ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

চিংড়িতে সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতা

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চিংড়িতে সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতা

.

চিংড়ির কথা উঠলেই ভোজনরসিক বাঙালির জিভে পানি এসে যায়। চিংড়ির মালাইকারী, ডাব-চিংড়ি, কচুবাটা চিংড়ি, দই চিংড়ি, চিংড়ির দো-পিঁয়াজা, চিংড়ি ভাপা, সরিষা চিংড়ি, লাউ চিংড়ি, ডাঁটা চিংড়ি, চিংড়ি ভর্তা, চিংড়ি-শুঁটকি, প্রণ ফ্রায়েড রাইস আরও কত কি চিংড়ির রেসিপি আছে বলে শেষ করা যায় না। মোদ্দাকথা রসনা তৃপ্তিতে চিংড়ির জুড়ি মেলাভার।

শুধু বাঙালি কেন- এখন গোটা বিশ্বের দেশে দেশে রয়েছে চিংড়ির চাহিদা। চিংড়ির বাজারও বিস্তৃত। তাই চিংড়ি চাষ ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া শিল্পকে রক্ষা করা আমাদের সার্বিক অর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে একদা চিংড়ি চাষ সুন্দরবন উপকূলীয় বাগেরহাট, খুলনা সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন দক্ষিণের চিংড়িতে উত্তরের মানুষও স্বপ্ন বুনছেন। আজ দেশের ৬১টি জেলায় চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অনন্য ভূমিকার কারণে এখন চিংড়ি চাষ শিল্প হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অর্থনীতিতে যাসাদাসোনাহিসেবে খ্যাত। আবার দেশের মধ্যেও রয়েছে চিংড়ির বিশাল বাজার। সাধারণ খাবারের তালিকায় চিংড়ি ঠাঁই নিয়েছে। বাংলাদেশে এমন একটি পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে পরিবারে সপ্তাহে অন্তত থেকে দিন রান্নায় চিংড়ির থাকে না। তথ্যমতে আমাদের দেশে কমপক্ষে নারী-পুরুষ-যুবা মিলিয়ে আড়াই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভরশীল।

উপকূলীয় মানুষের জীবনজীবিকা চিংড়িকে ঘিরে 

চিংড়ি আর্থোপোডা পর্বের প্রাণী। অর্থাৎ অমেরুদন্ডী প্রাণী। সাধারণত পোকা বাঅমেরুডন্ডী প্রাণীর দেহকে মাথা, দেহ উদর ভাগে ভাগ করা হয়। কিন্তু চিংড়ির ক্ষেত্রে মাথা বক্ষ একসাথে থাকে, যাকেশিরোবক্ষবলে। আর বাকি অংশ উদর বাপেট। চিংড়ির হাত-পা উপাঙ্গ। একটি চিংড়ির দেহে মোট ১৯ জোড়া উপাঙ্গ থাকে। এরমধ্যে ১৩ জোড়া শিরোবক্ষে, আর জোড়া উদর আঞ্চলে। অমেরুদন্ডী হওয়ায় চিংড়ি মাছ নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য সম্পদ।

পৃথিবীতে প্রায় ৪৫০ প্রজাতির চিংড়ি থাকলেও বাংেলাদেশের জলাশয়ে পর্যন্ত ৬৭ প্রজাতির চিংড়ি পওয়া গেছে। গলদা, বাগদা, হরিনা, চাকা, ছোট চিংড়ি (ঘুষো) ইত্যাদি। এরমধ্যে গলদা বাগদা চিংড়ির চাষ আমাদের দেশে বেশি হয়। তবে এদের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। গলদা চিংড়ির মাথা উদর প্রায় সমান।

আর বাগদা চিংড়ির মাথা ছোট আর উদর প্রায় দ্বিগুণ। বাগদা তুলনামূলক ছোট এবং প্রাণীভুক। গলদা সর্বভুক। গলদা স্বাদু পানিতে আর বাগদা লোনা পানিতে চাষ হয়। গলদা বড় এবং বাঁকানো আর বাগদা ছোট সোজা। পা বেশ লম্বা এবং বর্ণ হালকা সবুজ থেকে বাদামি হয় গলদার। কিন্তু বাগদা হালকা বাদামি বা সবুজ ডোরাকাটা দেখতে। স্ত্রী বাগদা এবং পুরুষ গলদা দ্রুত বড় হয়। বাগদা - মাসে আহরণ করা সম্ভব হলেও গলদার সময় লাগে - মাস। বাগদার ঘের কয়েক বিঘার হতে পারে। কিন্তু গলদার ঘের ১০ একরের বেশি দেখা যায় না। 

ডোরাকাটা বাগদা

লোনা পানিতে চাষযোগ্য নানা ধরনের চিংড়ির মধ্যে বাগদা সবচেয়ে বড় সুস্বাদু। শরীরে ডোরাকাটা দাগ থাকায় বাগদা চিংড়িকে টাইগার শ্রিম্প বলা হয়, এদের বৃদ্ধির হার খুবদ্রুত এবং স্ত্রী  প্রজাতির বাগদা চিংড়ি পুরুষ প্রজাতির বাগদা চিংড়ির চেয়ে বেশি বড় হয়। দশ মাস বয়সে বাগদা চিংড়ি ডিম ছাড়ার উপযোগী হয় এবং ডিম ছাড়ার জন্য এরা গভীর সমুদ্রে চলে যায়। একটি স্ত্রী বাগদা চিংড়ি বছরে / বার ডিম পাড়ে এবং ১৫০/২৫০ গ্রাম, একটি স্ত্রী চিংড়ি / লাখ ডিম দিতে পারে। বাগদা চিংড়ি সবচেয়ে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন এবং আমাদের দেশে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাগদার পোনা উৎপাদন করার একাধিক হ্যাঁচারি রয়েছে।

সবুজ আর বাদামি মিলিয়ে গলদা

স্বাদু পানির গলদা চিংড়ি দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও খুব সুস্বাদু। চাষও লাভজনক। বাংলাদেশে প্রাপ্ত পর্যন্ত স্বাদু পানির ২৭ প্রজাতির মধ্যে গলদা চিংড়ির ১০টি প্রজাতি সনাক্ত হয়েছে। স্বাদু পানির সকল প্রজাতির চিংড়ির মধ্যে গলদা চিংড়ি আকারে সব চেয়ে বড় হয় বিধায় চিংড়িকে এন্টি ফ্রেশ ওয়াটার প্রন বলাহয়। একটি গলদা চিংড়ি - মাসে পূর্ণ বয়স্কপ্রাপ্ত হয়। গলদা চিংড়ি ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় ক্রান্তিয় অঞ্চলের কাছাকাছি বেশি পাওয়া যায়।

সমস্ত অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লন্ডন, কম্বোডিয়া, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন উল্লেখযোগ্য। নদী, হ্রদ, হাওর, বাওর, প্লাবনভূমি, বিল ইত্যাদি জলাশয়ে গলদা চিংড়ির প্রাকৃতিক আবাসস্থল। তবে প্রজনন মৌসুমে প্রাকৃতিক পরিবেশে ডিম ছাড়ার জন্য এরা অল্পলবণাক্ত পানির পরিবেশে অর্থাৎ নদীর মোহনায় চলে যায়। সাধারণত ৭০-১০০ গ্রাম একটি স্ত্রী গলদা চিংড়ি ৭০ হাজার থেকে লাখ ডিম দিতে থাকে। আমাদের দেশে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করে বাণিজ্যিক ভাবে গলদা চিংড়ির চাষ বহুল প্রচলিত। স্ত্রী গলদার চেয়ে পুরুষ গলদা দ্রুত বড় হয়।  মৃত্যুর হার কম। তাই বাছাই করা পুরুষ গলদা চিংড়ির পোনার দামও বেশি। মাস বয়সি একটি পোনার দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশিতে ক্রয় করতে হয় চাষিদের।

ধান রক্ষা করতে গিয়ে শুরু চিংড়ি চাষ

এখন ঘের মালিকরা বছরে প্রতি বিঘায় ১৫ধশুরুতে চাষিরা ধান দিতেন ঘের মালিকদের। এমন আকর্ষণীয় তথ্য পাওয়া যায় অশীতিপর কৃষক সংশ্লিষ্ট মৎস্য কর্মকর্তাদের সূত্রে।

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের  বিস্তৃতি  ৪৮০  কিলোমিটার। যারমধ্যে বিস্তীর্ণ সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদ বাগেরহাট, খুলনা সাতক্ষীরা। প্রকৃতির নিয়মে আবহমানকাল থেকে অনান্য স্থানের মতো এখানেও জোয়ার-ভাটা প্রবহমান। তবে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর ধানখেতসহ প্রায় সব মাঠ-ঘাট পূর্ণ জোয়ারের সময় প্লাবিত হতো। ভাটায় উঠত জেগে। বছরজুড়ে দিনরাতে বার জোয়া-ভাটা হলেও মাঘি পূর্ণিমা থেকে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা চলে আশ্বিন-কার্ত্তিক মাস পর্যন্ত। জোয়ারে সাগরের লবন পানিতে ফসলের মাঠ প্লাবিত হয়ে আবার বৃষ্টি কম হলে লবণাক্ততার কারণে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হয়। এর সাথে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা হলে হতো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। তখন এখানে অধিকাংশ এলাকায় বছরে কেবল একবার আমন ধানের চাষ হতো। সেই ফসলের ক্ষতি হলে মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে পড়তেন। 

এমন পরিস্থিতিতে ৬০-এর দশকের শুরুতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উপকূলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। বাঁধ নির্মাণের সময় চিংড়িসহ মৎস্য সম্পদের সুরক্ষা বা উৎপাদন উন্নয়ন সম্প্রসারণের বিষয়ে কোন জরিপ বা গবেষণা না করে বাঁধের খালগুলোতে স্লুইসগেট স্থাপন করা হয়। ফলে প্রাকৃতিকভাবে দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ফলে প্রথম কয়েক বছর ধানের উৎপাদন ভাল হয়। সময়ের ব্যবধানে প্রবাহমান খালের স্লুইস গেটগুলোর ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ নির্মাণ ত্রুটির ফলে প্রায়শই ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে।

তখন আমন ধান অঞ্চলের মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল। বর্ষাকালে জমির লবণাক্ততা কমলে আমন ধানের চাষ হয়। কিন্তু বর্ষা কম হলে বা অতিরিক্ত লবণ পানি প্রবেশ করলে জমিতে বীজতলা তৈরী ধান উৎপাদন ব্যাহত হতো। প্রেক্ষাপটে সত্তরের দশকের শেষ দিকে কতিপয় ব্যক্তি যেসব এলাকা দিয়ে লবণ পানি প্রবেশ করতে পারে সে সব খাল ছোট ছোট বিল বা মাঠ বা জমিতে স্বল্প উচ্চতার বেষ্টনী বা বাঁধ দিয়ে ধান চাষ শুরু করেন। এতে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং জোয়ারের পানির সঙ্গে প্রবেশ করা পোনার কারণে চিংড়ি-পারসে- টেংরা-পাতাড়ি মাছ প্রচুর পাওয়া যায়। 

বাগদা চিংড়ি স্বল্পমেয়াদি ফসল। - মাসে বাজারজাত করা যায়। এক টাকা বিনিয়োগ করলে তখন ১২-১৫ টাকা লাভ হতো। অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় ক্রমশ বাগদা চাষে প্রভাবশালীরা আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। শুরুর পর প্রায় দুই দশক পর্যন্ত প্রান্তিক জমির মালিকেরা নানাভাবেশক্তিশালীঘের মালিকদের দ্বারা অত্যাচারিত হন। যা বর্তমানে হ্রাস পেয়েছে। তবে এখনও বড় বড় অনেক বাগদা চিংড়ির ঘের মালিকেরা সরকারী রাস্তা বা বাঁধ কেটে জনভোগান্তি সৃষ্টি করে ঘেরে জোয়ার-ভাটার পানি ওঠা-নামা করছেন।

হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে গলদা চিংড়ির অবদান শতকরা ২৪ থেকে ২৫ ভাগ। এই গলদা চিংড়ির চাষ শুরু হয় নব্বই এর দশক থেকে।যতদূর জানা যায়, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার সৈয়দ কেরামত আলী নামে এক অবস্থাপন্ন কৃষক নিজ জমির চারপাশে বাঁধ দিয়ে

প্রথম গলদা চিংড়ি চাষ শুরু করেন। অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় চাষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে। গলদা চাষ স্বাদু পানিতে হওয়ায় কার্প জাতিয়(সাদা মাছ) মাছের চাষ শুরু হয়।

পোনা মজুদ

খামারে বা ঘেরে সাধারণত দুইভাবে পোনা মজুদ করা হয়। সারা বছরই উপকূলীয় নদী খালে চিংড়ির লার্ভা পাওয়া যায়। সাধারণত পানির উপরের স্তরে লার্ভা বাস করে। ফলে ঘেরে গেট এমনভাবে খুলে জোয়ারের সময় কেবল উপর স্তরের পানি ঘেরে প্রবেশ করানো হতো। পানির সঙ্গে চিংড়ির লার্ভা খামারে প্রবেশ করত। ইদানীং প্রাকৃতিক উৎস থেকেও লার্ভা সংগ্রহ করে প্রথমে নার্সারি পুকুরের পরে পালন পুকুরে মজুদ করা হয়। তাছাড়া অগেরমত প্রাকৃতিক উৎস থেকে চাহিদামতো পোনা বা লার্ভা পাওয়া যায় না। এখন অধিকাংশক্ষেত্রে নার্সারি থেকে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করেন চাষিরা।

ঘের বা খামার প্রস্তুত

চিংড়ি চাষের জন্য নিয়ম মেনে ঘের প্রস্তুত করা খুবই জরুরি। বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস.এম রাসেল মনে করেন, সনাতনী বামান্ধাতা পদ্বতিতে চিংড়ি চাষ করার কারনে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্থ হন। তখন অধিকাংশ ঘেরের অবকাঠামো খুবই দুর্বল এবং পানির গভীরতা মাত্র ফুট থেকে দেড় ফুট ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র দাবদাহে মাছ মরে যেত। আবার অতিবর্ষণে অধিকাংশ ঘের সহজেই প্লাবিত হয়। এসব ঘেরে কোন বায়োসিকিউরিটি না থাকায় এক ঘেরের মাছ রোগাক্রান্ত হলে রোগের সংক্রমণ অন্যান্য ঘেরেও সহজে ছড়িয়ে পড়ে মড়ক শুরু হতো।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন আর খেয়াল খুশি মতো চিংড়ি চাষের দিন নেই। পোনা ছাড়ার আগে মাটি ভাল করে শুকিয়ে বালাইনাশক করতে হবে। চুন জৈব সার প্রয়োগ করে মাটি প্রস্তুতের পাশাপাশি রোগ বালাই ব্যবস্থাপনা নিয়মিত তদারকী করতে হবে। ঘেরে কমপক্ষে থেকে ফুট পানির গভিরতা থাকবে এবং চারপাশের বাঁধ উচুঁ মজবুদ করে দিতে হবে। জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং নিয়মিত মাছের নিরাপদ সুসম খাদ্য দিতে হবে। নিরাপদ পোনা খুবই জরুরি। একই সঙ্গে ঘেরের মাটি পানি নিয়মিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক নিয়মে ঘের করতে পারলে লোকসানের কোন সম্ভবনা নেই বলে মনে করেন এই মৎস্য বিশেষজ্ঞ।

গলদার একক চাষ পদ্ধতি

প্রাকৃতিক পরিবেশে গলদা চিংড়ি স্বাদু পানি এবং ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে পাওয়া যায়। তবে নদীর উঁচু অংশে যেখানে জোয়ার-ভাটার তারতম্য বেশি সেখানে এরা অবস্থান করতে বেশি পছন্দ করে। আমাদের দেশে আধুনিক পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষ করে উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে। গলদা চিংড়ির একক চাষ পদ্ধতিতে স্বাভাবিকভাবে প্রতি শতকে ১০০-১১০ টি গলদা পোনা মজুদ করা যায়। যথাযথ পদ্বতিতে উন্নতমানের ঘের তৈরি করতে পারলে শতকে ২০০-৩০০ পোনা মজুদ করা যেতে পারে। একক চাষ পদ্ধতিতে প্রতি একরে উৎপাদন ৪০০-৫০০ কেজি হয়ে থাকে, যা খুবই লাভজনক বলে মাজেদা বেগম কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রফেসর বুলবুল কবির জানান।

আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে চিংড়ি সম্পদ

সাদাসোনা খ্যাত মৎস্য রপ্তানির তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক মূল্যমানে বাংলাদেশ হতে মোট মৎস্য মৎস্যজাত পণ্যর রপ্তানিতে চিংড়ির অবদান শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ। বর্তমানে দেশের লাখ ৯৮ হাজার ৬৮১ হেক্টর জলাশয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এরমধ্যে লাখ ৮৪ হাজার ৮১২ হেক্টরে বাগদা এবং লাখ ১৩ হাজার ৮৬৯ হেক্টর জলাশয়ে গলদার চাষ হচ্ছে। সনাতন পদ্বতির কারণে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন গড়ে প্রতি হেক্টরে মাত্র ৩৩৪ কেজি এবং গলদা চিংড়ির উৎপাদন হেক্টরে ৬৯৮ কেজি। অথচ আধানিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন হেক্টরে গড়ে হাজার ৪১৪ কেজি সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা রয়েছে। চিংড়ি এক সময় দেশের ২য় রপ্তানি খাত ছিল। খাত থেকে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। কোন সেক্টরের উন্নয়ন উৎপাদনকে টেকসই করতে হলে আয়ের কমপক্ষে ১০ ভাগ সেই সেক্টরের উন্নয়নে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। যা আমাদের দেশে হয়নি।

তাছাড়া রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা রপ্তানিতে অতি উৎসাহী হলেও উৎপাদন বৃদ্ধিতে তাদের আগ্রহ কম। তারপরেও স্থানীয় উদ্যাক্তা চাষিদের জীবন-জীবীকার প্রয়োজনে এবং মৎস্য বিভাগের পরামর্শে ক্লাস্টার পদ্বতি, আধা-নিবিড় পদ্ধতি, সমন্বিত মৎস্য চাষ পদ্ধতি এবং ভেনামী চিংড়ির চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। চিংড়ি চাষিরা ক্রমশ: সচেতন হচ্ছেন। চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমুল পরিবর্তনে চিংড়ি চাষ বাচিংড়ি শিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে বলে মত দেন এই মৎস্য বিশেষজ্ঞ।  

কুঁড়ে ঘর এখন পাকা বাড়ি

ঘেরের আইলে সবজি চাষে বাদোখালি এলাকার চিংড়িচাষি সুলতান আলী, শাহজাহান আলী, ইউনুস, রুস্তম আলী, নুর মোহাম্মদ, মুক্তার, কররী তাপস দাস, প্রবীল দাস, বিষ্ণুপদ, পরিতোষ, দেবশান্ত, উৎকুলের চাঁন্দ সাহা, আমিন ঊদ্দিন, আলম শেখ, চিতলমারীর সেলিম জাহাঙ্গীর, পাটরপাড়ার হায়াত আলী, আমিনুল হক, খুদাড়ীর এমাদুল শেখ, খিলিপাতির আজিজ ফকির, রায়গ্রামের ননী মৃধা, অমল চৌধুরী, শ্যামপাড়ার প্রফুল মন্ডল, পাঁচপাড়ার লিটন হাওলাদার, উমাজুড়ির অরুন হীরা, ব্রহ্মগাতির মোক্তার শেখ, আড়ুয়াবর্ণির সামছু শেখ, আফজাল শেখ, সাবোখালির সুনীল কুমার, ভুবনেশ্বর চেীধুরী, বারাশিয়ার নিজাম শেখ, আবুল, শিবপুর গ্রামের তোতা মুহুরী জানায়, তারা ঘেরের আইলে নতুন পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় বারাশিয়া, কোদালিয়া, কেন্দুয়া, কালশিরা বিলের প্রায় ৩২ হাজার বিঘা জমি প্রায় সারা বছর পতিত থাকত। অঞ্চলের গ্রামের পর গ্রাম মানুষ বর্ষাকালে ঢেঁপ খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতেন। আর অধিকাংশ পুরুষেরা কিষেন বাশ্রম বিক্রি করতে পরবাসী হতেন। গত দেড় দশকে যা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। একই জমিতে চিংড়ি, ধান সবজি চাষের যুগান্তকারী চাষ পদ্ধতির সফলতায়। এখন উল্টো পরবাসীরা আসেন তাদের ঘেরে কাজ করতে। এসব অঞ্চলের অধিকাংশ কুড়ে ঘর এখন পাকা বড়ি। সচ্ছল তাদের জীবন-যাপন পাল্টে গেছে।    

ইন্টার ক্যানেল সিস্টেমধান ও মাছ চাষে সাড়া

বোরো চাষের মৌসুমে বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনায়ইন্টার ক্যানেল সিস্টেমধান মাছ চাষিদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে। চিংড়ি ঘের সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের কৃষকরা পানি ব্যবস্থাপনার এই নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিদ্যুৎ ডিজেল ছাড়াই নিরাপদে ধান চাষের পাশাপাশি মাছ চাষ করতে পরছেন। চিংড়ি ঘের তৈরির সময় জমির চারদিকে বাঁধ দেওয়া হয়। বাঁধের পাশ দিয়ে জমির পরিমাণ অনুযায়ী ফুট থেকে ১২ ফুট চওড়া করে এবং / ফুট গভীর করে চারদিকে একটি ক্যানেল কাটা হয়। চিংড়ি চাষের শুরুতে ঘেরের মধ্যে পানি প্রবেশ করানো হয়।

ঘেরের ভিতরে চারদিকে ক্যানেল কাটার ফলে জমিতে পানি না থাকলেও ক্যানেলে সবসময় পানি থাকে। যেখানে সহজে ধানের ক্ষেতে সেচ মাছ সংরক্ষণ করা যায়। গত কয়েক বছর ধরে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি বাগেরহাটের রামপাল, মোংলা, ফকিরহাট, বাগেরহাট সদর, খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, সাতক্ষীরার তালা যশোরের কেশবপুর উপজেলার কৃষকরা পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করে ব্যাপক সুফল পেয়েছেন। ফলে এই এলাকার কৃষকদের মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনার এই নতুন পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ফয়লা এলাকার বোরো চাষি আবদুল গনি, বিলাল শেখ, হাকিম, রহমত আলী, ফকিরহাটের বেতাগার সোনালী রানী দাশ, ইউনুস আলী, শিবপদ দাস, মানস দাস, দেবপ্রসাদসহ অনেকে জানিয়েছেন, বোরো মৌসুমে এই এলাকায় নদী খালে প্রচুর পরিমানে লবন পানি আসে। খুলনার ডুমুরিয়ার শোভনা গ্রামের আফরোজা বেগম, পরিতোষ মন্ডল, আব্দুর রাজ্জাক, জিলেরডাঙ্গার বিপ্র মন্ডল, হাজারী রায় জানান, মূলত ঘেরের ভেতরের ক্যনেলকে কৃষকরা বহুবিধভাবে ব্যবহার করে বোরো মৌসুমে পানির লবনাক্ততা থেকে নিজেদের জমির ধানকে রক্ষা করেন। পানি ব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতিকে স্থানীয় কৃষক চিংড়ি চাষীরা নাম দিয়েছেনইন্টার ক্যানেল সিষ্টেম যা এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

মিশ্রচাষ পদ্ধতি

গলদা চিংড়ির সঙ্গে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কাপ, বিগহেড জাতীয় সাদা-মাছের চাষ পদ্ধতিমিশ্রচাষহিসেবে পরিচিত। স্বাদু পনির অঞ্চলে বর্ষার সময় লবণাক্ত এলাকার ঘেরেও মিশ্রচাষ খুবই জনপ্রিয়। মিশ্রচাষ পদ্ধতিতে প্রতি শতকে ৭০-৮০টি গলদা চিংড়ি এবং -৬টি কার্প জাতীয় মাছের পোনা মজুদ করা হয়। যেহেতু চিংড়ি অপেক্ষাকৃত দামি মাছ এবং এদের খাদ্য মূল্য বেশি তাই বাজার মূল্যের দিকে খেয়াল রেখে ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম আকারে রুই কাতলা মাছ ঘেরে বাপুকুরে ছাড়েন অধিকাংশ কৃষক। এগুলো চিংড়ি সংগ্রহ করার সময় প্রায় আড়াই কেজী থেকে কেজি আকারের হয়। তবে মিশ্রচাষের ক্ষেত্রে কোন রাক্ষুসে মাছ (যা চিংড়িকে খেতে পারে) ঘেরে ছাড়া হয় না। পদ্বতিতে প্রতি একরে চিংড়ি ২০০-৩০০ কেজি এবং কার্প জাতীয় মাছ ২০০০-২৫০০ কেজি হয়ে থাকে, যা বেশ লাভজনক। বিশেষকরে ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিদের মিশ্রচাষে আগ্রহ বেশি দেখা যায়।

ক্লাস্টার পদ্ধতিতে (দলগত) চিংড়ি চাষে নবদিগন্তের সূচনা

জলবায়ু পরিবর্তন আর চাষ পদ্ধতির অসচেতনতার প্রতি বছর চরম বিপর্যয়ের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে (দলগত) চিংড়ি চাষ নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবনজীবিকা আবর্তিত হয় চিংড়িকে ঘিরে। টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে চাষিরা বেশ সফলতা পাচ্ছেন। 

পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সম্পর্কে খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল জানান, ক্লাস্টার হলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত খামার সমষ্টি যা সাধারণত একই অঞ্চল পরিবেশে খুব কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত হয়। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে খামারগুলোর মধ্যে বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য। একই ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ বা অবকাঠামোর ব্যবহার, (পানির উৎস, বর্জ্য নির্গমন ব্যবস্থা ইত্যাদি); একই বা কাছাকাছি চিংড়ি চাষ পদ্ধতির অনুসরণ; একই প্রজাতির মাছ বা চিংড়ি চাষ বা মিশ্রচাষ করা; উদ্যোগী বা সম-স্বার্থসংশ্লিষ্ট দল গঠন করা হয়। চিংড়ি ক্লাস্টার এমন একটি সংগঠন যা একটি নির্দিষ্ট এলাকার চিংড়ি চাষিদের নিয়ে গঠিত হয়।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় টেকসই চিংড়ি চাষে ক্লাস্টার প্রযুক্তির সম্ভাবনা ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে সুবিধা প্রসঙ্গে তিনি জানান, এতে চিংড়ির উৎপাদন বাড়ে এবং নিরাপদ চিংড়ি উৎপাদন করা সহজ হয়। বর্তমান চাষপদ্ধতিতে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা থেকে সম্মিলিতভাবে উত্তরণের উপায় বের করা যায়। চিংড়ি চাষে পানির উৎস বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করণ সহজতর সাশ্রয়ী হয়। কারিগরি সহায়তা পাওয়া অনেক সহজ হয়। জৈব নিরাপত্তা প্রতিপালনের মাধ্যমে রোগবালাই প্রতিরোধ করে উৎপাদন বাড়ানো যায়। সম্মিলিতভাবে গুণগত মানসম্পন্ন উৎপাদন সামগ্রী সংগ্রহ করা যায় এবং উৎপাদন খরচ কমানো যায়। উৎপাদিত পণ্যের গুণমান নিশ্চিতকরণ সহজতর হয়। উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে অধিক সুবিধার পাশাপাশি যথার্থ মূল্য পাওয়া নিশ্চিত হয়।

ক্লাস্টার ফার্মিংয়ের আওতায় সংগঠিত চাষি দলের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়া অনেক সহজ হয়। ক্লাস্টারভিত্তিক সার্টিফিকেশনের যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে পণ্যের বর্ধিত মূল্য নিশ্চিত হয়। চাষির আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়। নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। প্রতিটি ক্লাস্টার এক একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে। ফলে সামাজিক সম্প্রতি বাড়ে। চিংড়ি সেক্টর অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত। এই খাতের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ নাকরে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট জায়গায় পরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ করতে হবে। এর ফলে একদিকে যেমন নিরাপদ চিংড়ির উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব গুলোও মোকাবেলা করা সহজ হবে।

বিছিন্ন ভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন ক্লাস্টার ফার্ম নিয়ে কাজ করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মৎস্য অধিদপ্তরের এসটিডিএফ (এফএও এর কারিগরি আর্থিক সহায়তায় এবং ওয়ার্ল্ডফিস বাংলাদেশ শ্রিম্প ফিস ফাউন্ডেশনের সহায়তায়) প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রকল্পটি ২০১৩-১৪ হতে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত বছরে খুলনা, বাগেরহাট সাতক্ষীরা জেলাতে ৪০টি ক্লাস্টার স্থাপন করে। এর সফল ক্লাস্টারগুলো ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি উৎপাদন পরিলক্ষিত  হচ্ছে।

ক্লাস্টার বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জগুলো প্রসঙ্গে জানানো হয়, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পারিপাশির্^কতা বিবেচনা করে উপকূলীয় অঞ্চলের লাগসই প্রযুক্তি হিসেবে ক্লাস্টারভিত্তিক মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্চ সামনে আসতে পারে। তাহলো : সঠিকভাবে ক্লাস্টার নির্বাচন করা। কারণ উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ ঘেরগুলোর আয়তন অনেক বড়। যেগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করাও অত্যন্ত কঠিন; ক্লাস্টারে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। কারণ অধিকাংশ পানি সরবরাহের খাল গুলোয় পলি জমে ভরাট হয়েছে। এছাড়া অনেক খাল বিভিন্ন জায়গায় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাওয়া; ক্লাস্টারের অধিকাংশ ঘের লিজকৃত হওয়ার কারণে ঘেরের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া। চাষিদের পুঁজির অভাব।

তবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্লাস্টার বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ গুলো মোকাবেলা করে ক্লাস্টার ভিত্তিক চিংড়ি চাষ এগিয়ে নিতে পারলে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাতটিকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। প্রযুক্তিতে চিংড়ি চাষ করতে পারলে চিংড়ির টেকসই উৎপাদন বাড়ানো যেমন সম্ভব হবে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস.এম রাসেল জানান, বাগদা-গলদা চিংড়ি উৎপাদন দ্বিগুন করতে ক্লাস্টার পদ্ধতি প্রান্তিক চাষিদের। মৎস্য বিভাগের সহযোগীতায় জেলার উপজেলায় দুর্যোগ সহিষ্ণু বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে ৯৬টি ক্লাস্টারে,আড়াই হাজার চাষি বাগদা চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন।

অনুমতি পেয়ে ভেনামি চিংড়ি চাষ বাড়ছে

সাধারণভাবে বলা হয়, পোনা ছাড়ার ৮০ দিনেই একেকটি ভেনামি চিংড়ি গড়ে ৩০ থেকে ৩২ গ্রাম ওজনের হয়। অবস্থায়ই চিংড়িগুলো বিক্রি করা যায়। বিপরীতে নোনা পানির বাগদা বা মিষ্টি পানির গলদা বিক্রির জন্য কমপক্ষে ১২০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। উপরন্তু ভেনামি চিংড়ি চাষে বাগদা-গলদার চেয়ে খরচ প্রায় অর্ধেক। তাই ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দাবী করছিলেন। অবশেষে সরকার সেই অনুমতি দেয়। গত বছরের ২৯ মাচ মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে এসংক্রান্ত চিঠি পাঠায়। একই সঙ্গেবাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেনামি চিংড়ি চাষ নির্দেশিকা জারি করা হয়।

বলা হয়ে থাকে বিদেশী প্রজাতির ভেনামি চিংড়ি দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় বিশ্বের নানা দেশে চাষ হয়। কিন্তু পরিবেশগত দিকটি বিবেচনা করে এই জাতের চিংড়ি চাষের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না। আমাদের দেশে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন প্রভাবিত অঞ্চল খুলনা, সাতক্ষীরা বাগেরহাটেই বেশির ভাগ চিংড়ি চাষ হয়। সুন্দরবন প্রতিবেশ (ইকোলজি) খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় বিদেশি প্রজাতির চিংড়ি চাষের বিষয়টি পরীক্ষাধীন ছিল। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) কর্মকর্তারা বলেন, ‘সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত কাতারের মতো দেশগুলোতেও চিংড়ির চাষ হচ্ছে। আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে এই চিংড়ি চাষের অনুমোদন পাওয়ায় চাষ বিস্তার লাভ করছে। এতে চাষিরা উপকৃত হচ্ছেন।

চিংড়ির বড় বাজার দেশেই

চিংড়ি সাধারণ খাবারের তালিকায় ঠাঁই করে নেওয়ায় চিংড়ির বড় বাজার এখন দেশেই সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত চিংড়ির দাম বিদেশের বাজারে তুলনামূলক বেশি হওয়ায় রপ্তানির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কমেছে, তবে দেশে চিংড়ির বাজার ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে উৎপাদিত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানিতে ভাটা পড়লেও উৎপাদকরা তা বাজারজাতকরণে সমস্যায় পড়ছেন না। চিংড়ি উৎপাদক, রপ্তানিকারক মৎস্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮০-এর দশকে মূলত চিংড়ি চাষ শুরু বিস্তার ঘটেছিল বিদেশি বাজারের ওপর নির্ভর করে।

সমৃদ্ধির সোপান হতে পারে চিংড়ি

এখন দেশের কয়েক কোটি মানুষের জীবনজীবিকা আবর্তিত হয় চিংড়িকে ঘিরে। এখানে চিংড়ি চাষির পাশাপাশি চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী, চিংড়ি ক্রেতা বিক্রেতা, আড়তদার, রপ্তানিকারক কোম্পানি, নারী-পুরুষ শ্রমিকসহ অনেকে জড়িত রয়েছেন। চিংড়ির সঙ্গে জড়িত সব স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এবং দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করার জন্যপরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চিংড়ির টেকসই উৎপাদন বাড়ানোএকান্ত আবশ্যক। ক্ষেত্রে ফসলি জমি বসতি রক্ষায় আইনসহ নীতিমালা প্রনয়নের পাশাপশি যথাযথ সরকারী উদ্যোগ গ্রহন বাস্তবায়ন জরুরী। তাহলেসাদাসোনা চিংড়িবেকারত্ম হ্রাস এবং আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধির সোপান হিসেবে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মত দেন।

বাবুল সরদার, বাগেরহাট

×