
ছবি: জনকণ্ঠ
সন্ধ্যা নামছে খুলনায়। বড় বাজারের গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে হঠাৎই এক মিষ্টি ঘ্রাণ থমকে দেয় পথচলা। কাঁচা ছানার সঙ্গে খাঁটি চিনির গন্ধ মিলে তৈরি করে এক অদৃশ্য মায়াজাল। সামনে তাকিয়ে দেখা যায় ছোট্ট একটি দোকান—ভেতরে ছিমছামভাবে সাজানো চার রকমের মিষ্টি। চকচকে প্যাকেট নেই, নেই ক্যাশ কাউন্টারে কোনো ইলেকট্রনিক হুল্লোড়। শুধু একটি মোটা কাঠের টেবিল, স্টিলের পিরিচ আর কলাপাতায় সাজানো পানতুয়া, রসগোল্লা, সন্দেশ ও চমচম। দোকানের নাম ‘ইন্দ্রমোহন সুইটস’।
১৩৫ বছর ধরে কলাপাতায় মিষ্টি বিক্রি করে চলেছে এই দোকান। ১৮৯০ সালে ইন্দ্রমোহন দে নামের এক মিষ্টি প্রস্তুতকারক হেলাতলা রোডের একটি ভাড়া করা অংশে এই দোকান চালু করেন। তখন দেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে, আর খুলনা ছিল নদীপথে বাণিজ্যের ব্যস্ত শহর। মিষ্টির স্বাদ ও প্রস্তুতপ্রণালিতে সময়ের ছাপ পড়লেও ইন্দ্রমোহনের দোকানে সময় যেন থেমে আছে। এখানকার মিষ্টি এখনো বিক্রি হয় সংখ্যায়, কেজিতে নয়। পরিবেশন এখনো হয় কলাপাতায়; চামচ নেই, খেতে হয় হাতে।
বর্তমানে দোকানটির হাল ধরেছেন ইন্দ্রমোহনের নাতি সঞ্জয় দে। তাঁর কণ্ঠে ঝরে পড়ে গর্ব:
“নতুন দোকানে যত বাহার থাকুক, আমাদের কাছে মানুষ আসে স্বাদের জন্য। প্রতিদিন খাঁটি গরুর দুধ এনে ছানা তৈরি করি। ৫০–৬০ কেজি ছানা দিয়ে বানাই পানতুয়া, রসগোল্লা আর সন্দেশ। কোনো সুজি বা আটা নয়—খাঁটি উপকরণ, আর একটু ডিম ও বেকিং পাউডার দিয়ে তৈরি হয় অসাধারণ নরম পানতুয়া।”
প্রতিদিন ২০০–৩০০ পিস পানতুয়া বিক্রি হয়, আর সন্দেশ বিক্রি হয় ১০০–১৫০ কেজি পর্যন্ত। প্রতিটি রসগোল্লা বা পানতুয়ার দাম ২০ টাকা, আর সন্দেশ প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৪০০ টাকায়। সন্ধ্যায় গরম গরম রসগোল্লা ও পানতুয়ার জন্য ভিড় জমায় মিষ্টিপ্রেমীরা।
বিশুদ্ধতার এই ঐতিহ্য এতটাই দীর্ঘ যে, এটি অনেক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান পিরিয়ড, এমনকি সাম্প্রতিক সময়েও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এখানে এসেছেন। ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার খুলনা সফরের সময় ইন্দ্রমোহন সুইটসে এসে মিষ্টির স্বাদ নিয়েছেন।
এই দোকানে ৪৪ বছর ধরে মিষ্টি বানাচ্ছেন কারিগর কমল চন্দ্র সরকার। তাঁর মতে, “বাসি মিষ্টি এখানে কখনো ছিল না। যেদিন বানাই, সেদিনই সব বিক্রি হয়ে যায়। সেই নীতিতে এখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি।”
আজকের বাজারে যখন বিজ্ঞাপন ও বাহারে খাবারকে সাজিয়ে তোলা হয়, তখন ইন্দ্রমোহন সুইটস দাঁড়িয়ে আছে একদম উল্টো পথে। এখানে নেই সোশ্যাল মিডিয়ার আলো, নেই ডিজিটাল ক্যাম্পেইন। কিন্তু আছে কিছু চেনা মুখের ফিরে আসা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া গন্ধ, আর ঐতিহ্যগত সেই একটি বাক্য—
“ইন্দ্রমোহনের পানতুয়া মুখে দিলেই গলে যায়।”
মুমু