শিশুরা গায়ে কাদামাটি মেখে বৃষ্টির অপেক্ষায়
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে/ ছায়া দেরে তুই আল্লাহ- আব্বাস উদ্দীনের গানের এই সুর ধরে এমন কিছু গান গেয়ে গ্রামের শিশু ও প্রবীণ নারী-পুরুষ বৃষ্টির জন্য বিশেষ প্রার্থনা করেছেন। রবিবার বেলা সাড়ে ১২টা থেকে ২ টা পর্যন্ত মানিকগঞ্জের ঘিওরে ফসলের মাঠে বৃষ্টির আশায় এলাকাবাসী আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানিয়েছেন। এর পর শিশু-কিশোররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেচে-গেয়ে, পানি ছিটিয়ে চাল-ডালও সংগ্রহ করেন। সন্ধ্যার পর সেই চাল-ডাল দিয়ে তৈরি শিরনি বিতরণ করা হয় গ্রামবাসীর মাঝে।
বাঙালির অতি প্রাচীন এই সংস্কৃতির দেখা মিলেছে উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের বাষ্টিয়ায় (পুরান গ্রামে)। বাষ্টিয়া, গুবিন্দী ও পুরান গ্রামবাসী এ প্রার্থনার আয়োজন করে। দুপুরের তপ্ত রোদে শত বছরের বেশি সময়ের ঐতিহ্যবাহী কাদা মাখিয়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা হয়। নিচু এক ফসলের মাঠে পানি ছিটিয়ে কর্দমাক্ত করা হয়েছে।
সেই কাদায় পোঁতা হয়েছে চারটি কলাগাছ, মাঝে মাটির ছোট একটি কলস। তার চারপাশে হাঁটু গেঁড়ে সারাশরীরে কাদা মাখিয়ে মাটি চাপড়ে আর দু’হাত আকাশপানে তুলে তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করছেন। এতে অংশ নেয় সীমান্ত, আলমাস, লিমন, ইমরান, সুমাইয়াসহ বেশ কয়েক শিশু। পাশে বসা গাঁয়ের কয়েক প্রবীণ নারী-পুরুষ। তাদের ওপর পানি ছিটাচ্ছেন এবং দলবেঁধে গাইছেন আল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে তুই আল্লা। এর পর গাঁয়ের প্রবীণরা একসঙ্গে বৃষ্টির জন্য ইস্তিস্কার নামাজ ও বিশেষ মোনাজাত করেন। পুরান গ্রামের বাসিন্দা প্রবীণ আমছের আলী (৮৫) বলেন, গরমে জনজীবন শেষ। অনেকদিন বৃষ্টি হয় না। পূর্বপুরুষদের রীতি অনুযায়ী বৃষ্টির জন্য এই প্রার্থনা করা হয়। গুবিন্দী গ্রামের আমেজা বেগম (৭০) ও রেনু বেগম (৬৫) বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি বৃষ্টির জন্য কাদা মাখিয়ে আলার কাছে বৃষ্টি চাইছি। আগে জিকির হইতো, শিন্নী হইতো। আজকালের মানুষ এখন আর এগুলো মানতে চায় না।
বাষ্টিয়া গ্রামের সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ রীতি আমাদের গ্রামে শত বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, কৃষিপ্রধান বাংলায় এই দাবদাহ আর অনাবৃষ্টিতে ফসলের মাঠ হয়ে ওঠে বিবর্ণ। সব জলাশয় শুকিয়ে যায়। দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি আর তাপপ্রবাহের হাত থেকে রক্ষা পেতে বৃষ্টির জন্য জিকির-আসকার, ইসতিসকার নামাজ, শিন্নী বিতরণ, কাদা মাখানো, মেঘপূজা, হুদমা গান, তালতলার শিন্নী, ব্যাঙের বিয়েসহ নানা আচার পালন করত। এমনও দেখা গেছে, এসব আচার-অনুষ্ঠান পালনের সময়ই ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামত। কিন্তু কালপরিক্রমায় তা আজ বিলুপ্তির পথে।
ঘিওর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান বলেন, বৃষ্টির দেখা না পেলে বাংলার বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ বৃষ্টির জন্য আদি সংস্কৃতি ও লোকজ সংস্কৃতি অনুযায়ী নানা নিয়মাচার ও লোকাচার পালন করত। কালের পরিক্রমায় বৃষ্টির জন্য বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সেই সমৃদ্ধ অধ্যায়টি আজ এক প্রকার বিলুপ্তই বলা চলে। কিছু কিছু আচার এখনো পালিত হয়।