ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ২১:৪১, ৭ জানুয়ারি ২০২২

সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ

নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির সংলাপ চলছে। এই সংলাপ চলমান অবস্থায়ই বাংলাদেশ একটি ইংরেজী বছর শেষ করে প্রবেশ করেছে নববর্ষে। অর্থাৎ, সংলাপের চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাংলাদেশ নতুন বছরে প্রবেশ করেছে। সংলাপটি চ্যালেঞ্জ এই কারণে যে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ নিয়ে আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই হচ্ছে বেশি। দেশের ভঙ্গুর এক সময়ের প্রধান বাম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)সহ কয়েকটি দল সংলাপ বর্জন করেছে। বিএনপি সংলাপে অংশগ্রহণের বিষয়ে নানা সময়ে নানা কথা বলেছে। প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে বলেছে, যাবে না। আবার ঘরোয়াভাবে বলেছে, আমন্ত্রণ পেলে তখন তারা দেখবে। ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ১২ জানুয়ারি সংলাপে যাওয়ার জন্য। তখন জানা যাবে, বিএনপি আদৌ সংলাপে যাবে কি যাবে না। তবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনকৃত অপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। তার পরও প্রশ্ন উঠেছে, এই সংলাপের কি আদৌ কোন দরকার ছিল! নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে এবার তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ফলে যৌক্তিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে, বার বার কেন একই কায়দায় ইসি গঠন নিয়ে সংলাপ। যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করা যায়নি, তাই এবার অন্তত ভিন্ন পথে যাওয়া উচিত ছিল। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এখন অনেক কথাই বলছেন। যাদের বেশিরভাগ কথাই ক্ষমতার বাইরে থাকা জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তা হলে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বিএনপি ও তাদের উত্তরসূরি জাতীয় পার্টি তো দীর্ঘ ১৫ বছর দেশ শাসন করেছে। তখন তারা বা তাদের পূর্বসূরিরা কেন নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন নিয়ে মাথা ঘামালেন না। এমনকি সামরিক শাসন যে এদেশে অবৈধ তা নিয়েও তারা টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি। আবার তাদের অনুকূল সরকার তো ২০০৭ ও ২০০৮ সালে দেশ শাসন করেছে। সবচেয়ে উত্তম সুযোগ ছিল ওই সময়েই এই ঝামেলা শেষ করে ফেলার। সেটাও কেন তারা করলেন না। এখন সব দায় এসেছে-চেপেছে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর। আওয়ামী লীগ কী এতই বোকা যে, তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আবার ২০০১ পরবর্তী অবস্থা দেশে ফিরিয়ে আনবে? এখানে রাজনীতি বুঝতে হবে? আওয়ায়ী লীগ যে সেই রাজনৈতিক পথেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নতুন বছরে সবার চোখ থাকবে নির্বাচন কমিশন গঠনের দিকে। ফলে একটি যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। সব দলের আলোচনার ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ ও বিতর্কহীন নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব না হলে সামনের বছরের জাতীয় নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই, গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন সবারই প্রত্যাশা। আওয়ামী লীগ যে তাদের মতো করেই নির্বাচন কমিশন গঠন করবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সেটি যেন মোটামুটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় সেটাই নতুন বছরে সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। যদিও নির্বাচন কমিশন গঠন করে সবাইকে খুশি করা যাবে না। বিশেষ করে বিএনপি এবং তার সমর্থনকারী সুশীল সমাজ কখনই খুশি হবে না। তবে তাদের নিয়েই তো দেশ নয়। তাদের ছাড়া দেশে আরও বৃহৎ সচেতন গোষ্ঠী আছে। রাজনীতি বাদ দিলে দেশের এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা করোনাভাইরাসের ওমিক্রনের ধরন মোকাবেলা। এটি সফলভাবে মোকাবেলার ওপর নির্ভর করছে ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা। গত দুই বছর ধরে করোনাভাইরাসের আক্রমণের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। নতুন করে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ। ইতোমধ্যে এই সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। ওই সভায় ফের বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই বিধিনিষেধের মধ্যে থাকছে- অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচল, দোকানপাট, শপিংমল রাত আটটা পর্যন্ত খোলা রাখা, টিকার সনদ ছাড়া হোটেল-রেস্তরাঁয় খাওয়া বন্ধ, সবার জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগের মতোই সীমিত ক্লাস। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে ১৫ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনায় কাজ না হলে পুনরায় লকডাউনে যাবে সরকার। ইতোমধ্যে অনেক দেশে বিধিনিষেধ আরোপসহ আরোপ করা হয়েছে লকডাউন। ফলে নতুন বছরেও করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন যেহেতু অতিদ্রুত বিস্তার লাভ করতে সক্ষম; তাই এই ভ্যারিয়েন্টের মোকাবেলা করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ, জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের শিথিলতা দেখা যাচ্ছে। তাই নিয়মনীতিগুলো পালনের ব্যাপারে আরও সোচ্চার হতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে আইনের প্রয়োগও করতে হবে কঠোরভাবে। এ ছাড়া শতভাগ মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় আনা বাংলাদেশের জন্য এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষকে ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে টিকার আওতায় আনতে চায় সরকার। কিন্তু ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মাত্র ২৮.৪৪ শতাংশ মানুষ দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেয়েছেন। মহামারী থেকে পরিত্রাণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা পাওয়ার সমঅধিকার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে প্রায় ১০ কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পর সরকার এখন বুস্টার ডোজের কার্যক্রম শুরু করেছে। বুস্টার ডোজ হিসেবে দেয়া হচ্ছে ফাইজার, মডার্না এবং অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। কিন্তু জনসংখ্যার বিচারে তা এখনও সন্তোষজনক নয়। ফলে শতভাগ মানুষের জন্য করোনাভাইরাসের শতভাগ টিকা নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। এ চ্যালেঞ্জে সফল হতে হলে টিকার কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। দেশের সব জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। গত বছরের শেষদিকে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে আইনশৃঙ্খলা বিশেষ করে র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রকাশ বাংলাদেশের জন্য কিছুটা হলেও নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে বহির্বিশ্বে। র‌্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এখনও দেশে নানা আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে একতরফা বলে বর্ণনা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। সরকার এই নিষেধাজ্ঞায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদও জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। দেয়া হয়েছে চিঠি। আবার সরকারের পক্ষ থেকে লবিস্ট নিয়োগের বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সরকার মনে করছে, আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে। আবার নিষেধাজ্ঞার পর পরই আইনশৃঙ্খলা রিপোর্টে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে একই সঙ্গে লেখক অভিজিত রায়ের পলাতক খুনীদের তথ্যের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতে বোঝা যাচ্ছে, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা যতটা না মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের কারণে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর বিশ্লেষণ থেকেও এই বিষয়টি প্রতীয়মান হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। প্রতিটি লেখাতেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ভূরাজনৈতিক ইস্যুকে। এসব লেখায় বলা হচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন গোড়া থেকেই এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নজর দিয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা চীনকে মনে করছে তাদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এবং চীনের যে প্রভাব বলয় বিস্তার হচ্ছে, সেটা তারা রোধ করতে চাচ্ছে। সেজন্য তারা বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র হয়ত বাংলাদেশকে চীনের ব্যাপারে সতর্ক করতে চাচ্ছে। তবে আলোচনা যাই হোক, র‌্যাবের ওপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কাটানো নতুন বছরে সরকারের জন্য আরও একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে আলোচনার মাধ্যমেই করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমেই কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তন করা সম্ভব। তবে শুধু আলোচনা করলে হবে না। নিষেধাজ্ঞার পেছনে যেসব কারণ দেখানো হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারেও তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে র‌্যাবের জবাবদিহি নিশ্চিত করাসহ কাঠামোগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হতে পারে। আলোচনায়ই বলে দেবে কী করতে হবে। সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে এসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় যে গোষ্ঠী-সাধারণ ভোক্তাশ্রেণী তাদের একেবারেই মাথা ব্যথা নেই। তাদের প্রধান মাথা ব্যথা খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য। ২০২১ সালের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালেও চলছে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের দাপট। যার বেশিরভাগই ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে হচ্ছে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলছে সরকার। ফলে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণও সরকারের সামনে নতুন বছরের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে দেশে যে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য চলছে তাতে সরকারেরও ভূমিকা আছে। বিদ্যুত ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় হঠাৎ করেই দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়ে দিয়ে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যকে আরও উস্কে দিয়েছে। এক ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণেই দেশের সব কিছু ল-ভ- হয়ে গেছে। ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে। পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির কারণে সব পণ্যের দাম আরও একদফা বেড়েছে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম। যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে মূল্যস্ফীতিতে। দেশে ২০২১ সালের শেষে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। তাই নতুন বছরে অন্তত দেশের সাধারণ মানুষকে খুশি করার জন্য যেসব পণ্য তাদের জরুরীভাবে দরকার হয়, সেই পণ্যগুলোর দিকে সরকারের বিশেষ নজর দেয়া উচিত। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি ইত্যাদি পণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা উচিত। যাতে ভোক্তা অন্তত এই করোনা মহামারীর মধ্যে একটু খেয়ে-পরে ভাল থাকে। ভরা মৌসুমের তুলনায় এখন চালের দাম অনেক বেশি। এর কারণ হলো, উৎপাদক আর ভোক্তার মাখখানে একটি গোষ্ঠী বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারকে এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে বাজার স্থিতিশীল থাকে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর দীর্ঘদিন লকডাউন কার্যকর থাকায় তার একটা প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করে। তাদের বড় একটি সংখ্যক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারী-বেসরকারী চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ আর ২৭ লাখ বেকার। আর সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের সুযোগ পান না, এ রকম ব্যক্তি (লেবার আন্ডার ইউটিলাইজেশন), যাদের ছদ্ম-বেকার বর্ণনা করা হয়, এ রকম মানুষ আছেন আরও প্রায় ৬৬ লাখ। তারা চাহিদা মাফিক কাজ না পেয়ে টিউশনি, রাইড শেয়ারিং, বিক্রয় কর্মী ইত্যাদি খ-কালীন কাজ করেন। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ হলেও যুব বেকারত্বের হার ১১.৬ শতাংশ। করোনাভাইরাসের কারণে জুন ২০২০ সাল নাগাদ সেটি আরও বেড়ে গেছে। এরমধ্যে অনেকেই আবার কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এর কারণ হচ্ছে, অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমদানি, রফতানি, রেমিটেন্স, রাজস্ব আয় সব সূচকেই দেখা যাচ্ছে উর্ধগতি। চাকরির বাজারকে ফিরিয়ে আনা তথা কর্মসংস্থান পুনরায় বাড়ানোর জন্য অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার খুব জরুরী। তৈরি পোশাকে এখন বড় আকারের ক্রয় আদেশ আসছে। এত বিপুল পরিমাণ আদেশ আসছে যে, গার্মেন্টস মালিকরা চাহিদা অনুযায়ী তৈরি পোশাক সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অর্থনীতির এই ঘুরে দাঁড়ানোকে যেভাবেই হোক ধরে রাখতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল হলে নতুন চাকরি তৈরি হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান। সেই সঙ্গে বাড়বে মানুষের আয়। বাংলাদেশের মানুষের অগ্রাধিকারের তালিকায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইস্যু অনেক নিচে। এসব নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত উদীয়মান ইস্যুগুলোতে সরকারের নজর দিতে হবে বেশি। এক্ষেত্রে আলোচ্য চ্যালেঞ্জগুলোর পরেই আসে সুশাসন। বঙ্গবন্ধুর শোষনমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের উন্নয়নের একটি বড় অংশ খেয়ে ফেলছে দুর্নীতি। নানাভাবে নতুন নতুন কায়দায় দুর্নীতি হচ্ছে। নিয়োগে দুর্নীতি, কেনাকাটায় দুর্নীতি, পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে দুর্নীতি, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতিÑঅর্থ ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট এমন কোন জায়গা নেই যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগের কারণে যারা টাকা দিয়ে সরকারী চাকরিতে নিয়োগ লাভ করেন, তারা কাজে যোগ দিয়েই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন দ্রুত ঘুষের টাকা ওঠানোর জন্য। তাই গোড়া থেকেই দুর্নীতি বন্ধ করার কাজটা শুরু করা জরুরী। এক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্তভাবেও যে নিয়োগ দেয়া যায় তার দারুণ নজির সৃষ্টি করেছে পুলিশ বাহিনী। আগে যেখানে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা দিয়ে পুলিশের কনস্টেবল পদে ঢুকতে হতো, সেখানে এবার কেবলমাত্র নামমাত্র ফি দিয়ে পুলিশে চাকরি পাওয়া গেছে। এই নজির আমরা সবখানে দেখতে চাই। দেখতে চাই প্রকল্পের কেনাকাটায় কমিশন প্রথা বিলোপ। বার বার ব্যয় ও প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির নামে সরকারী অর্থের যে লুটপাট চলছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া অত্যাবশ্যক। ইতোমধ্যে সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছেন। নতুন বছরে এই ঘোষণার পুরোপুরি বাস্তবায়ন দেখতে চাই। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে দেশে দুর্নীতিও একই হারে বেড়ে গেছে। এটি খুবই দুঃখজনক। আশি-নব্বইয়ের দশকে শোনা যেত, সচিবের ছেলেমেয়েরা টাকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় পড়াশোনা করে। এখন শোনা যায়, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর ছেলেমেয়েরাও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় পড়াশোনা করে স্কলারশিপ নিয়ে নয়, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে টাকা নিয়ে। এতেই বোঝা যায়, দুর্নীতি এখন কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করবে। দুর্নীতির মাত্রা কমাতে না পারলে উন্নয়নশীল দেশে গিয়ে নাইজিরিয়ার মতো অবস্থা তৈরি হবে। তাই, সমূলে উৎপাটনের জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান সরকার অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন করেছে। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় এক্ষেত্রেও সফলতা আসতে বাধ্য। ৫.০১. ২০২২ লেখক : সাংবাদিক
×