
ছবি: সংগৃহীত
স্কুল, হোমওয়ার্ক আর স্মার্টফোনে ব্যস্ত জীবনের কারণে সপ্তাহের দিনগুলোতে ঘুম যেন টিনএজারদের জন্য বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। তবে নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহান্তে কিছুটা ঘুমিয়ে নেওয়া মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি হতে পারে— তবে তা যেন মাত্রার মধ্যে থাকে।
‘স্লিপ ২০২৫’ সম্মেলনে প্রকাশিত এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন ইউনিভার্সিটি অব ওরেগনের ক্লিনিকাল সাইকোলজির পিএইচডি শিক্ষার্থী সোজিয়ং কিম। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী ১,৮৭৭ কিশোর-কিশোরীর ঘুমের অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণায় ফিটবিট ট্র্যাকার ব্যবহার করে ঘুমের সময় পরিমাপ করা হয় এবং চাইল্ড বিহেভিয়ার চেকলিস্টের মাধ্যমে মানসিক অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়।
ফলাফলে দেখা যায়, যেসব টিনএজাররা সপ্তাহান্তে একেবারেই ঘুম বাড়ায়নি কিংবা দুই ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছে, তাদের মাঝে উদ্বেগের লক্ষণ বেশি ছিল। তবে যারা সপ্তাহান্তে ১ থেকে ২ ঘণ্টা বেশি ঘুমিয়েছে, তারা তুলনামূলকভাবে বেশি স্বস্তি ও মানসিক ভারসাম্য অনুভব করেছে। অর্থাৎ, ঘুমের ক্ষেত্রে একটি “মাঝামাঝি মাত্রা” সবচেয়ে উপকারী।
গবেষক কিম জানান, “সপ্তাহের দিন আর সপ্তাহান্তে ঘুমের সময়ের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকলে বা একেবারেই পার্থক্য না থাকলে মানসিক ক্লান্তি ও উদ্বেগ আরও বেড়ে যেতে পারে। সঠিক ভারসাম্য খুঁজে পাওয়াটাই আসল চাবিকাঠি।”
সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ২৩% মার্কিন হাইস্কুল শিক্ষার্থী প্রতি রাতে প্রয়োজনীয় ৮–১০ ঘণ্টার ঘুম পাচ্ছে। বেশিরভাগ টিনএজারই রাতে গড়ে মাত্র ৬–৭ ঘণ্টা ঘুমায়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
ঘুম কম হওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা দেরি করে মোবাইল ব্যবহার, অতিরিক্ত পড়াশোনা, ক্যাফেইনের ব্যবহার ও সামাজিক ব্যস্ততাকে দায়ী করছেন। তবে সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি হলো স্কুলের ক্লাস শুরুর সময়। র্যান্ড কর্পোরেশনের সিনিয়র বিহেভিরিয়াল সায়েন্টিস্ট ড. ওয়েন্ডি ট্রক্সেল বলেন, “কিশোর বয়সে শরীর ঘুমাতে ও জেগে উঠতে একটু দেরিতে সাড়া দেয়। তাই সকাল ৭টায় ক্লাস শুরু মানে যেন একজন প্রাপ্তবয়স্ককে ভোর ৪টায় কাজে যেতে বলা।”
সপ্তাহের দিনের তুলনায় দুই ঘণ্টার বেশি দেরিতে ঘুম থেকে উঠলে শরীরের ঘুম-জাগরণ চক্রে গোলমাল দেখা দেয়, যাকে “সোশ্যাল জেটল্যাগ” বলা হয়। এতে রবিবার রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয় এবং সোমবার সকালে ওঠাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন ভিন্ন টাইম জোনে ভ্রমণ করেছেন।
আমেরিকান একাডেমি অব স্লিপ মেডিসিন জানায়, এই অনিয়ম মনোযোগ, মেজাজ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
গবেষণাটি বলছে, সপ্তাহান্তে একেবারে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা উচিত নয়, আবার একেবারেই না ঘুমিয়ে ঘাটতি পূরণ না করাও ঠিক নয়। বরং সীমিত মাত্রায় অতিরিক্ত বিশ্রাম গ্রহণ উপকারী। কীভাবে তা সম্ভব:
প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করুন, এমনকি সপ্তাহান্তেও। পার্থক্য যেন ১–২ ঘণ্টার মধ্যে থাকে।
রাতের বেলায় মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপ ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনুন। এদের নীল আলো ঘুমের হরমোন মেলাটোনিন উৎপাদনে বাধা দেয়।
দিনের বেলা ঘুমালে তা যেন ২০–৩০ মিনিটের বেশি না হয়, নয়তো রাতের ঘুম নষ্ট হতে পারে।
স্কুল শুরু হওয়ার সময় পিছিয়ে নেওয়ার দাবিতে অভিভাবক ও শিক্ষক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে, কারণ এটি টিনএজারদের ঘুম ঘাটতির মূল কারণগুলোর একটি।
শুধু আরাম বা শারীরিক বিশ্রামের জন্য নয়—ঘুম সরাসরি প্রভাব ফেলে কিশোরদের চিন্তাভাবনা, আবেগ ও আচরণে। নিয়মিত ঘুমের ঘাটতি বিষণ্নতা, উদ্বেগ, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ এমনকি পড়াশোনার মান খারাপ হওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের মনোবিজ্ঞানী ড. শেলবি হ্যারিস বলেন, “এই গবেষণা দেখায় ঘুম কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা জরুরি। তবে এটাও মনে রাখা জরুরি, বেশি ঘুম সবসময় ভালো নয়— ঘুমের পরিমাণের পাশাপাশি ছন্দ আর ভারসাম্যও গুরুত্বপূর্ণ।”
তাই টিনএজারদের জন্য সপ্তাহান্তে ১–২ ঘণ্টা বেশি ঘুম একটি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস হতে পারে। এটি উদ্বেগ কমায়, শক্তি ফিরিয়ে আনে, এবং ব্যস্ত সপ্তাহ পার করার জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক প্রস্তুতি দেয়। তবে সীমা ছাড়িয়ে গেলে উল্টো ক্ষতি হতে পারে।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
এম.কে.