ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

নর্তকী থেকে প্রভাবশালী শাসক হয়ে উঠেছিলেন যে নারী

প্রকাশিত: ২০:৪০, ৪ মে ২০২৫

নর্তকী থেকে প্রভাবশালী শাসক হয়ে উঠেছিলেন যে নারী

ছবি: সংগৃহীত।

পুরান দিল্লি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইতিহাসের স্রোতে ভেসে চলেছে। এই নগরীর আনাচে-কানাচে আজও ছড়িয়ে আছে অতীতের স্মৃতির মলিন চিহ্ন। ঠিক এমনই এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রাসাদ, যা এককালে ছিল এক রহস্যময় নারীর বাসস্থান— বেগম সামরু। একজন সাধারণ নর্তকী থেকে যাত্রা শুরু করে কালের পরিক্রমায় যিনি হয়ে ওঠেন পরাক্রমশালী শাসক ও কূটনীতিক। তার জীবনের এই যাত্রাপথ যেন এক রূপকথার গল্প।

১৭৫০ সালের দিকে জন্ম নেওয়া ফারজানা নামের এই নারীকে নিয়েই শুরু হয় বিতর্ক। কেউ বলেন তিনি অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন, আবার কেউ বলেন তিনি ছিলেন এক এতিম মেয়ে। শৈশবেই তিনি পৌঁছে যান দিল্লির এক বাইজি কোঠায়। এখানেই তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে অস্ট্রিয়ান ভাড়াটে সেনাপতি ওয়াল্টার রেইনহার্ড-এর, যিনি ইতিহাসে পরিচিত “পার্টনার কসাই” নামে।

মাত্র ১৪ বছরের কিশোরী ফারজানার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান ৪৫ বছরের রেইনহার্ড। সেখান থেকেই শুরু হয় ফারজানা থেকে বেগম সামরু হয়ে ওঠার গল্প।

বেগম সামরু ছিলেন নিজস্ব বাহিনীর অধিনায়ক। তার সেনাবাহিনীতে ছিল ইউরোপীয় ভাড়াটে যোদ্ধারাও। ১৮শ শতকের ভারত তখন মোগল সাম্রাজ্যের অন্তিম অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। স্থানীয় শাসকদের বিদ্রোহ, ব্রিটিশদের আগ্রাসন ও মোগলদের দুর্বলতার মাঝেই বেগম সামরু নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটান।

রেইনহার্ডের মৃত্যুর পর তিনি গ্রহণ করেন সারধানা রাজ্যের শাসনভার, যা দিল্লি থেকে প্রায় ৮৫ মাইল দূরে অবস্থিত। সেই সময় তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার রাজ্যে একটি বিশাল চার্চ নির্মাণ করেন— যা আজও দাঁড়িয়ে আছে। বেগম সামরু সেখানেই সমাহিত হন। কেউ মনে করেন, ব্রিটিশদের খুশি করতেই তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, আবার কেউ বলেন— তিনি প্রকৃত বিশ্বাস থেকেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

বেগম সামরু ছিলেন একজন অসাধারণ রাজনৈতিক চরিত্র। মোগল দরবারে নৃত্যশিল্পী থেকে হয়ে ওঠেন কূটনীতিক এবং ক্ষমতাশালী শাসক। মোগল বাদশাহরা যখন কোনও সংকটে পড়তেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন সামরু। তার সেনাবাহিনী সর্বদা প্রস্তুত থাকত শত্রুকে প্রতিহত করতে।

তার কূটনৈতিক দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা তাকে এনে দেয় "জেবুন্নেসা" বা "নারীদের অলংকার" উপাধি।

বেগম সামরুর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল রহস্যময় ও নাটকীয়তায় ভরা। তার জীবনে একের পর এক ইউরোপীয় প্রেমিক এসেছে, আবার চলে গেছে। একজন ফরাসি প্রেমিকের সঙ্গে পরাজয়ের পর তিনি একসঙ্গে আত্মহত্যার পরিকল্পনাও করেছিলেন। সেই সময় তিনি নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করেন, প্রেমিকটি আত্মহত্যা করেন বন্দুক দিয়ে। কিন্তু সামরু সেই যাত্রায় বেঁচে যান।

১৮৩৬ সালের জানুয়ারিতে মৃত্যু ঘটে বেগম সামরুর। রেখে যান বিপুল ধনসম্পদ— যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৪০০০ কোটি ডলার বলে ধারণা করা হয়। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই সম্পদ দখল করে নেয়।

তার নির্মিত সারধানা চার্চেই আজও রয়েছে তার সমাধি। একটি সাদা পাথরের বিশাল ভাস্কর্য স্মরণ করিয়ে দেয়— তিনি একসময় এই উপমহাদেশের একজন প্রভাবশালী নারী শাসক ছিলেন।

আজকের পুরান দিল্লির ভাগীরথ প্রাসাদে আর বেগম সামরুর কোনও দৃশ্যমান চিহ্ন নেই। সময়ের সাথে সাথে তার স্মৃতিও হয়তো মলিন হয়ে গেছে। তবে ইতিহাসের পাতায় আজও ছিটেফোটা ছাপ রেখে গেছে এই নর্তকী থেকে শাসক হয়ে ওঠা নারীর রোমাঞ্চকর জীবনগাঁথা।

নুসরাত

×