ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শৈশব হয় ছিন্ন, স্বপ্ন হয় স্তব্ধ

কেনই বা ৫১% কিশোরীর বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই?

মেহেদী হাসান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ

প্রকাশিত: ১৫:০৭, ১৩ জুন ২০২৫

কেনই বা ৫১% কিশোরীর বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই?

চাঁদপুরের একটি গ্রামে ক্লাস নাইনের শিক্ষার্থী আয়শার চোখে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন। কিন্তু এক সন্ধ্যায়, চুপিচুপি তাকে বরের গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। কারণ?
“মেয়েকে এখন বিয়ে না দিলে পরে হয়তো কেউ বিয়ে করবে না।” — বলেছিলেন তার বাবা।

এটা শুধু আয়শার গল্প নয়। UNICEF ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে—বাংলাদেশে এখনও প্রতি দুইজন কিশোরীর মধ্যে একজনের বিয়ে হয় আঠারো বছরের আগেই। একবিংশ শতাব্দীর ২০২৫ সালেও, আমরা একটি পুরনো শিকলে বাঁধা ভবিষ্যৎ নিয়ে বসবাস করছি।


সংখ্যার ভাষায় সমস্যার গভীরতা
৫১% মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর হওয়ার আগেই
 বাংলাদেশ বিশ্বে বাল্যবিবাহে শীর্ষ দশে
UNICEF (২০২৩): প্রায় ৩ কোটি ৪৫ লাখ নারী বাল্যবিবাহের শিকার
 MICS (২০১৯): ২০–২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১.৪% কিশোরী বয়সেই বিবাহিত


এ তথ্যগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়—প্রতিটি সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া একেকটি স্কুলব্যাগ, একটি বিসিএস স্বপ্ন, অথবা এক নিরীহ হাসির চিরতরে থেমে যাওয়া।

কেন এই বাল্যবিবাহ এখনো থামছে না?

 দারিদ্র্য – “কম খরচে মেয়ে বিদায়” ভাবনার ফাঁদ
অজ্ঞতা ও শিক্ষার অভাব – আইন জানে না, স্বাস্থ্যঝুঁকি বোঝে না
সামাজিক কুসংস্কার – "মেয়ের বয়স বাড়ছে, দ্রুত বিয়ে দাও"
 নিরাপত্তাহীনতা – যৌন হয়রানির আশঙ্কায় বাবা-মা মেয়েকে ‘রক্ষা’ করতে চান
 ধর্মীয় বা সামাজিক চাপ – ধর্মকে ভুল ব্যাখ্যা করে বিয়েকে ‘ফরজ’ বানিয়ে ফেলে।
 শেষ কোথায়? বাল্যবিবাহ মানেই জীবন ঝুঁকিতে

 মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যায়
নবজাতকের স্বাস্থ্য দুর্বল হয়
 শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়
পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়
 অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরতা হারায়, তৈরি হয় দারিদ্র্যচক্র

১৮ বছরের আগেই বিয়ে মানে, একজন মানুষকে ৩০ বছরের দায়িত্ব ১৩ বছরের অভিজ্ঞতায় তুলে দেওয়া।” – মানবাধিকার গবেষক

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে প্রণীত “বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন” অনুযায়ী—

১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে বেআইনি

শাস্তি রয়েছে বর, কনে, অভিভাবক ও কাজীর জন্য

তবে ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ মেয়ের স্বার্থে ব্যতিক্রম রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে


এই ব্যতিক্রমধারা আইনকে করেছে দাঁতের নিচে লবণ—আছে, কিন্তু কার্যকর নয়।


আশার আলো: কিছু ভালো দিকও আছে

 মেয়েদের জন্য সুন্দরবন ঘেঁষা স্কুলে স্কলারশিপ প্রোগ্রাম
অনলাইন বয়স যাচাই সিস্টেম চালুর উদ্যোগ
 গণমাধ্যম, নাটক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন
 কিছু ইমাম ও পুরোহিতও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন


 ‘না’ বলার সাহস গড়ে তুলতে হবে সমাজকে

আজকে যদি আমরা একজন কিশোরীকে তার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ না দিই, কাল সে কোনো জাতীয় পুরস্কারজয়ী শিক্ষক বা গবেষক হতে পারবে না।
আজ তাকে আটকে রাখলে কাল সমাজ থেমে যাবে। তাই, বাল্যবিবাহ বন্ধের প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে—

 শিক্ষায় বিনিয়োগ,মেয়েদের মতামতের প্রতি সম্মান,আইনের কঠোর প্রয়োগ,
 সচেতনতা বাড়ানো।
কন্যা কোনো বোঝা নয়, কন্যা সমাজের সমান অংশীদার।" – এই বার্তাটা শুধু পোস্টারে নয়, ঘরে–ঘরে পৌঁছাতে হবে।

Jahan

×