
ছবি: প্রতীকী
সকালের সময়টাই পুরো দিনের ভিত গড়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম থেকে ওঠার পর শরীর ও মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে জাগ্রত হয় এবং একে একে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের কাজ শুরু করে। এই সময়টি যদি আমরা ঠিকভাবে কাজে না লাগাই, তাহলে এর প্রভাব শুধু সারাদিনে নয়, দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের উপরেও পড়ে। এক্ষেত্রে একটা বড় অভ্যাস হচ্ছে সকালে নাস্তা করার সময় মোবাইল ফোন স্ক্রল করা। আজকাল প্রায় সবাই এই অভ্যাসে আসক্ত, কিন্তু এটি কি শরীরের জন্য ভালো? বিশেষ করে পেটের হজমক্রিয়ার উপর এর কী প্রভাব পড়ে? চলুন বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
সকালে খাবার খাওয়ার সময় মনোযোগ অন্যদিকে সরে গেলে হজমে বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। মোবাইল ফোনে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করা, খবর পড়া বা ভিডিও দেখা আমাদের মনোযোগকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেয় খাওয়ার কাজ থেকে। তখন আমরা কী খাচ্ছি, কতটা খাচ্ছি বা আদৌ ঠিকভাবে চিবিয়ে খাচ্ছি কিনা, সেটা আর টের পাই না। ফলে হজম প্রক্রিয়া প্রথম ধাক্কাটা খায় মুখ থেকেই। খাবার চিবিয়ে না খেলে এনজাইম ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, ফলে পাকস্থলীতে গিয়ে খাবার ঠিকভাবে ভাঙে না। এতে গ্যাস্ট্রিক, অম্বল, পেট ফাঁপা, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে এসিড রিফ্লাক্সের সমস্যাও হতে পারে।
খাওয়ার সময় মনোযোগ ছড়িয়ে পড়লে শরীর খাবার গ্রহণের প্রস্তুতি ঠিকভাবে নেয় না। আমাদের প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম বা “রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট” সিস্টেম সক্রিয় হয় তখনই যখন মন শান্ত থাকে। কিন্তু ফোনে স্ক্রল করতে করতে নানা রকম খবর, ভিডিও বা ব্যক্তিগত বার্তা দেখে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়, স্ট্রেস হরমোন যেমন কর্টিসল বেড়ে যায়। এতে হজম প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এই অভ্যাস দীর্ঘদিন চলতে থাকলে হজমজনিত সমস্যাগুলো ক্রনিক আকার ধারণ করতে পারে।
এছাড়া সকালের খাবার শুধু শরীরের শক্তি যোগায় না, এটি আমাদের ইনসুলিন রেসপন্স ও বিপাকক্রিয়াকেও নিয়ন্ত্রণ করে। মনোযোগ দিয়ে খাওয়া হলে ইনসুলিন নিঃসরণ সঠিকভাবে হয় এবং গ্লুকোজ রক্তে ঠিকভাবে ছড়ায়। কিন্তু অন্যমনস্ক হয়ে খেলে ইনসুলিন রেসপন্স এলোমেলো হতে পারে, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। আবার, মোবাইল স্ক্রল করতে করতে আমরা অনেক সময় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেয়ে ফেলি, কারণ আমাদের মস্তিষ্ক তখন তৃপ্তির সিগনাল ঠিকভাবে বোঝে না। ফলে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ হয় এবং ওজন বাড়তে থাকে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, খাওয়ার সময় ফোন স্ক্রল করার অভ্যাসটি মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও ক্ষতিকর। এটি একধরনের ডিজিটাল আসক্তির প্রতিফলন, যেখানে আমরা খাওয়াকেও মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করতে পারি না। এমনকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সকালের শান্ত সময়টুকুও ভাগ করে নিতে পারি না। খাবার শুধু শরীরের প্রয়োজন পূরণ করে না, এটি একটি সামাজিক ও মানসিক অভিজ্ঞতাও। মনোযোগ দিয়ে খাওয়ার মাধ্যমে আমাদের মানসিক তৃপ্তি বাড়ে, যা পরোক্ষভাবে হজমেও সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, যারা মনোযোগ দিয়ে খাবার খায় বা “মাইন্ডফুল ইটিং” চর্চা করে, তাদের হজম ভালো হয়, ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদে নানা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগ থেকে মুক্ত থাকে। কিন্তু ফোন স্ক্রল করতে করতে খাওয়ার ফলে আমরা এই সচেতনতা হারিয়ে ফেলি। এটি শুধু একটি শারীরিক নয়, বরং একটি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও।
সবশেষে বলা যায়, সকালের খাবার সময় ফোন স্ক্রল করার অভ্যাস আমাদের হজমপ্রক্রিয়াকে বহুমাত্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই এই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। সকালের খাবার খান শান্ত পরিবেশে, ফোনকে দূরে রাখুন, এবং খাওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করুন। এতে শুধু পেট ভালো থাকবে না, মেজাজও ফুরফুরে থাকবে সারাদিন।
এম.কে.