ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আলকাট্রাজ: সাগরের বুকে এক নিঃসঙ্গ জেলখানা

টি এম মারুফ জামান মাহী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী

প্রকাশিত: ২০:২৫, ১৩ জুন ২০২৫

আলকাট্রাজ: সাগরের বুকে এক নিঃসঙ্গ জেলখানা

ছবি: সংগৃহীত

সাগরের বুক চিরে দাঁড়িয়ে এক রহস্যময় দ্বীপ। চারপাশে উত্তাল স্রোত, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা আর মাঝে এক পুরাতন প্রাসাদ যা আসলে ছিল আমেরিকার সবচেয়ে কুখ্যাত জেলখানা আলকাট্রাজ।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো উপসাগরে অবস্থিত এই ছোট দ্বীপটি একসময় ছিল অপরাধী জগতের ভয়ংকর নামগুলোর গন্তব্য। তবে আলকাট্রাজ কেবল কারাগারই নয়, এটি আজ ইতিহাস, রহস্য এবং সাহসিকতার প্রতীক। এটি একদিকে যেমন নিরাপত্তার নিদর্শন, অন্যদিকে তেমনি এটি দুঃসাহসিক পালানোর গল্পের চিরন্তন থ্রিল।

আলকাট্রাজের ইতিহাস শুরু হয়েছিল ১৮৫০ সালে, যখন এটি একটি সামরিক দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯৩৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এটিকে ফেডারেল পেনিটেনশিয়ারি হিসেবে ঘোষণা করে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল দেশের সবচেয়ে ভয়ংকর এবং পালানোর ঝুঁকিপূর্ণ কয়েদিদের এখানে রাখা হবে।এই দ্বীপ এতটাই বিচ্ছিন্ন ছিল যে, কোনো বন্দি সাঁতরে উপকূলে পৌঁছতে পারবে না এমন বিশ্বাসই ছিল এর ভিত্তি। প্রকৃতপক্ষে, ঠান্ডা সাগরের পানি, প্রবল স্রোত এবং বিশাল দূরত্ব এই বিশ্বাসকে যুক্তিসঙ্গত করেছিল।


আলকাট্রাজে স্থান পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আলোচিত অপরাধীরা। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন:

আল কাপোনে: শিকাগোর মাফিয়া ডন, কর ফাঁকি মামলায় বন্দি হন এবং আলকাট্রাজে পাঠানো হয়।

জর্জ “মেশিন গান” কেলি: অপহরণ ও গ্যাং অপরাধে দণ্ডিত কুখ্যাত অপরাধী।

রবার্ট স্ট্রাউড: 'বার্ডম্যান অফ আলকাট্রাজ' নামে পরিচিত, যিনি জেলে বসেই পাখি পালন ও চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করতেন।

বন্দিদের জন্য এখানে ছিল সীমিত সুযোগ-সুবিধা। প্রতিদিন ২৩ ঘণ্টা বন্দি অবস্থায় কাটাত, একঘণ্টা মুক্ত আকাশের নিচে হাঁটার সুযোগ পেত। এখানে ছিল না কোনো টেলিভিশন বা বিনোদনের উপায়। শুধুই বন্দিত্ব, নিঃসঙ্গতা আর শাস্তির একক গন্তব্য।


পালানোর চেষ্টা:

৩৪ বছরের কার্যকালীন সময়ে মোট ৩৬ জন কয়েদি পালানোর চেষ্টা করেছিল, যাদের মধ্যে কেউই নিশ্চিতভাবে সফল হয়নি এমনটাই বলা হয়। তবে সবচেয়ে রহস্যময় এবং সিনেম্যাটিক ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬২ সালে।ফ্র্যাঙ্ক মরিস এবং অ্যাঙ্গলিন ভাইরা (জন ও ক্ল্যারেন্স) জেলের পেছনের দেয়াল খুঁড়ে, নিজেদের মতো করে তৈরি করা রেইনকোট দিয়ে ভাসমান নৌকা বানিয়ে সমুদ্রে নেমে পড়েন। এদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ বলেন তারা মারা গেছেন, কেউ বলেন তারা পালিয়ে গিয়ে বেঁচে ছিলেন। আজও এই ঘটনা নিয়ে রয়েছে অগণিত বই, চলচ্চিত্র এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।


১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আলকাট্রাজ জেলটি বন্ধ করে দেয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় এই জেল পরিচালনার খরচ ছিল অত্যন্ত বেশি। দ্বীপে পানি, খাবার, বিদ্যুৎ, এমনকি কয়েদিদের ব্যবস্থাপনা সবই ছিল ব্যয়বহুল। তদুপরি, পুরাতন স্থাপনা হওয়ায় এটি রক্ষণাবেক্ষণ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল।

আজ আলকাট্রাজ আর কোনো কারাগার নয়। এটি জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থান (National Historic Landmark) হিসেবে ঘোষিত হয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এখানে ভিড় করেন।

দর্শনার্থীরা এখনো দেখতে পান সেই নির্জন সেল, যেখানে আল কাপোনে ছিলেন। দেখতে পান সেই সুরঙ্গ, যেখান দিয়ে পালিয়েছিলেন মরিস ও অ্যাঙ্গলিন ভাইরা। আছে প্রহরীর অফিস, মেঘলা দিনগুলোতে কুয়াশায় ডুবে থাকা সেই অপার্থিব সৌন্দর্য যেটি যেন হিমশীতল বন্দিত্বের গল্প বলে চলে।


আলকাট্রাজ নিয়ে অসংখ্য বই, সিনেমা ও ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে:

Escape from Alcatraz (1979): ফ্র্যাঙ্ক মরিসের পালানোর ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত, ক্লিন্ট ইস্টউড অভিনীত।

The Rock (1996): অ্যাকশনধর্মী জনপ্রিয় চলচ্চিত্র যেখানে আলকাট্রাজকে কেন্দ্র করেই ঘটনা আবর্তিত হয়।

আলকাট্রাজ কেবল এক নিছক জেলখানা ছিল না। এটি ছিল এক মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাগার যেখানে মানুষের মনোবল, সাহস, নিঃসঙ্গতা, শাস্তি এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা একসঙ্গে যুদ্ধ করত।

সাগরের বুক চিরে আজও দাঁড়িয়ে থাকা এই নিঃসঙ্গ কারাগার যেন স্মরণ করিয়ে দেয় সবচেয়ে শক্ত নিরাপত্তাও মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে রুখে রাখতে পারে না।

Mily

×