ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

“ছাত্র জনতার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই” — জুলাইয়ের হিরো রিকশাওয়ালারা

প্রকাশিত: ২০:২০, ৪ জুলাই ২০২৫

“ছাত্র জনতার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই” — জুলাইয়ের হিরো রিকশাওয়ালারা

ছবি: সংগৃহীত।

২০২৪ সালের সেই উত্তাল জুলাইয়ের স্মৃতিতে আজও রক্ত ঝরায় হৃদয়। তবে এই স্মৃতিচারণ শুধু শিক্ষার্থী বা রাজনৈতিক কর্মীদের ঘিরে নয়, এর এক অনন্য অংশীদার ছিলেন—আমাদের রিকশাচালক ভাইয়েরা। ঢাকার রাজপথে কিংবা দেশের প্রত্যন্ত শহরে, যেখানেই শিক্ষার্থীরা গণঅভ্যুত্থানে নেমেছিলেন, সেখানেই দেখা গিয়েছিল একদল নির্ভীক রিকশাচালককে—কেউ সামনে থেকে স্লোগান তুলেছেন, কেউ আহতদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন, কেউ বা গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিয়েছেন।

এক নজরে সাধারণ মানুষ, কিন্তু তাদের সাহসিকতায় ছিলেন অসাধারণ। ঢাকার একটি সড়কে এক রিকশাচালককে দেখা যায় রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সম্মান জানাতে সালাম দিতে। তাঁর কপালে বাঁধা ছিল লাল-সবুজের পতাকা। সে ছবি ভাইরাল হয় মুহূর্তেই। কিন্তু ছবির বাইরেও ছিল এক করুণ বাস্তবতা—এই আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে অন্তত ২৪ জন রিকশাচালক প্রাণ হারিয়েছেন। অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এই তালিকা তৈরি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রফিক আমিন, যা পরবর্তীতে স্থান পায় ‘জুলাই ম্যাসাকার আর্কাইভ’-এ।

রিকশাওয়ালারা শুধু স্লোগান আর উপস্থিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। বহু রিকশাচালক আহত ছাত্রদের রিকশায় তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, পুলিশি হামলা থেকে বাঁচাতে সাহায্য করেছেন। অথচ এই সহযোদ্ধা শ্রেণিটিকে আন্দোলনের পর কঠিন মূল্য দিতে হয়। বহু রিকশাচালককে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তাদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। অনেকেই আহত হয়ে পঙ্গু হয়েছেন। কেউ কেউ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন—তাদের মৃত্যু এখন পরিবারগুলোকে নিঃস্ব করে দিয়েছে।

এই অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম জানান, “আমরা ইতিমধ্যে প্রতি সপ্তাহে ২০০টি পরিবারকে সহায়তা দেওয়া শুরু করেছি। কেউ বাদ যাবে না। ঢাকা থেকে শুরু করে আটটি বিভাগে আমরা শহীদ পরিবারগুলোকে খুঁজে বের করে সহযোগিতা করব। রিকশাচালকেরাও এই আন্দোলনের শহীদ, আমরা তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।”

এ আন্দোলন কেবল ছাত্রদের নয়, এটি ছিল শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণে এক সাম্যবাদী স্বপ্নের উত্থান। ১৫ জুলাই ঢাকায় রিকশাচালকদের মিছিলে উঠেছিল গর্জে ওঠা স্লোগান—“ছাত্র ভাই ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।” ইতিহাসের শ্রেণি চরিত্র তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে—যখন দেখা যায়, সবচেয়ে অবহেলিত মানুষগুলোই হয়ে ওঠে সবচেয়ে সাহসী।

তাদের গল্প ইতিহাসের পাতায় যতটা নেই, মানুষের মনে ততটাই গভীর। এই সাহসী রিকশাওয়ালারাই সেই ইতিহাসের নীরব নায়ক, যারা শুধু চাকা ঘোরাননি—ঘোরাতে চেয়েছিলেন একটি শোষণহীন নতুন ভবিষ্যতের চাকা।

নুসরাত

×