
.
স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বাজলো।
ছেলেমেয়েরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্লাস থেকে। বিশাল মাঠের ওদিকে স্কুল গেট। সবাই কি দৌড়- যেন প্রতিযোগিতা চলছে। কিন্তু নাফিজ দৌড়ায় না। হাঁটেও না। বারান্দার পিলার ঘেঁষে বসে আছে। যেখানে স্কুল ঘণ্টা ঝুলে আছে তার নিচ বরাবর। মাঠের নরম ঘাস তার পা ছুঁয়েছে।
নাফিজ ক্লাস ফোরে পড়ে। বাবা মাজেদ আলী এই স্কুলেরই দপ্তরি। প্রতিদিন ঘণ্টা বাজিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। প্রতিদিন স্কুল ছুটি হলে নাফিজ এক দৌড়ে চলে আসে বাবার কাছে।
আজ ঘণ্টা বাজিয়েছে নাফিসের ক্লাসটিচার জসিম স্যার। নাফিসের বাবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন।
বিজয়ের তুমুল নেশায় ছাত্রজনতা মিছিল নিয়ে যাচ্ছে। গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে তারা। স্লোগান ধরেছে নাজিমও। নাজিম নাফিজের বড় ভাই। সে ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে। নাজিম তার ব্যাচমেটসহ আন্দোলনে আছে। বাবার খুব কড়া শাসনে বড় হওয়া ছেলে সে। রাস্তায় আন্দোলন তো দূরের কথা, বিক্ষোভের দিনে স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল তার জন্য। আর এখন সেই নাজিম দিচ্ছে মিছিলের স্লোগান। তার বিস্ফারিত কণ্ঠের সাথে হাজারো কণ্ঠ গর্জে উঠছে রাস্তায়। ললাটে বাঁধা বাংলাদেশের পতাকা।
এ-ই দিল্লি না ঢাকা.../ ঢাকা ঢাকা।...
কোনো এক অদ্ভুত কারণে বাবা তাকে আর বারণ করছেন না। বরং নাফিসসহ স্কুলে যাওয়ার পথে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন নাজিমের দিকে, ক্ষোভে ফেটে পড়া হাজারো জনতার মিছিলের দিকে। নাফিস তার বাবার দিকে তাকায়, দেখে, বাবার ঠোঁট নড়ছে।
নাজিমের স্লোগান জবাবে হাজারো জনতার সাথে ঠোঁট মিলিয়ে বাবাও বলছে, ‘ঢাকা ঢাকা,/ রাজপথ রাজপথ,/ আজাদি আজাদি।’...
নাফিজ আরও ভালো করে খেয়াল করে দেখে, বাবার চোখে পানি টলমল। চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারেন না।
নাফিজ বলে, ‘বাবা, কাঁদছো?’
ছেলের প্রশ্নে বিচলিত হলেন না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, ‘না বাবা, কাঁদছি না। এমনিতেই চোখের পানি এসে গেছে।’
‘এমনিতেই কি চোখের পানি আসে বাবা?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আসে রে বাপ, আসে।’
একটু চুপ থাকলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘যে ছেলেটারে আমি অতি আদরে-শাসনে বড় করছি। রাস্তায় একা একা নামতে দিই নাই কখনো। স্কুলে নিয়া গেছি তোমার মত হাত ধরে। আজ সেই ছেলেটা বলিষ্ঠ কন্ঠে দেশের পক্ষে স্লোগান ধরছে। সেই দৃশ্য দেখে আমি কাঁদতে চাইনি। আমার কলিজায় এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। সেই ঢেউ চোখের পানি হয়ে বের হলো। বুঝছো, নাফিজ?’
মাজেদ আলী শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছলো আবার।
নাফিজ ঠিকঠাক বোঝেনি। না বুঝেও সে মাথা ঝুঁকালো। বলল, ‘আমি ভাবছিলাম তুমি ভাইয়ারে দেখে কান ধরে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় দিবা। তারপর কড়া বকাঝকা করে সোজা বাসায় যাইতে বলবা। কিন্তু তা করলা না কেন বাবা?’
ছেলের এমন কড়া প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলল মাজেদ আলীকে। কিছু বলল না। চুপচাপ হাঁটছে। রাস্তায় গাড়ি তেমন নেই। ফাঁকা ফাঁকা লাগে চারিদিক। কিন্তু বিভিন্ন কলেজ-ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা আছে। তারা বেশ দ্রুত চলাচল করছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ। সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরাও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মাথায় হেলমেট পড়া। হাত তাদের অস্ত্রে ভরা। যেন এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে একদল নিরীহ দেশপ্রেমিক মানুষের উপর।
মোড় ক্রস করার সময় ছেলের হাত শক্ত করে চেপে ধরে মাজেদ আলী। চতুর্দিকে তাকায় বারবার।
মোড় পার হয়ে নাফিজ আবার জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু বললা না যে বাবা?’
মাজেদ আলী চুপচাপ হাঁটতে থাকে। স্কুল গেটের ভিতর গিয়ে মুখ খোলেন তিনি, ‘বাবা, তোমার প্রশ্নের উত্তর রাস্তায় দিলে বিপদ। শোন, আমার ছেলেটা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সবার সাথে রাস্তায় নামছে। অন্যয়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে। সত্য উচ্চারণে বলিষ্ঠ। এই দেশটারে জুলুমে জুলুমে একটা বড় কারাগার বানিয়ে ফেলছে স্বৈরাচার। একটা স্বাধীন দেশ এভাবে চলতে পারে না। দেশের মানুষের অধিকার বলতে কিছুই নেই। সেই অধিকার আদায় করতে রাজপথে নেমেছে আমার নাজিম। আমার বড় ছেলে। তোমার বড় ভাই। আমি তো যেতে পারছি না বাবা। আমার ছেলে গেছে এই খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এসেছে, তারে শাসন করবো কোত্থেকে!’
একটু চুপ থেকে আবার বললেন, ‘শোনো বাবা, যেখানে অধিকার হনন হয়ে যায়, সেখানে ঘরে বসে অধিকার আদায় করা যায় না। আর যারা ন্যায়পক্ষে, সত্যের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে মারা যায় তারা সম্মানিত হয়।’
দুই.
মন ভার করে নাফিজ বসে আছে এখনো। হেডস্যার দূর থেকে খেয়াল করলেন। কাছে এসেই নাফিসের মাথায় হাত রাখলেন। বাচ্চা ছেলের মতো স্যারও বসে গেলেন তার পাশে। নাফিসের মলিন মুখ দেখে স্যারের শক্ত হৃদয় গলে গেল নিমিষেই। নাফিজও স্যারকে জড়িয়ে ধরে কান্না মুষড়ে পড়ে।
হেডস্যার মাজেদ আলীকে খুব ভালোবাসতেন। কাজে-কর্মে বেশ সহযোগিতার মনমানসিকতা ছিলো তার। কম কথা বলতো। গভীর মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়তো। সচেতন দেশপ্রেমিকের মতো বুদ্ধিদীপ্ত রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আলাপ করতো স্যারদের সাথে। নিরহংকার মাজেদ আলী হয়ে উঠেছিলেন স্যারদের অবসরের কথাবন্ধু।
রশিদ স্যার ডাক দিলেন- ‘স্যার, সব টিচার উপস্থিত’।
হেডস্যারের তৎক্ষণাৎ মনে পড়লো আজ স্কুল ছুটির পর টিচারদের সাথে মিটিং ডেকেছিলেন।
মিটিংয়ের কোনো বিষয়বস্তু আগে জানানো হয়নি। তাই সবাই উন্মুখ হয়ে বসে আছে। স্যার, নিয়মিত খবরাখবর নেওয়ার পর মাজেদ আলীর শহীদ হওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করলেন। ছোট্ট করে একটা ব্রিফ দিলেন। পারিবারিক অবস্থা বললেন। একমুহূর্ত চুপ থেকে আবার বললেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা মাজেদ আলী আমাদের সহকর্মী। তার সাথে হৃদ্যতা ছিল আমাদের সবার। আমরা কী করতে পারি, আপনাদের কাছ থেকে শুনতে চাই। বলুন।’
বহু প্রস্তাব এসেছে। সাধ্যের বাইরে কিছু প্রস্তাব এসেছে। এটা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সব টিচারের বক্তব্যে যে কথাটা ছিলো তা হলো- ‘আমাদের একজন সহকর্মী দেশের জন্য প্রাণ দিলো- এটাতে যেমন সহকর্মী হারানোর শোক আছে, তেমনি এটা খুশি ও আনন্দের। আমরা গর্বিত। তার জন্য যেকোনো সহযোগিতায় আমরা আছি।’
হেডস্যার চোখ মুছছেন। এটা দেখতে বিশ্বাস হচ্ছিলো না টিচারদের। কঠিন হৃদয়ের মানুষটার চোখেও পানি আসতে পারে!
সবার কথা বলা শেষে হেডস্যার কথা বলা শুরু করেছেন- ‘মাজেদ আলী নেই। স্বাভাবিকভাবে তার চাকরিও নেই।’ তাদের পরিবারের খরচ বহনের বিষয়টা স্যার জোর দিয়ে কথা বললেন।
নাজিম তাড়াহুড়ো করে আসলো নাফিজকে নিতে। তাকে বেশ পরিপক্ব মনে হচ্ছে আগের থেকে। আসলে দায়িত্বই মানুষকে পরিপক্ব করে তোলে। দায়িত্ব না আসলে মানুষ ছোটই থেকে যায়, বয়স যতো বাড়ুক। নাফিস বড় ভাইকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘ভাইয়া আসতে দেরি করলা যে?’
নাজিম স্নেহের সুরে বলল, ‘নাফিজ, আমাকে কলেজের টিচাররা ডেকেছিলো হঠাৎ করে। স্যারদের সাথে কথা শেষ করে আসতে দেরি হয়ে গেলো।’
একটু থেমে আবার বলল, ‘হেডস্যার কই? চলে গেছে?’
‘না, আছে। সব স্যার মিটিং রুমে আছে।’
‘মিটিং চলছে?’
‘জানি না। দেখো গিয়ে।’
নাজিম দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছে- দরজায় টোকা দেবে কি দেবে না। হেডস্যার বাসার নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখা করতে বলেছিলো। এসে দেখা করে না গেলে খারাপ দেখাবে। কথা বলার সুযোগ না থাকলে পরে কথা বলা যাবে সমস্যা নেই। আসছি সেটা স্যারকে জানানো দরকার।
সাহস করে কড়া নাড়লো দরজায়। ভেতর থেকে বলল, কে?
‘স্যার আমি নাজিম।’
‘ও, নাজিম, আসো আসো। ভিতরে আসো।’
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
সব টিচার খুবই আনন্দের সাথে সালামের জবাব দিলো। হেডস্যারই কথা বলা শুরু করলো- ‘নাজিম, তোমাকে ডেকেছিলাম একটু খোঁজখবর নিতে। তোমার আম্মার, পরিবারের। এখন তো মিটিংয়ে আছি। তোমার আব্বুর বিষয়টা নিয়েও কথা চলছে। আমাদের আরো কথা বাকি আছে। তাই তোমাকে সময় দিতে পারছি না। তুমি জুলাই-যোদ্ধা। সাহসী দেশপ্রেমিক। একজন শহীদের ছেলে।
নাজিম লজ্জিত হয়, ‘স্যার বাইরে যা কিছুই হই না কেন, আপনাদের কাছে আমি ছোট্ট নাজিম, আপনাদের ছাত্র, মাজেদ আলীর ছেলে। আপনাদের জন্য কোনো ব্যস্ততা নেই স্যার।’
আজকে যে নাজিমের প্রসংশা আপনারা করছেন স্যার, ‘সেই প্রসংশার দাবিদার আপনারা। আপনারাই তো আমাকে দেশপ্রেম, দেশের জন্য যুদ্ধ করা, ন্যায়ের পক্ষে থাকা শিখিয়েছেন।’
হেডস্যার দাঁড়িয়ে নাজিদের মাথাটা বুকে টেনে নেয়। মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় আর বলেন- ‘আল্লাহ তোরে অনেক বড় করুক বেটা, সম্মানিত করুক। তোর বাপ মারা গেলো বলে টেনশন করিস না। আল্লাহই তো বাঁচানোর মালিক, মান সম্মানের মালিক।’
‘দুআ করবেন স্যার।’
জসিম স্যার ডাক দিলেন- ‘নাজিম এদিকে আয়।’
নাজিম ভয়ে ভয়ে আগায়। জসিম স্যার খুবই কড়া মানুষ। ম্যাথ পড়ায় সব ক্লাসে। স্টুডেন্টরা বাস্তবে বাঘ মনে করে জসিম স্যারকে। পড়ার ফাঁকিবাজি স্যারের সাথে চলে না। সেই কঠোরভাবে শাসন করা স্যার এতো নরম করে ডাক দিলেন। স্যারের এমন নরম ডাক কখনো শোনেনি নাজিম। কষ্ট লাগলো স্যারের এমন নরম হওয়া দেখে। মনে হলো স্যার অনেক কষ্টে আছেন। জসিম স্যাররে সেই চিরায়ত কঠিন স্বরেই ভালো লাগে। ‘এই নাজিম এদিকে আয়, ওদিকে যাস কই’ এই ডাকে যেমন শাসন থাকে তেমন থাকে আদর।
আর আজকে যেভাবে নরম ভঙ্গুর স্বরে স্যার ডাকলেন, ‘নাজিম এদিকে আয়’। এই ডাকে শাসন নেই। কেবল আদর আছে। স্যারের ডাকে শাসনের অনুপস্থিতি নাজিমকে ভয় ধরিয়ে দেয়। স্যার কি নাজিমকে আর শাসন করতে হবে বলে মনে করছেন না? নাজিম কি তার নিজের দায়িত্বজ্ঞানে চলতে শিখে গেছে বলে মনে করছেন স্যার? নাজিমের মাথায় নানান কথার প্যাঁচ লেগে যায়।
নাজিম স্যারের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। স্যার বাসা থেকে আনা টিফিন বক্স খুলছেন মনোযোগ দিয়ে। পঞ্চাশোর্ধ জসিম স্যার বয়সের তুলনায় নরম হয়ে গেছেন বেশি। হার্টে রিং পড়ানোর পর এমনটা হয়েছে। হাতের জোর কমে গেছে। টিফিন বক্স খুলতেই স্যারের বহু পরিশ্রম করতে হচ্ছে। স্যার টিফিন বক্স খুলে দুইটা আপেল বের করে নাজিমের হাতে গুঁজে দিলেন। নাফিস ভয়ে ভয়ে না করতে যাবে, সেই সুযোগ না দিয়ে স্যারই বললো, তুই একটা খাবি, নাফিজরে একটা দিবি, যা।
জসিম স্যার এমন করে কখনো বলেননি। ক্লাসের বাইরের জসিম স্যারকে কখনো দেখা হয়নি নাজিমের। কত দরদ দিয়ে ভালোবাসেন টিচারেরা। নাজিম চোখের পানি আড়াল করতে পারে না। গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। জসিম স্যার চিরায়ত কন্ঠে ধমক দিলেন- ‘যা, কান্দিস না মাইয়া মাইনসের মতো। পুরুষ মানুষের কইজা শক্ত করা লাগে। বড় হইছোস। তোর পরিবারের কর্তা তুই এখন। যা, আল্লাহ হাফেজ। স্কুলে আসিস। আসলে স্যারের লগে দেখা করিস। তুরে দেখলে কলিজাটায় ভালো লাগে। টেনশন করিস না। তোর বাপ মারা গেছে কি হইছে। আমরা সবাই তোর বাপ না? টিচার বাপের সমান। মন চাইলেই চাইলা আসবি স্কুলে। মন দিল খুইলা বলবি সব কথা। যদ্দূর তৌফিকে কুলায় চেষ্টা করমু। আল্লাহ ভরসা। যা।
ভারি হয়ে আসা কন্ঠে সালাম দিয়ে স্কুলের মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে নাজিম।
প্যানেল