ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইব্রাহিম নোমান

শিক্ষার্থীদের তৈরি ॥ পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি

প্রকাশিত: ০৪:২২, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

শিক্ষার্থীদের তৈরি ॥ পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি

গাড়ির সর্বমোট খরচ মাত্র এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা। এই টাকায় গাড়ি পাওয়া কল্পনারও অতীত। গাড়িটা আবার পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী। একটি ১৫০০ সিসি গাড়ি লিটারে যেখানে চলে ১৭-২০ কিলোমিটার সেখানে ১০০ সিসির এই গাড়িটি চলবে ২৮-৩৫ কিলোমিটার। পাশাপাশি চলবে চার্জিত ব্যাটারিতে। সর্বোচ্চ গতি উঠবে ইঞ্জিনে ঘণ্টায় ৪০ কিলো-ঘণ্টা আর মোটরে ৫০-৫৫ কিলো-ঘণ্টা। এমনই এক বিশেষ গাড়ি তৈরি করেছেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির টিম মটোমিস্টের (এমআইএসটি) কয়েকজন ছাত্র। এমআইএসটির যন্ত্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও টিম মটোমিস্টের ব্যবস্থাপক মোঃ মঞ্জুর রহমান শাকিল। চলুন তার নিজের মুখেই শুনি এ বিশেষ গাড়ি তৈরির পথচলা সম্পর্কেÑ ছোটবেলায় নতুন কোন খেলনা হাতে পাবার পর আমার প্রথম কাজ ছিল তা ভেঙ্গে দেখা ভেতরে কি কি আছে আর দ্বিতীয় কাজ ছিল তা ঠিক করা। ঠিক করতে গিয়ে যখন হিমশিম খেতাম তখন থেকেই ইচ্ছা জাগে বড় হয়ে মেকানিক হব। স্বপ্নটা বাস্তবতার মুখ দেখে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)তে চান্স পাবার পর। প্রথম পছন্দের বিষয় হিসেবে দিলাম যন্ত্রকৌশল বিভাগকে, পেয়েও গেলাম। সেই থেকে সঙ্গী যন্ত্রকৌশল। বিষয়টার কাঠিন্যটার মধ্য যখন দেড় বছর পার করলাম, একদিন হঠাৎ সাকিব নামের এক বন্ধু আমাকে মটোমিস্ট নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানায়। মটোমিস্ট হলো এমআইএসটি-এর একমাত্র অটোমোবাইল ক্লাব যা ২০১৩ সালে এমই-৮ ব্যাচের দ্বারা প্রথম গাড়ি তৈরির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর আমি কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ছুটলাম ক্যাম্পাসের সেরা অটোমোবাইল দক্ষ এমই-১০ এর রায়হান ভাইয়ের কাছে। তার আগ্রহে এমই-১২ এর ১২ জন ও রায়হান ভাই মিলে গঠন করি টিম মটোমিস্ট। রায়হান ভাইয়ের তত্ত্ব¡াবধায়নে আমরা তৈরি করলাম আমাদের প্রথম, মটোমিস্ট-এর তৃতীয় গাড়ি। তবে প্রথমে এ গাড়িতে তেমন কোন সাফল্য না আসায় ভেঙ্গে পড়ি। সাহস যোগান রায়হান ভাই। তিনি আবার স্বপ্ন দেখান অক্টোবর ’১৫-তে গাড়ি নকশা প্রতিযোগিতার আর ডিসেম্বরে গাড়ি তৈরির প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার। অবশেষে আসে অক্টোবর। প্রতিযোগিতার দিনেও ছিল পরীক্ষা, তবুও পরীক্ষা উপেক্ষা করে এক রাতে রায়হান ভাই, আসরার, মুশফিক ও অতুলকে নিয়ে তৈরি গাড়ি ডিজাইন ও প্রেজেন্টেশন। আসে সাফল্য। অর্জন করি জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা আয়োজিত ‘ভেহিক্যাল ডিজাইন কম্পিটিশন’-১৫) এ প্রথম রানার্স আপ পুরস্কার। বেড়ে যায় আত্মবিশ্বাস আমাদের। আবারও ১৩ জন সদস্য মিলে কাজ শুরু করি গাড়ি বানানোর। টার্গেট ইকোরান ’১৫। ইকোরান হলো শিক্ষার্থীদের তৈরি জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি বানানোর প্রতিযোগিতা যা প্রতিবছর জাইকা আয়োজন করে থাকে। কাজে বাধা আসে টার্ম ফাইনালের জন্য। প্রায় দেড় মাস পর পরীক্ষা শেষে নতুন টিম নিয়ে কাজ শুরু করি। টিমে ছিলাম আমি, রায়হান ভাই, সাকিব, প্রাণ, সিয়াম, আসরার, রৌফি, ইশ্মি, রাফি, মুশফিক, ফয়সাল, জিকুরুল্লাহ ও আসিফ। প্রথম বাধা আবারও আর্থিক দিকটি। আমি ছুটতে শুরু করলাম পৃষ্ঠপোষকতার খোঁজে। কিন্তু বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যর বিপুল প্রচারে ব্যস্ত, এ ধরনের কাজে তারা বিনিয়োগে অনাগ্রহী। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লাম। এমন সময় একটা ওয়ালটন ইঞ্জিন ও দশ হাজার টাকা নিয়ে এগিয়ে আসেন যন্ত্রকৌশল ডিপার্টমেন্টের ডিন ও হেড ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লুতফর স্যার। এরপর নিজেরা টাকা তুলে আবার কাজ শুরু করলাম। অর্থের অপ্রতুলতার জন্য পরিবর্তন আনতে হয় আগের ডিজাইনে। ংড়ষরফড়িৎশং-এ অল্পবিস্তর জানাশোনার জন্য ডিজাইনের দায়িত্ব পড়ে আমার কাঁধে। এক রাতে দাঁড় করাই চেসিস আর বডির ডিজাইন। নির্ধারিত কার্যদিবস ১৮ দিন থেকে নেমে আসে ১০ দিন। কাজ এখন প্রায় পুরোটাই বাকি। ১৩ জন সদস্যের রাত দিনের কঠোর পরিশ্রমে রূপ নিতে শুরু করে আমাদের গাড়ি। ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের যাত্রা বরিশালে ইকোরানের জন্য। বিকেলের মধ্য কাজ শেষ হলো চেসিস আর ওয়ারিংয়ের। এখনও বাকি বডি ও ফেব্রিকেশনের কাজ। বাকি মাত্র একটি রাত। বহু কষ্টে একটি ওয়ার্কশপ রাতে খুলে রাখার ব্যবস্থা করলাম। আট সদস্য বিশিষ্ট একটি দলের কাজ চালাই সারারাত জেগে। কাজ সম্পন্ন হয় ভোরবেলায়। বিজয়ের হাসি আমাদের চোখেমুখে। তৈরি হয় বাংলাদেশের প্রথম হাইব্রিড কার। হাইব্রিড কার হলো এমন একটি গাড়ি যা ইঞ্জিনের পাশাপাশি মোটরেও চলে। নির্গত গ্যাস কম বের হওয়াতে গাড়িটি পরিবেশবান্ধব। আমাদের হাসি বিফলে যায়নি। শুধু ইঞ্জিনের মাধ্যমে গাড়ি চালিয়ে অর্জন করি আমরা বাংলাদেশের একমাত্র অটোমোবাইলের প্রতিযোগিতা ইকোরান ’১৫-তে চার চাকা ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় রানার্সআপ পুরস্কার। হাইব্রিড পদ্ধতিতে চালিয়ে অর্জন করি শ্রেষ্ঠ নতুনত্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবনী পুরস্কার। গেল বছরের ১৮ ডিসেম্বর জাইকা দ্বিতীয়বারের মতো ইকোরান আয়োজন করে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অটোমোবাইল তৈরির কারখানা কল্পনা করাটা অযৌক্তিক মনে হলেও আমরা সেই কল্পনাটাকে বাস্তবায়নের মতো কঠিন কাজ সাহস করে হাতে নিতে চাই। আমাদের টার্গেট কম খরচে দেশের মানুষের কাছে গাড়ি পৌঁছে দেয়া। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন ও মোটর ব্যবহার করে বেশি আসনবিশিষ্ট গাড়ি বানানো সম্ভব। ঢাকাতে প্রয়োজনের তুলনায় গাড়ি বেশি হওয়ায় জেলা শহরগুলোতে যদি এর বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভব হয়, তাহলে আশা করি এই গাড়ির দ্বারা দেশবাসী উপকৃত হবেন।
×