
ছবি: প্রতীকী
সকালের শুরুটা যেমন হয়, পুরো দিনের মেজাজ অনেকটা তেমনই গড়ে ওঠে। কিন্তু আজকের জীবনে অধিকাংশ মানুষের সকাল শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ, চাপ, ও নানা দায়িত্বের ভার নিয়ে। স্কুল বা অফিসে পৌঁছানোর তাড়া, ঘুম না হওয়া, যানজটের আশঙ্কা কিংবা কাজের চিন্তায় ঘুম থেকে উঠেই অনেকে মানসিক চাপে পড়ে যান। এই চাপের প্রভাব শরীরের নানা জায়গায় পড়ে, যার একটি বড় দিক হলো হজম ক্ষমতা। প্রশ্ন উঠতেই পারে— সকালের ব্যস্ততা ও মানসিক চাপ কি সত্যিই আমাদের হজম শক্তিকে দুর্বল করে?
শরীর ও মনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যখন মানসিক চাপ বাড়ে, শরীর তখন একটি "ফাইট-অর-ফ্লাইট" প্রতিক্রিয়ায় প্রবেশ করে। এই অবস্থায় কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন নামক স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়। এর ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে এবং রক্তের সঞ্চালন মস্তিষ্ক ও পেশির দিকে বেশি হয়। কিন্তু বিপাক ক্রিয়া বা হজম ব্যবস্থার মতো অপ্রয়োজনীয় (অর্থাৎ জীবনরক্ষাকারী নয়) প্রক্রিয়াগুলো তখন দমন হয়। শরীর তখন হজম নয়, বাঁচার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকে।
সকালে যদি কেউ মানসিক চাপ নিয়ে ঘুম থেকে ওঠেন বা নানা কাজের চাপ মাথায় নিয়ে ব্রেকফাস্ট করেন, তাহলে হজমের জন্য পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহ পাচনতন্ত্রে পৌঁছায় না। এতে গ্যাস্ট্রিক জুস বা পাচক রসের নিঃসরণ কমে যায়, যা খাবার হজমে বাধা সৃষ্টি করে। কেউ কেউ খেয়াল করেন, সকালে খাওয়ার পরও পেট ভার লাগছে, গ্যাস হচ্ছে বা ঢেকুর উঠছে। এসবই হজমজনিত সমস্যা, যার পেছনে সকালের মানসিক চাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে।
এছাড়া সকালের ব্যস্ততায় অনেকে ঠিকভাবে না চিবিয়ে তাড়াহুড়ো করে খেয়ে নেন, যা হজমের আরও বড় শত্রু। মুখে চিবানোর সময় লালায় এনজাইম মেশে, যা হজমের প্রথম ধাপ। সঠিকভাবে না চিবিয়ে খেলে খাবার পাকস্থলীতে গিয়ে বেশি সময় নেয় ভাঙতে, ফলে গ্যাস, অম্বল বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
অনেকে আবার সকালের ব্যস্ততায় নাস্তা বাদ দিয়ে দেন অথবা কেবল এক কাপ চা বা কফি খেয়ে অফিসের দিকে ছুট দেন। কিন্তু খালি পেটে কফি বা চা খাওয়ার ফলে পাকস্থলীর এসিড নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা গ্যাস্ট্রিক বা আলসারের ঝুঁকি বাড়ায়। আবার দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে পাচনতন্ত্র "অনিয়মিত রুটিনে" অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা হজম ক্ষমতার ধারাবাহিকতা নষ্ট করে।
আরেকটি দিক হলো ঘুম। মানসিক চাপগ্রস্ত মানুষ অনেক সময়ই রাতে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেন না। ঘুমের ঘাটতি মানসিক চাপকে আরও বাড়ায়, যা আবার হজম ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঘুমের সময় শরীর নিজেকে মেরামত করে, হজম প্রক্রিয়াও সক্রিয় থাকে। তাই পর্যাপ্ত ঘুম না হলে সকালে হজম শক্তি কমে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হজম ভালো রাখার জন্য শুধু স্বাস্থ্যকর খাবার খেলেই হবে না—তাকে ঠিক সময়, মনোযোগ দিয়ে খেতে হবে এবং খাওয়ার সময় মন শান্ত রাখতে হবে। সকালের মানসিক চাপ কমিয়ে ধীর গতির রুটিন তৈরি করতে পারলে হজম ক্ষমতা অনেকাংশে ভালো থাকে। ব্রেকফাস্টের সময় এক কাপ গরম পানি খাওয়া, ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাওয়া এবং ৫–১০ মিনিট সময় নিয়ে খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করলে তা হজমে সহায়ক হতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, সকালের ব্যস্ততা ও মানসিক চাপ একসাথে হজম প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে। এর থেকে বাঁচতে সকালের রুটিন একটু ধীরস্থির করা, আগেভাগে ঘুম থেকে ওঠা, মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন বা হালকা ব্যায়াম করা, এবং খাবার সময় মোবাইল বা টিভি বন্ধ রাখা— এসব ছোট পরিবর্তনও দীর্ঘমেয়াদে হজম ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। শরীর যদি মন ভালো না রাখে, মনও ভালো থাকবে না— এই সত্যটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই উপকার।
এম.কে.