ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

নির্বাক গোধূলি

মো. আবদুর রহমান

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ২৫ নভেম্বর ২০২২

নির্বাক গোধূলি

.

গার্মেন্টস ছুটির সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সব হুরপার করে গাড়িতে উঠতে শুরু করল। কেউ আবার হাঁটতে শুরু করল। কেউ চেপে বসল রিকশায়। তবে মায়া রাস্তার একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তার কাছে মনে হলো পৃথিবীর সবার কাছেই ছুটির আনন্দটা বুঝি একই রকম। সেটা হোক বিদ্যালয়, হোক মকতব, আর অফিস কিংবা গার্মেন্টস। এবার একপাশ দিয়ে কচ্ছপগতিতে গেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকল মায়া। রাস্তার নিয়ন আলোগুলো এর মধ্যেই জ্বলে উঠেছে। আর সেই সুযোগে মশাগুলোর কানের গোড়ায় ভন ভন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জুড়ে দিয়েছে। রাস্তার পাশের অপরিষ্কার ড্রেন থেকেই মূলত এই মশার সূত্রপাত। আজ খুব অস্বস্তি লাগছে হাঁটতে। পার্সেল ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করে নাক ঢাকার চেষ্টা করল...। ঠিক তখনই পিছন থেকে জামাল ঘাড়ে হাত রেখে বললো চলো।
জামালের মুখের এক ঝলক হাসি দেখে সব কষ্ট বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিল মায়া। আট বছর এভাবেই জামাল তাকে রৌদ্রে ছায়া হয়ে, বৃষ্টিতে ছাতা হয়ে এবং শীতে চাদর হয়ে আগলে রেখেছে। দাঁড়িপাল্লায় ভাগ করে নিয়েছে সকল সুখ-দুঃখ। সুখের অনুভূতিটা এবং চেহারাটা যে কেমন, সেটা দেখেছে সে জামালের সংসারে এসে।
আজ অবশ্য মাসের পনেরো তারিখ, বেতন হয়েছে জামালের। তাই মনের আনন্দে একটি রিকশা ভাড়া করতে চাইল জামাল। এদিকে মায়াও মা হতে চলেছে। এ সময়টা হাঁটা উচিৎ নয়। অনেক বছর অনেক চিকিৎসার সুবাদে আজ তাদের সন্তান আসতে চলেছে। তাই এই মুহূর্তে কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নয় জামাল। কিন্তু মায়াকে কোন ভাবেই রাজি করাতে পারল না।
আমি খুব হেঁটে যেতে পরবো। চলো আমরা বরং গল্প করতে করতে চলে যাই।
আসল উদ্দেশ্যটা টাকা বাঁচানো। এটা বুঝতে একটুও বাকি রইল না জামালের। হাঁটতে শুরু করল দুজনে হাত ধরাধরি করে জমজমাট শহরের বুক চিড়ে। তবে জামালের বুঝতে বাকি রইলো না মায়ার হাঁটতে বেশ কষ্টই হচ্ছে। ভিতরে ভিতরে জামালের বুকেও কষ্টটা ঘুরপাক খেতে শুরু করল প্রতি ন্যানো সেকেন্ডে। আসলে এর নামই হয়তো ভালোবাসা। এর কোনো সংজ্ঞা হয় না, বৈশিষ্ট্য হয় না। তবে কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়, আর সেই মস্ত এক উদাহরণ এই মুহূর্তে রাজধানী রাস্তায় গার্মেন্টস কর্মী জামাল এবং মায়া। সামনে কিছু দোকান পড়ল। তার মধ্যেই একটা হোটেল থেকে ঢাকাইয়া বিরানির সুঘ্রাণ এসে নাকে বৈশাখী ঝাপটা দিল। সেদিকে অবশ্য এক নজর আরচোখে তাকালো মায়া। সঙ্গে সঙ্গেই জামাল থামলো, ‘শোনো মায়া-তুমি এখন খুব ক্লান্ত, বাসায় গিয়ে কোন রান্নার ঝামেলা করা দরকার নেই। তাছাড়া আজ আমার যেহেতু বেতন হয়েছে...।’
-আমার এসব খেতে মন চাইছে না।
-না আমি তোমাকে বাসায় গিয়ে এখন রাঁধতেই দেব না।
-কি মুশকিল! ঠিক আছে তুমি যখন এতো করেই বলছো। তাহলে বিরানি নয়, চারটা পরাটা ও দুটো ডিম নিয়ে চলো। অন্তত ডিমটাতো বাসায় ভাঁজতে দিবে...।
মায়ার কথা মতোই দোকানে টাকা দিয়ে জিনিস কিনে আবার হাঁটতে শুরু করলো সেই আগের গিয়ারে। মায়া আরও শক্ত করে জামালের হাত দুটো চেপে ধরে বললো, জানো আমার খুব ইচ্ছে হয়- গোধূলি বেলায় আমরা হেঁটে বেড়াবো, আর সঙ্গে...।
-সাথে কী বলো?
-‘যা বুঝে না!’
-ও আচ্ছা আমাদের বাবুটা।
বলেই দুজনেই প্রাণখুলে হাঁসতে শুরু করলো..। হঠাৎ, দাঁড়িয়ে গেলো মায়া। জামাল বুঝলো আসলেও মায়ার কষ্ট হচ্ছে। তাই সে বললো, শোনো মায়া কাল থেকে তোমার গার্মেন্টসে আসার প্রয়োজন নেই। আমি আর তোমাকে ঝুঁকি নিতে দিবো না। আমাকে কথা দাও আর আসবে না।’
ঠিক আছে চলো আমি ঠিক আছি। আর শোনো এ মাসের মাত্র পনের দিন বাকি আছে। এই পনের দিন করলেই আর এক মাসের বেতন পাওয়া যাবে। তাছাড়া কালতো আমার বেতন হবে। তারপরের মাসে না হয় কাজ করলাম না। জানইতো টাকা পয়সার তো একটু দরকার।
মন খারাপ করে রইল জামাল। নিজেকে এই মুহূর্তে বড় অসহায় মনে হচ্ছিলো। যাহোক বাসায় ফিরে বেতনের আট হাজার টাকা তুলে দিলো মায়ার হাতে। সেখান থেকে পাঁচ হাজার বাসা ভাড়া শোধ করল। আর বলল, কাল আমার সাত হাজার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে বাবা-মায়ের জন্য পাঁচ হাজার পাঠিয়ে দেব। বাকি পাঁচ হাজার সংসার খরচ; মনে রেখো।
এবার জামাল বুঝতে পারলো, কেনইবা মায়া রিকশায় উঠতে চায়নি? আর কেনইবা বিরানি খেতে চায়নি। কারণ সে প্রতিমাসের দুজনের বেতনের মাত্র এই পনের হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা জামালের মা-বাবাকে পাঠায়। জামালের চোখ দুটো ছলছল জলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মায়া বললো, ‘তুমি কেন এমন করো বলোতো! আমি অনেক সুখে আছি। আসো এবার খাবে চলো..।’
পরের দিন সকালে সাইরেন বাজার পূর্বেই মায়াকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে নিজ কর্মস্থলে গেলো জামাল। মন দিয়ে কাজ করছে। যদিও মাঝেমাঝে সেই মনে ভেসে উঠছে কখনও মায়ার মুখ আবার কখনও বা আগত সন্তানের মুখ। আর তাতেই নিজে নিজে হাসছে, আবার কেউ জিজ্ঞেস করলেই কিছু না বলে আবার কাজে মন দিচ্ছে। আসলেও বাবাদের ভাবনাটা এমনটাই হয়।
যাহোক এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বেলা দুইটা। এবার টিপিন বাটিটা হাতে নিল। খুলে দেখল মায়া সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে আলু ভর্তা, এক টুকরো লেবু, আর একটা ডিম সিদ্ধ। বুঝতে বাকি রইলো না গত রাতে নিজের ভাগের ডিমটা না খেয়ে জামালের জন্য রেখে দিয়েছিল মায়া। কিন্তু জামালও ডিমটা খেতে পারলো না। সেও সিদ্ধান্ত নিল এটা বাসায় নিয়ে মায়াকেই খাওয়াবে। কারণ এটা ওর খাওয়া এখন বেশি জরুরি।
ঠিক সেই মুহূর্তে দক্ষিণ দিক থেকে চিৎকার আর চেঁচাচেচি শুরু হলো। সব ছুটে পালাতে লাগল। এমনকি ঢাকা শহরের কাকগুলো কা কা করতে করতে শান্তির খোঁজে পালাতে লাগল এক ইলেকট্রিক পাইলন থেকে অন্য ইলেকট্রিক পাইলনে। জামালের বুঝতে বাকি রইলো না মায়াদের গার্মেন্টসে কোন সমস্যা হয়েছে। হাতটা ধুয়ে দৌড় শুরু করলো সেদিকে। ঘটনা জানতে পারলো শ্রমিকদের বেতন আজকেও না দেওয়ায় আন্দোলন শুরু করেছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে গার্মেন্টসের নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্স লাঠি চার্জ শুরু করেছে শ্রমিকদের ওপর। এদিকে মায়াকে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো জামাল। হঠাৎ তার চোখে পড়লো একটা মেয়ে রাস্তায় পড়ে চিৎকার করছে। দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখে মায়া! ফেরার সময় লাঠি চার্জে আহত হয়েছে সে! রক্তে তার পুরো সালোয়ার ভিঁজে গেছে! আর শুধু বলছে আল্লাহ আমাকে বাঁচাও। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না। আসলে কেউ শোনেও না। বরং তাকে পা দিয়ে মারিয়ে যার যার জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ যেন এক যুদ্ধের মাঠ। আর যেখানে জামালই হলেন একমাত্র সমর নায়ক। অবশেষে একাই মায়াকে কোল পাজা করে, অনেক কষ্টে পাশেই একটি ক্লিনিকে নিলো জামাল।
ক্লিনিকের বাইরে অপেক্ষায় বন্দী টিয়া পাখির মতো ছটফট করতে লাগলো বেচারা। অবশেষে ডাক্তার বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাউকাউ করে তার হাত ধরে কেঁদে ফেলল জামাল। ডাক্তার সান্ত¡না দিয়ে বলল উনি এ যাত্রায় রক্ষা পেলেন।
 -আলহামদুলিল্লাহ, ডাক্তার সাহেব আর বাবুটা?
-আমি দুঃখিত জামাল সাহেব!
শোনার পর যেন জামালের সন্তান হারানোর বেদোনার চিৎকারে কেঁপে উঠলো পুরো ঢাকা শহর। আট বছরের তিল তিল আশার ঝুলিটা একদম শূন্য হয়ে গেলো।  নির্বাক হয়ে গেলো পুরো ক্লিনিক। সমস্ত মহসাগরগুলো যেন শুকিয়ে হলো মরুভূমি। আর জমিন হলো নীল নদ। তার মাঝদিয়েই যেন শামুকগতিতে মায়ার পাশে গিয়ে হাত দুটি ধরলো জামাল। কান্না চেপে রেখে বললো, মায়া তুমি যখন ঠিক আছো আমার আর পৃথিবীতে কিছুই লাগবে না। কিন্তু মায়া কোন কথা বললনা, চোখ নাড়ালো না, এমনকি ইশারাও করলো না, শুধু জানালা দিয়ে গোধূলির আলোতে তাকিয়ে রইল। আর কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল জামালের হাতে!

 

×