ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

বিলুপ্তির এক শতাব্দী পর ফিরে আসার গল্প

আল্পস পর্বতে আবার উড়ছে দাড়িওয়ালা শকুন

প্রকাশিত: ০০:৩৪, ৯ জুলাই ২০২৫

আল্পস পর্বতে আবার উড়ছে দাড়িওয়ালা শকুন

প্রতি বছর বরফ গলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আল্পস পর্বতের শিখর থেকে ছোট ছোট দাড়িওয়ালা শকুনেরা (Bearded Vultures) প্রথমবারের মতো আকাশে ওড়ে। তখন তারা নিজের খাবার নিজেই খুঁজে নিতে শেখে—কোনো জীবন্ত শিকার নয়, বরং বরফে জমে থাকা মৃত আইবেক্স ও পর্বতের ছাগলের মৃতদেহ খুঁজে নেয় তারা। গ্রীষ্ম যত বাড়ে, এই যুবক পাখিদের নজর চলে যায় আরও শক্ত কিছু খাবারের দিকে—হাড়। কারণ, দাড়িওয়ালা শকুন হলো একমাত্র প্রাণী, যাদের খাদ্যের প্রায় পুরোটাই হাড় দিয়ে তৈরি।

তবে এক শতাব্দী আগে, ইউরোপের আল্পস পর্বতমালায় আর দেখা যেত না এই পাখিকে। মানুষের ভুল ধারণার কারণে—যে তারা ছাগলছানা এমনকি শিশুদেরও ধরে নিয়ে যায়—তাদের শিকারে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। শেষ বুনো দাড়িওয়ালা শকুনটিকে ১৯১৩ সালে ইতালির আওস্তা উপত্যকায় গুলি করে মারা হয়।

কিন্তু Vulture Conservation Foundation (VCF)-এর নেতৃত্বে একটি পুনঃপ্রবর্তন প্রকল্পের মাধ্যমে, এখন আবার ফিরে আসছে এই শকুন। ১৯৮৬ সাল থেকে VCF বন্দী অবস্থায় জন্মানো শকুনদের বুনোতে ছেড়ে দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত আল্পসে ২৬৪টি পাখি ছাড়া হয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে জন্মেছে ৫২২টি বুনো শকুন ছানা। ২০০৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই প্রজাতিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে। ফ্রান্সে কেউ শিকার করলে সর্বোচ্চ €১৫০,০০০ জরিমানা ও তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

২০২৪ সালেই জন্মেছে ৬১টি বুনো ছানা। বর্তমানে আল্পসে দাড়িওয়ালা শকুনের সংখ্যা প্রায় ৪৬০। এক সময় যেসব কৃষক এদের হত্যা করতেন, আজ তারা পাহাড়ে হাইকিংয়ের সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে এই বিরল পাখির দেখা খোঁজেন।

বিপুল ডানার বিস্তার, বিশেষ খাদ্যাভ্যাস

দাড়িওয়ালা শকুনের ডানার প্রস্থ প্রায় ২.৮৫ মিটার (৯.৩ ফুট), যা দিয়ে তারা দিনে ৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ওড়ার ক্ষমতা রাখে। গলা, মাথা ও বুকের পালক আসলে সাদা হলেও তারা পাহাড়ি লৌহসমৃদ্ধ কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে নিজেকে কমলা রঙে রাঙিয়ে ফেলে।

তবে নামটি এসেছে ঠোঁটের নিচে থাকা কালো দাড়ির মতো পালক থেকে।

তারা মূলত মাংস নয়, হাড় খায়। খাদ্যের ৮৫% হাড়। বড় হাড় হলে তারা তা উচ্চতা থেকে পাথরে ফেলে ভেঙে নেয় এবং ভিতরের পুষ্টিকর মজ্জা খায়।

বিপদের শেষ হয়নি এখনো

বর্তমানে কৃষকরা আর শিশু বা ভেড়া হারালে এদের দোষ দেন না, কিন্তু বিপদ এখনো রয়েছে। বিষাক্ত মৃত পশু খাওয়ার মাধ্যমে বিষক্রিয়া, বিদ্যুৎ লাইনের সঙ্গে ধাক্কা, উইন্ড টারবাইনে সংঘর্ষ এবং আবাসস্থল হারানো—সব মিলিয়ে গত তিন প্রজন্মে বিশ্বের দাড়িওয়ালা শকুনের সংখ্যা ২৯% কমে গেছে।

তার উপর প্রতি বছর একটি প্রজননজোড়া কেবল এক-দুটি ডিম পাড়ে, এবং যদি দুটি ছানাই ফোটে, বড়টি ছোটটিকে মেরে ফেলে।

বন্দী থেকে বুনো—পুনর্জন্মের রোমাঞ্চ

প্রথমে আফগানিস্তান থেকে শকুন ধরে এনে আল্পসে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। পরে ১৯৮৬ সালে অস্ট্রিয়ার একটি সেন্টারে জন্ম নেওয়া তিনটি পাখি সফলভাবে মুক্ত করে প্রকল্প চালু হয়।

ছানাদের কৃত্রিম বাসায় রাখা হয়, যাতে তারা পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। ২০–৩০ দিন পর তারা প্রথম উড়ে যায়। ২০২০ সালে একটি শকুন ফ্রান্স থেকে উড়ে ১২০০ কিলোমিটার দূরে ইংল্যান্ডের পিক ডিস্ট্রিক্টে চলে গিয়েছিল।

তবে প্রাপ্তবয়স্ক হলে তারা সাধারণত নিজেদের জন্মস্থানেই ফিরে আসে।

জেনেটিক বৈচিত্র্য ও জলবায়ু অভিযোজন

VCF-এর পরিচালক জোসে তাভারেস বলেন, “আল্পসে সংখ্যা এখন স্থিতিশীল, তাই আমরা এখন বৈচিত্র্য বাড়ানোর জন্য জেনেটিক ভিন্ন পাখি ছাড়ছি—জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে টিকে থাকার জন্য যা জরুরি।”

স্পেনে ভ্যালকেলেন্ট প্রজনন কেন্দ্রেও চলছে এর কাজ।

আল্পস ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে রক্ষা পরিকল্পনা

আল্পসে প্রকল্প ধীরে ধীরে কমানো হচ্ছে, কারণ এখন পাখিরা প্রাকৃতিকভাবে বংশবৃদ্ধি করছে। তবে এখন স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া ও আন্দালুসিয়া, ফ্রান্সের ম্যাসিফ সেন্ট্রাল, বালকান অঞ্চল ও উত্তর আফ্রিকায় নতুন প্রকল্প চালু হচ্ছে।

এদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে লেসোথো ও দক্ষিণ আফ্রিকার মালোটি-ড্রাকেনসবার্গ পর্বতে চলছে একটি পৃথক উদ্ধার প্রকল্প। যেহেতু এখানে বন্দী প্রজননের সুযোগ ছিল না, তাই যদি একটি শকুন দুটি ডিম দেয়, তবে একটি ছানাকে (যা সাধারণত মারা যেত) নিয়ে গিয়ে লালনপালন করে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এখন তারা বন্দী অবস্থায় ২৭টি ছানা লালন করছে এবং লক্ষ্য ১৫০টি বুনো প্রজননজোড়া গড়ে তোলা।

একদা নিখোঁজ, আজ আকাশে উড়ছে

বহু দেশজুড়ে এ ধরনের উদ্যোগের ফলে দাড়িওয়ালা শকুনের আবার নতুন করে উড়াল দেওয়ার আশাবাদ দেখা যাচ্ছে। এক শতাব্দী আগেও যাকে মানুষ বিলুপ্ত করেছিল, সেই পাখিই আজ নতুন করে পৃথিবীর আকাশে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

Jahan

×