে সাজানোর জন্য বাজার থেকে আলতা,রঙ্গিন ফিতা আনা হতো। বর পক্ষ ও কনে পক্ষের বাড়ির বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকে দেখা যেত সন্ধ্যা হলে গাইত বিয়ের গীত। বিয়ের বরযাত্রি আসলে বাজি ফোটানো হত ধুমধাম।আবার বিয়ে হয়ে গেলে বাজি ফুটানো হতো ধুমধাম। এমনো শুনা যেতো বাজির আওয়াজ বেশী না হলে ভবিষৎতে সন্তান নাকি কালা হবে। বর্তমানে বিউটি পার্লার ও ডেকোরেটরের ভীরে গ্রাম বাংলার বিয়ের,ঐতিহ্য ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে।
এক সময় বিয়ে বাড়িতে গেইট তৈরীর জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে মোটা,লম্বা আকারের কলা গাছ খুঁজে বের করে তা কেটে বরের উপহারের আশায় সকলে মিলে এই গেইট তৈরীর জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজে লেগে পড়তো। তখন বিয়ে বাড়ি মানেই উৎসব। এখন সেই উৎসব নেই বললেই চলে। 

সমাসেবী রুদ্র কমল বলেন, বর্তমান বিয়ের উৎসবে গায়ে হলুদের নামে বর ও কনের বাড়িতে চলে উচ্চ শব্দে ডিজে গান। এতে
আনন্দের চেয়ে কৃত্রিমতাই বেশী প্রধান্য লক্ষ্য করা যায়।

Jahan

×