ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

খালি পেটে চিনি বা মিষ্টিজাত খাবার খেলেই গ্যাস্ট্রিক? জানুন কেন

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১০ জুলাই ২০২৫

খালি পেটে চিনি বা মিষ্টিজাত খাবার খেলেই গ্যাস্ট্রিক? জানুন কেন

ছ‌বি: প্রতীকী

সকালের নাস্তার আগে কিংবা দীর্ঘ সময় উপবাস থাকার পর অনেকেই অভ্যাসবশত এক কাপ চা বা কফির সঙ্গে বিস্কুট, মিষ্টি অথবা চিনিযুক্ত কিছু খেয়ে থাকেন। কেউ কেউ হয়তো খালি পেটে একটু মিষ্টি খেলেই বুক জ্বালা, অম্বল বা পেটে অস্বস্তি অনুভব করেন। এটা আসলে ‘গ্যাস্ট্রিক’ বা অ্যাসিডিটির প্রাথমিক লক্ষণ। কিন্তু কেন খালি পেটে চিনি বা মিষ্টিজাত খাবার খেলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়ে? চলুন এর পেছনের বৈজ্ঞানিক এবং শারীরিক কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।

খালি পেটে শরীরের বিপাকক্রিয়া ভিন্নভাবে কাজ করে। এই সময়ে পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের নিঃসরণ বাড়ে, যা স্বাভাবিক হজম প্রক্রিয়ার অংশ। কিন্তু যখন পাকস্থলীতে কোনো খাবার না থাকে, তখন এই অ্যাসিড সরাসরি পাকস্থলীর দেয়ালে আঘাত হানে। এতে পেটে জ্বালা, ব্যথা কিংবা অম্বলের সৃষ্টি হয়। আর ঠিক এমন সময় আপনি যদি চিনি বা মিষ্টিজাত কিছু খান, তখন সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে।

চিনি একটি উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাদ্য, যার অর্থ এটি খুব দ্রুত রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। খালি পেটে চিনি খেলে রক্তে গ্লুকোজ হঠাৎ করে বেড়ে যায় এবং শরীর তা সামাল দিতে বিপুল পরিমাণ ইনসুলিন নিঃসরণ করে। এই দ্রুত গ্লুকোজ-ইনসুলিন ওঠানামা রক্তে শর্করার ভারসাম্য নষ্ট করে এবং শরীরে এক ধরণের অস্থিরতা তৈরি করে। ফলে কিছু সময় পরেই ক্লান্তি, ঝিমুনি, মাথা ঘোরা বা মুড সুইং দেখা দিতে পারে। এসব উপসর্গের পাশাপাশি পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণ আরও বাড়ে, যা গ্যাস্ট্রিকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চিনি বা মিষ্টিজাত খাবারে সাধারণত তেমন কোনো আঁশ বা প্রোটিন থাকে না। ফলে এগুলো হজম হয় খুব দ্রুত, কিন্তু পাকস্থলীতে বেশিক্ষণ অবস্থান করে না। এতে পাকস্থলীতে শূন্যতা থেকেই যায়, অথচ অ্যাসিড নিঃসরণ থেমে থাকে না। এই অবস্থায় পাকস্থলীর দেয়ালে ক্ষতি হয় এবং গ্যাস্ট্রিক বা গ্যাস্ট্রাইটিসের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

চিনি হজমের সময় অতিরিক্ত গ্যাসও তৈরি করে। বিশেষ করে যখন এটি অন্য কোনো দুধজাত খাবারের সঙ্গে খাওয়া হয়, যেমন চা বা কফিতে দুধ-চিনি একসঙ্গে। তখন গ্যাস্ট্রিকের সম্ভাবনা আরও বেশি। কারণ, দুধ হজমের জন্য এক ধরণের এনজাইম প্রয়োজন হয়, যা সবার শরীরে পর্যাপ্ত মাত্রায় থাকে না। ফলে দুধের সঙ্গে চিনি খাওয়া অনেকের পেটে গ্যাস তৈরি করে এবং গ্যাস্ট্রিকের উপসর্গ সৃষ্টি করে।

শুধু চিনি নয়, মিষ্টিজাত খাবার যেমন মিষ্টি, কেক, পেস্ট্রি, চকলেট, এগুলোতেও একই রকম প্রভাব পড়ে শরীরের ওপর। এ ধরনের খাবারে উচ্চমাত্রায় চিনির পাশাপাশি কৃত্রিম রঙ, সংরক্ষক এবং ট্রান্স ফ্যাট থাকে, যা হজমপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে এবং পাকস্থলীতে অতিরিক্ত চাপ ফেলে। দীর্ঘদিন নিয়মিত খালি পেটে এই ধরনের খাবার খেলে শুধু গ্যাস্ট্রিক নয়, বরং আলসার কিংবা এসিড রিফ্লাক্সের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।

আরেকটি দিক হচ্ছে, চিনি খালি পেটে খাওয়া রক্তে করটিসল হরমোনের মাত্রা বাড়াতে পারে, যা স্ট্রেস হরমোন নামে পরিচিত। করটিসলের মাত্রা বেড়ে গেলে তা হজমপ্রক্রিয়ার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং পাকস্থলীতে আরও অ্যাসিড নিঃসরণ ঘটায়। ফলে গ্যাস্ট্রিক সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

এই সব কারণেই চিকিৎসকেরা এবং পুষ্টিবিদেরা পরামর্শ দেন, খালি পেটে কখনোই চিনি বা মিষ্টিজাত খাবার না খাওয়ার। বরং দিনের শুরুটা করা উচিত হালকা এবং সহজপাচ্য খাবার দিয়ে, যেগুলোতে আঁশ, প্রোটিন এবং জটিল কার্বোহাইড্রেট থাকে। যেমন— ওটস, দুধ ছাড়া চিড়া, সিদ্ধ ডিম, ফলমূল বা স্যুপজাতীয় খাবার। এতে পাকস্থলীতে ধীরে হজম হয়, অ্যাসিড নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়।

সুতরাং, খালি পেটে চিনি বা মিষ্টিজাত খাবার খাওয়ার অভ্যাস যদি আপনার থেকে থাকে, তবে এখনই তা বন্ধ করা উচিত। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে এটি হয়তো সামান্য অস্বস্তির কারণ মনে হতে পারে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি মারাত্মক গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় রূপ নিতে পারে। স্বাস্থ্যকর খাবার নির্বাচন এবং সময়মতো খাবার গ্রহণই পারে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে। স্বাস্থ্যই সবকিছুর ভিত্তি—সেই স্বাস্থ্যের জন্য দরকার সচেতনতা ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস।

এম.কে.

×