
কলাপাড়া : বর্ষার কুয়াকাটায় গোসলে মত্ত পর্যটকরা
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের এখন বিশ্বজোড়া পরিচিতি। রয়েছে স্বকীয়তার আলাদা সুখ্যাতি। দীর্ঘ সৈকতের যে কোনো স্পটে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় দেখা সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য। আর সকালে একই সৈকতের গঙ্গামতি লেকপাড়ের বেলাভূমে দাঁড়িয়ে দেখা যায় অপূর্ব মনোলোভা সূর্যোদয়ের বিরল দৃশ্য। এই দুর্লভ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ্য কুয়াকাটায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে পর্যটকের পদচারণা। পর্যটক দর্শনার্থীর হৈ হুল্লোর আর উৎসবে মুখরিত থাকে দীর্ঘ সৈকত। আর মনোরম এ সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর বাড়ছে পর্যটকের আগমন। শীতে তো থাকছে উপচে পড়া ভিড়। এখন বর্ষা মৌসুমেও বিপুল সংখ্যক পর্যটক দর্শনার্থীর আগমন ঘটছে কুয়াকাটায়।
পর্যটকের কাছে কুয়কাটায় শীতের শান্ত সাগরের চেয়ে বর্ষার উত্তাল সাগর অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। খুঁজে পায় যেন সাগরের আসল চেহারা। কখনো ভয়াল ঢেউয়ের তাণ্ডব, আবার কখনো শান্ত। মুহূর্তেই পাল্টে যায় চেহারা। এই গর্জন, আবার থমকে যাওয়া। আর তাইতো বর্ষায় এখানে বাড়ছে পর্যটক দর্শনার্থীর ভিড়। উত্তাল ঢেউরাশির সঙ্গে মেতে ওঠা। সাগরের পানিতে নেমে বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের সঙ্গে নাচানাচি, মিতালি করা। প্রতিদিন শত শত পর্যটক এখন বেছে নিচ্ছে বর্ষা মৌসুমকে। কারণ পাহাড়সম উঁচু ঢেউ অনবরত কিনারে এসে আঘাত হানছে বেলাভূমে। আর কিনারে আসার আগেই সেই উত্তাল ঢেউয়ের তালে তালে কখনো ডুব দিয়ে বাধা দেওয়া। আবার কখনো ঢেউয়ের আঘাত থেকে এড়ানোর জন্য ডুব দিয়ে ক্ষণিকের জন্য নিজেকে আড়াল করা। বার বার, বহুবার; কত শতবার এমন খেলায় মেতে ওঠা। পর্যটকের বিরামহীন এমনসব দৃশ্য এখন কুয়াকাটা সৈকত সংলগ্ন উত্তাল সাগরে দেখা মেলে। এমন উপভোগ্য সুযোগ শীতে মেলে না; পর্যটক দর্শনার্থীর এমনই অভিমত। বিশেষ করে পারিবারিকভাবে একটু নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য বেছে নেওয়া হচ্ছে বর্ষার মৌসুমকে। আর সাগরের পানি লোনা থাকে না, তাই গোসল করতে আর কারও কোনো সংশয় থাকে না। যে সমস্যার কথা ভাবতে হয় শীত মৌসুমে। কারণ মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানি শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। পারিবারিকভাবে এসে শিশুদের নিয়ে এই আশঙ্কা বর্ষায় থাকছে না।
বর্ষার সাগর যেন অচেনা লাগে। ভয়াল উত্তাল। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আকাশে ওড়া চিলের মতো শো শো করে ছুটে চলা কালো মেঘের আনাগোনা। অনবরত হাল্কা মৌসুমি বায়ূর হানা। যেন আলাদা এক অনুভূতি এনে দেয় মনেপ্রাণে। আর আগতরা সেই সুযোগটিকে হাতছাড়া করতে চাইছেন না। পর্যটকরা ছুটে আসছেন বর্ষাস্নাত কুয়াকাটায়। সৈকতে দেখা মেলে ইলিশ শিকারিদের যুদ্ধ। সাগরের ভয়াল ঢেউ রাশির সঙ্গে এই যুদ্ধ চলছে জীবিকার। ছোট্ট ডিঙি নৌকায় চড়ে চলে যায় জেলেরা অগভীর সমুদ্রে (৩-৪ কিমি দূরে) পাতা জালের কাছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে মনে হয়- এই বুঝি হারিয়ে গেল জেলের নৌকাটি, মনে হবে ডুবে গেল। কিন্তু না, আবার উঁকি দিয়ে উঠছে। এক ঢেউ পেরিয়ে আরেক ঢেউ, এভাবেই এগিয়ে যায় গন্তব্যে। এদের বলা হয় খুটা জেলে।
প্রচণ্ড ভয়াল, অথচ সীমাহীন সুন্দর দৃশ্য শুধুমাত্র বর্ষায় অবলোকনের সুযোগ রয়েছে। আর কখনো নয়। বীচের বেলাভূমিও থাকছে অতি স্বচ্ছ। এক কথায় নিট অ্যান্ড ক্লীন। যেন চোখে দেখা যায় কালো চিক চিক করা বালুকনাটি পর্যন্ত। খালি পায়ে হাঁটার সেই আসল সুখের অনুভূতি, সেটি কিন্তু বর্ষায় উপলব্ধি করা যায়। কুয়াকাটা সৈকতের শূন্য পয়েন্ট থেকে পুবে কিংবা পশ্চিমে যতদুর বীচের পরিধি সবটাই যেন এক হয়ে যায়। কোথাও কোন অমলিন দৃশ্য চোখে পড়বে না। যারা হঠাৎ করে প্রথমবার বর্ষায় কুয়াকাটায় বেড়াতে আসবেন তাদের কাছে মনে হবে এ যেন অচেনা কুয়াকাটা দেখছেন।
এতো গেল শুধু সৈকতের বেলাভূমের আর সাগরের বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ার দৃশ্য। বীচ ঘেষা তাল-নারকেল গাছগুলোকে দেখলে মনে হবে চিরঞ্জীব হয়ে গাড় সবুজের রং মিশে দাঁড়িয়ে আছে। শীতে যেসব গাছকে মনে হয় বার্ধক্যের কারণে কাহিল, বিবর্ণ। সেই গাছেরা আভা ছড়াচ্ছে চিরসবুজের সতেজতায়। হাঁটতে হাঁটতে একইভাবে ঝাউ বাগান। কড়ই বাগান। ম্যানগ্রোভ-ননম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, সবশেষ গঙ্গামতির নয়নাভিরাম লেক। যেটি শীতের দিনে মনে হয় সোঁতা খাল। আর বর্ষায় ফিরে আসে যৌবনের গান নিয়ে। তবে ভয়াল সাগর গাছগুলোর অনেক গিলে খেয়েছে তার ভয়াল থাবায়। খালি পায়ে হাঁটলে মনপ্রাণ যায় শান্ত হয়ে যায়। ভয় থাকে না, তপ্ত বালুতে পায়ে বিরক্তিকর অবস্থার। কারণ বালুর আস্তরণ অনেক শীতল থাকে। গা ঝিম ঝিম করে, মাথা পর্যন্ত যেন উপলব্ধি করা যায়। সেই অনুভূতি শুধু বর্ষায় বোঝা যায়। শুধু একটু শঙ্কা রয়েছে যদি আকাশ মেঘলা থাকে হয়তো যাবে না, সন্ধ্যার সূর্যাস্ত কিংবা সমুদ্রস্নাত সুর্যোদয়কে। কিন্তু লটারির মতো ‘যদি লাইগ্যা যায়’ তো ফাটাফাটি। একেবারে স্বচ্ছ, টলমলে পানির মধ্য থেকে ডিমের কুসুমের মতো সমুদ্রের বুক চিরে বের হচ্ছে সূর্যের লাল আভা। অসম্ভব সুন্দরের সে দৃশ্য। তবে শীতকালের মতো কুয়াশায় আচ্ছন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে না এমন দৃশ্য অবলোকনে। তাইতো শীতের চেয়ে পর্যটকের কাছে এখন বর্ষার কুয়াকাটা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ক্রমশ বাড়ছে পর্যটক দর্শনার্থীর সংখ্যা। ১০ বছর আগেও বর্ষায় কুয়াকাটা সৈকত খাঁ খাঁ করত। কোথাও কোনো পর্যটকের পদচারণা থাকত না। চোখে পড়ত না জেলে ছাড়া কাউকে। জেলে সোহরাব হোসেনের এমন মন্তব্য। সেই সঙ্গে আবাসিক হোটেল ব্যবসা ছিল ভয়াবহ মন্দা। অনেকের থাকত বন্ধ।
কিন্তু ওই চিত্র এখন পাল্টে গেছে। এখন আর ওই দুরবস্থা নেই। বর্ষা মৌসুমে ৩০-৫০ শতাংশ কক্ষ ভাড়া হয় প্রত্যেক হোটেলের। আসছে পর্যটক দর্শনার্থী। বর্ষায় আবাসন সমস্যা থাকে না। এ কারণে পরিচিত পর্যটকরা বেছে নেয় বর্ষা মৌসুমকে। অনায়াসে, আগাম বুকিং ছাড়াই সিট পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়। ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় ভাড়ার ক্ষেত্রে। তাও আবার মিনিমাম ৩০ পার্সেন্ট থেকে ৫০ পার্সেন্ট পর্যন্ত। একই সুযোগ খাবার হোটেলগুলোতে। সেখানেও শীত মৌসুমের মতো গলাকাটা দাম নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কাস্টমার কম। তাই খাতির করে, আপ্যায়ন করায় হোটেল মালিকরা। দামও নাগালের মধ্যে থাকছে। এছাড়া পরিবহন খাতেও বাড়তি টাকা গুনতে হয় না। কারণ পরিবহনে যাত্রীসংখ্যা শীত মৌসুমের চেয়ে কম থাকছে। এখন বর্ষায় কুয়াকাটায় আসার কারণে আগের মতো বঞ্চিত হতে হয় না মিশ্রিপাড়ার রাখাইনদের বিশাল বুদ্ধমূর্তি দর্শন থেকে। সড়কটি পাকা হয়ে গেছে। নির্বিঘ্নে আমুদে মেজাজ নিয়ে আপনি সপরিবারে ঘুরে আসতে পারবেন। শুধু তাই নয়, গঙ্গামতি পর্যন্ত ঘুরে আসতে কোনো সমস্যা নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা কেটে গেছে। সেখানের মনোরম লেকের ওপর দিয়ে যোগাযোগের জন্য উন্নতমানের গার্ডার ব্রিজ করা হয়েছে। লেকটি দেখার সুযোগ রয়েছে। ইচ্ছে করলে গঙ্গামতি সৈকতের বেলাভূমে আপনি সপরিবারে বেরিয়ে যেতে পারেন। সেখানে লাল কাঁকড়াদের বিচরণভূমিতে কাটাতে পারেন অনেক সময়। কারণ তাদের সঙ্গে আপনার দৌড়ঝাঁপ করতেই হবে। কাকড়াদের মিছিল দেখে ধাওয়া না করেছে এমন পর্যটকতো দূরের কথা। সোজা কথায় এমন পাবলিক কেউ দেখেনি বলে গঙ্গামতির জেলেদের ভাষ্য। তবে একটি কাঁকড়াও ধরা খুবই দুরূহ কাজ। কারণ আপনার তাড়া খেয়েই লাল কাকড়াগুলো ভোঁ দৌড়ে বালুর মধ্যে তাদের নিজস্ব আস্তানায় লুকোবে। যাবে যেন মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে। এ সৈকতে সাগরের মৃদু ঢেউ, নির্মল বাতাস, প্রকৃতি উপভোগের সুযোগ রয়েছে। পরিচ্ছন্ন ও বর্জ্যমুক্ত পরিবেশ এ সৈকতটির। গঙ্গামতি সৈকতে জোয়ার ভাটায় থাকছে অনেক প্রশস্থ, নিরাপদ ওয়াকিং জোন। নেই সমুদ্রের ঢেউয়ের ভাঙনের তাণ্ডব। সৈকতের কোল ঘেঁষা ঝাউবাগান। যেখানটায় দাঁড়িয়ে উপভোগ্য সময় কাটানোর সুযোগ রয়েছে। অন্তত ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এ সৈকতে সূর্যোদয়ের মনোরম দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে পশ্চিমে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য অবলোকনের। সৈকতের গোটা বেলাভূমে আঁকাবাঁকা চর রয়েছে। নৈসর্গিক মনভোলানো এ চরটিতে জেলেদের মাছ আহরণের দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ রয়েছে। জেলে কামাল হোসেন জানালেন, এ সৈকতের চর দিনকে দিন আরও বাড়ছে। বাগানও বাড়ছে। সৈকতের কোলঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোট্ট ছোট্ট দোকানপাট। এখানকার ভোরের খিচুড়ি নাকি খুবই স্বাদের। নাম হয়েছে খিচুড়ি পয়েন্ট। ডাবসহ চা-কফির তেষ্টা মেটানোর সুযোগ রয়েছে। রয়েছে খাবার হোটেল। অনেকটা কোলাহলমুখর নয়। একদম নিরিবিলি পরিবেশ। নির্জনে প্রকৃতি অবলোকনের যেন মোক্ষম এই পর্যটন পল্লী গঙ্গামতি।
মোটকথা, এখন আর কুয়াকাটা শুধু শীতকালীন পর্যটনকেন্দ্রিক দৈন্যে আটকে নেই। ১২ মাস উপভোগ্য এক পর্যটন কেন্দ্রে হয়েছে রুপান্তর। পরিপূর্ণ এক পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে ক্রমশ কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। আর তাই আপনি বর্ষা মৌসুমকে এখানকার অন্তরায় না ভেবে দ্রুত চলে আসুন পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায়। সুবর্ণ সুযোগকে যেন হাতছাড়া না করে আপনার অপর কোনো সঙ্গী। তাও বলে রাখুন।
রাখাইন পল্লী
কুয়াকাটার আর এক উপভোগ্য এবং অজানা সম্প্রদায় এখানকার আদিবাসী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রাখাইন সম্প্রদায়। কুয়াকাটা সৈকতের কোল ঘেঁষে বেড়িবাঁধের অভ্যন্তরেসহ অসংখ্য এলাকায় রয়েছে এই সম্প্রদায়ের বসবাস। রয়েছে অন্তত ২৮টি পল্লী কলাপাড়ায়। পল্লীতে ঘুরলে তাদের নিজস্ব ধারার বসবাস পাবেন দেখতে। ভিন্নতায়, তাদের স্বকীয়তায় বসবাস করা এই পল্লীতে গেলে তাদের টং ঘরের বসবাস আপনাকে বিমোহিত করবে। শুনতে পারবেন এদের প্রবীণদের কাছ থেকে তাদের দুঃখ গাঁথা জীবনের কথা। রয়েছে বর্ণাঢ্য সুখের স্মৃতিও। টং ঘরটির নিচেই রয়েছে তাতে বোনার সরঞ্জাম। দেখা যাবে তাদের বোনা লুঙ্গি ও ব্যাগসহ পরিধেয় বস্ত্র। তাদের জীবন যাপন ও সংস্কৃতি দেখে আপনার জন্মাবে নতুন অভিজ্ঞতা। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার মতো। জানার মতো এদের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস।
প্রচীন কুয়া
প্রাচীন কুয়াটি না দেখে ফিরে গেছে কুয়াকাটায় আসা এমন পর্যটক কিংবা দর্শনার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে বলে কারও মনে হয় না। কারণ কুয়াকাটা নামকরণ হয়েছে এই কুয়াটিকে কেন্দ্র করে। রাখাইন পল্লীর কেরানিপাড়ার নিয়ন্ত্রণে এই কুয়াটি ইতোমধ্যে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে। এ কারণে ঐতিহাসিক এই কুয়াটি সংরক্ষণ করা হয়েছে সরকারি সহায়তায়। কুয়ার স্বচ্ছ, টলমল পানি দেখতে ভোলে না কেউ। নতুন দম্পতিরা আবার সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এমন জনশ্রুতি রয়েছে। প্রায় আড়াই শ’ বছর আগে লবণাক্ত বনজঙ্গলে আরাকান থেকে বিতাড়িত রাখাইন উপজাতি যখন এখানে এসে আটকে পড়ে। তখন বনজঙ্গল আবাদ করার পাশাপাশি সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য সর্বপ্রথম এই কুয়াটি খনন করেছিল। এটিকে প্রবীণ রাখাইনরা এখনো ইন্দিরা বলে থাকে।
শ্রীমঙ্গল ও সীমা বৌদ্ধ বিহার
কুয়াকাটা সৈকতের কোল ঘেঁষে আরেক সৌন্দর্যময় ঐতিহ্য দেখার সুযোগ রয়েছে। রাখাইনদের বিশাল বৌদ্ধ বিহার। রাখাইনদের দেওয়া তথ্যমতে সীমা বৌদ্ধ বিহারের ভিতরে স্থাপিত রয়েছে গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি। ইন্দোচীনের সৌকর্যে এটি আগে একটি টিনশেড বিহারে থাকলেও বর্তমানে আধুনিক দেখার মতো পাকা বিহারে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এটি স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া একই ধরনের অপর একটি বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে রাখাইন পল্লী মিশ্রিপাড়ায়। ওই মূর্তিটি এশিয়ার সর্ববৃহৎ বলে দাবি এখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের। প্রায় ১০০ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী এ বিহারটির অভ্যন্তরে বিশালকায় গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তিটি দেখতে পর্যটকরা প্রতিদিন ভিড় করেন। ইন্দোচীনের সৌকর্যের পুরনো আদল ঠিক রেখে এ বিহারটি ২০১৪ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। বিহারাধ্যক্ষ উত্তম ভিক্ষু জানান, প্রায় একশ’ বছর আগে আসাম থেকে আসা উ নারাথা মহাথেরো এই বৌদ্ধবিহারটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপন করেন। এখানকার প্রয়াত রাখাইন হেডম্যান (মাদবর) মিশ্রি তালুকদার দুই একর জমি দান করেন। যার ওপর প্রতিষ্ঠিত আজকের বহুল পরিচিত সীমা বৌদ্ধবিহার। আগামী তিন মাস পরে এই সীমা বৌদ্ধবিহারের শত বছর পূর্ণ হবে বলে জানালেন বিহারাধ্যক্ষ। বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শতবর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। প্রায় ৩২ ফুট উঁচু এ বুদ্ধ মুর্তিটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি বলে রাখাইনদের দাবি। এটি নির্দিষ্ট দর্শনীর বিনিময় দেখার সুযোগ রয়েছে। বুদ্ধ-বিহার এলাকায় রয়েছে পানি সংরক্ষণের একটি দৃষ্টি নন্দন কুয়া। বাউন্ডারি ঘেরা ফুলের বাগান। সকাল-বিকাল পাড়ার রাখাইন নারী-পুরুষরা বিহার অঙ্গনে ধর্মীয় প্রার্থনা করে আসছেন। পাড়ার বাসিন্দা আফ্রু মং বলেন, জায়গা দখলের সমস্যাটিও মিটে গেছে। এখন কোনো সমস্যা নেই। তবে কুয়াকাটা থেকে এই বৌদ্ধ বিহারে আসার সড়কটি মেরামত করা প্রয়োজন। এছাড়া এখানে পর্যটকের আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন যাবাহনের ভাড়াও ঠিক করে দেওয়ার কথা জানালেন রাখাইন নেতৃবৃন্দ।
২০০ বছরের পুরানো খাপড়াভাঙ্গা বৌদ্ধ বিহার
কলাপাড়ায় খাপড়াভাঙ্গা গ্রামে প্রায় দুইশ’ বছরের প্রাচীন মঠসহ বৌদ্ধ মন্দিরটি এখন জরাজীর্ণ দশা হলেও পর্যটকরা এটি দেখতে আসেন। চাপলী বাজারের খাপড়াভাঙ্গা নদীর সেতু পেরিয়ে উল্টোদিকেই এ বৌদ্ধ বিহারটির অবস্থান। যদিও মঠের উপরের অংশ অনেকটা ভেঙে গেছে। মন্দিরটির স্থাপনাশৈলীতে রয়েছে প্রাচীন আদল। রাখাইনরা এই বৌদ্ধ মঠসহ মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের প্রতি দাবি করে আসছেন।
প্রবীণ রাখাইনরা জানান, গৌতম বুদ্ধের দেহধাতু যেমন, চুল ও নখের উপাদানের উপরে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে এই আদলের আরেকটি মন্দির রয়েছে রামুতে। রাখাইন জমিদার ম্রাথা চৌধুরী ইংরেজদের কাছ থেকে জমি পত্তন নিয়ে খাপড়াভাঙ্গায় বৌদ্ধমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেও এখানকার রাখাইন নেতা প্রয়াত উসুয়ে হাওলাদার জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছিলেন।
পক্ষিয়াপাড়ার বাসিন্দা রাখাইন প্রয়াত প্রকৌশলী ট্যানথান জানিয়েছিলেন, এই বৌদ্ধ মান্দরটি বৌদ্ধদের আদী থেরোবাদ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। ভিন্নতর কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে মন্দিরটিতে। যা ভারতের বিহারের বৈদ্যগয়ার সম্রাট অশোকের আমলে প্রতিষ্ঠিত কিছু মন্দিরের সঙ্গে সদৃশ্য রয়েছে বলে এ প্রকৌশলী বলেছিলেন। রাখাইনদের ভাষ্যমতে, এই জনপদের বনজঙ্গল সাফ করে বসতি গড়ে তোলার পরে বিহারসহ মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। ছিল আশপাশে রাখাইনদের বাড়িঘর, পাড়া। এমনকি মন্দিরের ২০-২৫ হাত দূরে রাখাইন জমিদার মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা ম্রাথা চৌধুরীকে এখানে সৎকার করা হয়। সেই শ্মশানটিও বেদখল হয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে রাখাইনদের ওই স্পটে কোনো বাড়িঘর এখন নেই। রয়ে গেছে বৌদ্ধমঠসহ মন্দিরটি। বর্তমানে এই বৌদ্ধ মন্দিরটির অবস্থান ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নে। এখনো প্রায় ৬০ ফুট উচ্চতা রয়েছে মঠটির।
রাখাইন নেতৃবৃন্দ জানান, জীর্ণদশার মন্দিরটিতে ছিল গৌতমবুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি। ভেতরে কাঠের ও পাথরের অসংখ্য মূর্তি ছিল। এসবের একটিও নেই। নেই কোনো দরজা। মন্দিরটি ইটগুলো জীর্ণদশার শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে। পলেস্তরাসহ ইটের গাঁথুনি খসে পড়ছে। চারদিকে পুরানো ইট-সুরকি ধুলির মতো উড়ে যাচ্ছে। ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে লাল ইটের গাঁথুনি। কোনো প্রাণীর কঙ্কালের মতো দেখায়। এখন ধসে পড়া সময়ের ব্যাপার। মঠের চারদিকে মাস্তুল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছে সয়লাব হয়ে ঢেকে গেছে। কাছাকাছি গেলে গা ছমছম করে। এক ধরনের ভৌতিক অবস্থার শিহরণ জাগায় মনে। মঠের উপরে সাপের বসবাস দেখতে পায় বলে স্থানীয়রা জানান। কয়েক বছর আগে লোকজন ধাওয়া করে একটি সাপ মেরে ফেলেছেন বলে জানান কেউ কেউ। আশপাশের জায়গা সব দখল হয়ে গেলেও মন্দিরটি সাপের বসবাসের কারণে ভয়ে কেউ ভাঙ্গেনি বলে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রাচীন এই মঠসহ মন্দিরটি দেখতে এখনো কিছু পর্যটক আসেন এখানে। এটি সংরক্ষণে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে । তখন বাঁশের কয়েকটি চেরা চারদিকে দেওয়া ছিল। একটি সাইনবোর্ড লটকানো ছিল। যেখানে লেখা ছিল খাপড়াভাঙ্গায় অবস্থিত মন্দিরটি সংস্কার ও দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন বজন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো। তিনি চট্টগ্রাম জেলার ডাবলমুড়িং উপজেলার মোগলতুলি গ্রামের শাখ্যমান বৌদ্ধ বিহার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। এখন বাঁশের বেড়া কিংবা ওই সাইনবোর্ডটি নেই। আর মন্দিরটি মঠসহ যে কোনো সময় বিধ্বস্তের শঙ্কা করছেন রাখাইন জনগোষ্ঠী। প্রাচীন এই পুরাকীর্তি দেখার সুযোগ রয়েছে কুয়াকাটায় আগতদের।
ফাতরার বনাঞ্চল
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে পশ্চিম দিকে যেখান দিয় আন্ধার মানিক মোহনা মিলেছে সাগরে সেই আন্ধার মানিকের পশ্চিম দিকেই রয়েছে বিশাল সৌন্দর্যমণ্ডিত এক সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এর নাম ফাতরার বনাঞ্চল। এই বনটি মূলত সুন্দর বনের একটি অংশ। এই বনাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য মনোরম লেক। লেকের দুই পাড়ে সারি সারি সুন্দরী, গেওয়া, বাইনসহ বিভিন্ন গাছের সমাহার। এই বনে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য পাখিদের আবাসস্থল। রয়েছে বানর। আছে গোটা কয়েক হরিণ। ফাতরার বনাঞ্চলকে নেওয়া হয়েছে ইকোপার্কের আওতায়। সেখানে মনোরম স্পট করা হয়েছে পর্যটকের জন্য। বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এই বনাঞ্চলে যেতে পারবেন বিশেষ প্যাকেজ ট্যুর পার্টির মাধ্যমে। তবে বন বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে। তবে বর্ষায় এই ট্যুর শীতের চেয়ে কিছুট ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও এখানে পর্যটকরা ভ্রমণে ভোলেন না।
নারকেল কুঞ্জ-ট্যুরিজম পার্ক
সমুদ্র সৈকতের কোল ঘেষে বেলাভূমি লাগোয়া প্রায় ২০০ একর জায়গার ওপরে প্রতিষ্ঠিত এই নারকেল বাগানটি করা হয় ষাটের দশকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফার্মস অ্যান্ড ফার্মসের তত্ত্বাবধানে দর্শনীয় এই বাগানটিতে পিকনিক পার্টির আনাগোনা থাকে বারো মাস। ’৯০-এর দশকেও বাগানের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ হাজার নারিকেল গাছ ও হাজার হাজার পেয়ারা গাছে পরিপূর্ণ ছিল। যা এখন নেই এক দশমাংশ। তবে সরকারের উদ্যোগে বাগানটির মধ্যে করা ট্যুরিজম পার্ক। যেখানটায় এখন পর্যটকরা কিছুটা সময় কাটাতে পারেন। এছাড়া এখানে কালচারাল ফাংশন করার সুযোগ রয়েছে।
মেজবাহউদ্দিন মাননু,
কলাপাড়া-পটুয়াখালী
প্যানেল/মো.