![একুশের অক্ষয় চেতনা, শুধু মেলা নয় মিলনের তীর্থ একুশের অক্ষয় চেতনা, শুধু মেলা নয় মিলনের তীর্থ](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023January/b1-2301231736.jpg)
আর কদিন পর শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে সাজসজ্জার কাজ
বইমেলার সময়টা চলে এসেছে, ভাবতে কী যে ভালো লাগে! উন্নত চেতনার বইপ্রেমীরাই শুধু মেলাটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন, না, এমন নয়। কালেভদ্রে বই হাতে তুলে নেন যারা, যারা এক সময় কিছু না কিছু পড়েছেন, তারাও ছুটে আসেন। বইয়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগহীন মানুষজনও মেলায় এসে কোনো না কোনো বই কিনে বাড়ি ফেরেন। আর লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের কাছে বইমেলা শুধু তো মেলা নয়, মিলনের তীর্থ।
বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চায়, বিকাশে, বাঙালি সংস্কৃতির বহমান উদার অসাম্প্রায়িক ধারায় অনন্য সংযোজন বইমেলা। মাসব্যাপী আয়োজন ভাই হারানোর ব্যথা আর মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভাষা আন্দোলনের অবিনাশী চেতনা, বর্ণমালার গৌরব এত বৃহৎ পরিসরে আর কোথাও তুলে ধরতে দেখা যায় না।
ইতিহাসটি কারও অজানা নয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল বাঙালি। রফিক, শফিক, বরকত ও জব্বারের তাজা রক্ত গড়েছিল নতুন ইতিহাস। তাদের রক্তে প্রাণ পায় আ মরি বাংলা ভাষা। ভাষার প্রতি ভালোবাসা, বর্ণমালার প্রতি প্রেম পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারায় পথে চলতে সহায়তা করে। একই চেতনার জায়গা থেকে বলিষ্ঠভাবে কাজ শুরু করেছিল বাংলা একাডেমি। বইমেলা আয়োজন তাদের কাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখন।
মেলাটি ঠিক কখন, কীভাবে শুরু হয়েছিল- তা নিয়ে এখনো কিছুটা ধোঁয়াশা আছে। আছে আলাদা আলাদা মত। একটি জোরালো মত এই যে, ব্যক্তি উদ্যোগে চিত্তরঞ্জন সাহা এই মেলার সূচনা করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউসের বটতলায় চটের বস্তা পেতে বসেছিলেন এই প্রকাশক। মাত্র ৩২টি বই। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা এসব বই প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী)। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান।
নিজের প্রকাশিত বই নিয়ে একাই উদ্যোগটি অব্যাহত রাখেন চিত্তরঞ্জন। যত দূর জানা যায়, ১৯৭৬ সালে উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৮ সালে মেলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয় বাংলা একাডেমি। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। কোনো কোনো সূত্রমতে, ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করেন। বর্তমানে মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। বর্তমানে খোলা এ উদ্যানই মেলার মূল ভেন্যু। প্রতি বছরের মতো এবারও প্রস্তুত হচ্ছে ঐতিহাসিক উদ্যান।
সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল রাজ্যের ব্যস্ততা। এরই মাঝে শূন্য উদ্যান মেলার আকার ও আকৃতি পেয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে সর্বত্র। করাত চালানোর শব্দ, পেরেক ঠুকাঠুকির আওয়াজ সাধারণ সময়ে বিরক্তির উদ্রেক করে। এখন উল্টোটা হচ্ছে। শব্দ কানে আসতেই মিলনের বার্তা পাচ্ছেন বইপ্রেমীরা।
এদিকে, করোনাকালে সশরীরে বাংলা একাডেমিতে এসে মেলা উদ্বোধন করতে পারেননি সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। এবার তিনি আসছেন। প্রধানমন্ত্রী একাডেমি চত্বরে নির্মিত মঞ্চ থেকে মেলা উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে নিতে হচ্ছে বাড়তি প্রস্তুতি। একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢুকতেই সে প্রস্তুতির খুঁটিনাটি চোখে পড়ল। মেলা মঞ্চের মূল কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। চলছে স্টলের অবকাঠামো পুরোপুরি প্রস্তুত করার কাজ।
দিনের হিসেবে এবার একটু দেরি করেই কাজ শুরু করেছিল আয়োজক বাংলা একাডেমি। ফলে প্রস্তুতি বিবেচনায় এখনো অনেক কিছুই বাকি। তবে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি নুরুল হুদা বলছেন, তাদের দিক থেকে যত যা প্রয়োজন সবই করা হচ্ছে। যথাসময়ে সব কাজ শেষ হবে। মেলাও এবার বেশ জমজমাট হবে বলে আশা তার।
অবশ্য অমর একুশে বইমেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য গড়ে দেয় লেখক, পাঠক ও প্রকাশকরা। সকলেই পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। বাৎসরিক এই মিলনের তীর্থ হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এ প্রসঙ্গে কবি ও জার্নিম্যান বুকসের কর্ণধার তারিক সুজাত বলছিলেন, বইমেলায় বই বিক্রি মূল কথা নয়। বইয়ের সূত্রে সৃজনশীল মানুষের একত্রিত হওয়ার সুযোগ পান। কথা হয়। গল্প, আড্ডা জমে। এসবের মধ্য দিয়েও অনেক কিছু পাওয়ার থাকে। মেলার জন্য তিনি নিজেও অপেক্ষা করে আছেন বলে জানান তারিক সুজাত।
কোনো কোনো কৌতূহলী পাঠকও আগেভাগে চলে আসছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ঘুরে ঘুরে মেলার প্রস্তুতি দেখছেন। সুমন নামের এক পাঠক বলছিলেন, পত্রিকায় পড়ছিলাম মেলার প্রস্তুতি কথা। টিভিতে দেখছিলাম। আজ এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় ঢুকে পড়লাম উদ্যানে। দেখে মনে হচ্ছে, মেলা শুরু হয়ে গেছে! পুরো একটা মাস মেলা চলবে। প্রায় প্রতিদিন বন্ধুরা মিলে আসব। তার আগে দেখতে এলাম। মেলার রংটা বলতে পারেন আগেই ছুঁয়ে দিল আমাকে!