ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ ফারুক হোসেন

করোনা বর্জ্যরে কারণে সংক্রমণের হার বাড়ছে

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ২৪ জুন ২০২০

করোনা বর্জ্যরে কারণে সংক্রমণের হার বাড়ছে

বিশেষজ্ঞদের মতে বিগত তিন মাসে প্রায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন করোনা মেডিক্যাল বর্জ্য তৈরি হয়েছে। যত্রতত্র মেডিক্যাল বর্জ্য ফেলার কারণে বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীতে প্রতিদিন বেড়েই চলেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী এবং তাদের ব্যবহৃত মেডিক্যাল বর্জ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে কাপড়ের তৈরি তিন স্তর বিশিষ্ট মাক্স মানসম্মত। বর্তমানে করোনাভাইরাসের মহামারীতে বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনগণদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। স্বাস্থ্যসম্মত সুরক্ষা সামগ্রী এবং মানসম্মত মাক্স ব্যবহারের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। মহামারীর ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেন মানুষ মাক্স এবং সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়া বের হতে না পারে। করোনাভাইরাসের আরেক আতঙ্কের নাম করোনার মেডিক্যাল বর্জ্য। এগুলো যত্রতত্র এখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে। আক্রান্ত রোগী মৃত্যুর পর তাকে দাফন করার পর সেই সব ব্যবহারের জিনিসপত্র সেখানে ফেলে রাখা হচ্ছে এর ফলে এই দ্বার অন্যরা সংক্রমিত হচ্ছে। ব্যবহারের পর ব্যবহারকারী যে হ্যান্ড গøাভস, পিপি, মাক্স যেখানে সেখানে ফেলছে এতে করে যেমন পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি জীবন এবং সংক্রমণ মাত্রা আরও তীব্রতর হচ্ছে। আমাদের সচেতনতার অভাবে দিনদিন আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছি। প্রতিদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কর্মীরা এগুলো পরিষ্কার করছে। আবার আমরা অসচেতনভাবে এগুলো যেখানে-সেখানে ফেলছি। পরিবেশটাকে নোংরা করছি। আবার কোথাও দেখা যায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কর্মীরা এগুলো পরিষ্কার করছে না। এগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। বরং সেগুলো প্রতিদিন না সংক্রমণের মাত্রাকে আরও ভয়াবহ রূপ দিচ্ছে। বিশ্বের যেসব দেশ পরিষ্কারের ব্যাপারে সচেতন ভ‚মিকা পালন করছে তারা একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। সুতরাং এসব বর্জ্য যেন প্রকৃতির এবং মানুষের ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে আরও কঠোর হতে হবে। প্রশাসনকে যেমন কঠোর হতে হবে তেমনি আমাদের সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। যেন এটি দ্বারা আমরা পরিবেশের এবং মানুষের ক্ষতি না করি এবং সংক্রমণের মাত্রাকে আরও ত্বরান্বিত না করি। রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তাহলে জিনিসটা কেমন শোনা যায় বা দেখা যায় বাস্তবিক অর্থে তাই হচ্ছে। যেসব সুরক্ষার জিনিস যেমন মাক্স, হ্যান্ড গøাভস, টিপি, হ্যান্ড স্যানিটাইজারÑমোটকথা বর্তমানে মানুষ করোনা মহামারী থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য যেসব সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করছে এবং ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবাদানের সময় যে সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করছে সেগুলো যথাযথভাবে ফেলা হচ্ছে না। আরেকদিকে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পোশাক এবং ব্যবহার সামগ্রী দাফনের পর সেখানেই ফেলে রাখা হচ্ছে। এগুলো সংক্রমণের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে কাজ করে। কয়েকদিন আগে প্রকৃতি তার হারিয়ে যাওয়া যে পরিবেশ ফিরে পেয়েছিল আস্তে আস্তে তা আবার হারাতে শুরু করেছে এবং আরও বিপর্যয় ডেকে আনছে। বর্তমানে অনেক দেশের সমুদ্র এবং সাগরের মধ্যে আবার নদী-নালার মধ্যেও এসব বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশেও ড্রেন-নর্দমায় এবং নদীনালা ও খাল-বিলে যত্রতত্র এগুলো পাওয়া যাচ্ছে। এসব বর্জ্য আরেক মহামারী সৃষ্টি করতে পারে। দেখা যাবে এটা ঘুরেফিরে আমাদের মধ্যেই চলে আসছে। কয়েকদিন আগে প্রাকৃতিক যে সুন্দর পরিবেশে এসেছিল, প্রকৃতি তার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছিল তা বিলীন হতে একদম সময় লাগবে না। একমাত্র সচেতনতাই হতে পারে মহামারী থেকে পাওয়ার আরেকটা সুরক্ষা কবজ। এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবেÑ সচেতনতাই পারে আমাদের সুস্থ রাখতে এবং এই পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সুস্থ মানুষের শরীরে। এ জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা জরুরী। এ ছাড়া করোনা রোগীদের সংস্পর্শে যাদের আসতেই হবে (চিকিৎসক, নার্স) তাদের অবশ্যই ভাইরাস প্রতিরোধী সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই-মাস্ক-গøাভস) পরিধান করে যেতে হবে রোগীদের সামনে। ব্যবহারের পর আবার সুরক্ষা সামগ্রীগুলো সঠিকভাবে ডিসপোজ করতে হবে। এগুলো যদি যেখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকে তা থেকেও ছড়াতে পারে ভাইরাস। চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করলেও বদলায়নি পরিস্থিতি। যেখানে সেখানে ব্যবহৃত পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ড গøাভস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। চিকিৎসকরা বলছেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পিপিই-মাস্ক ও হ্যান্ড গøাভস থেকে করোনাভাইরাসের জীবাণু ছড়াতে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছে এর পরও আমরা সচেতন নই। দেশে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যত দিন যাচ্ছে সংখ্যা তত বাড়ছে। আক্রান্ত ও মৃতের উর্ধমুখিতার কারণে চিন্তিত সবাই। করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব রোধে সরকার দফায় দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল। প্রথম প্রথম মানুষ ঘরে থাকলেও অঘোষিত এ লকডাউন কিছুটা শিথিল হওয়ার পর আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে খুলে দেয়া হয়েছে কিছু কিছু মার্কেট ও কলকারখানা। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হওয়ার পরও লকডাউন শিথিল করে মার্কেট, পোশাক কারখানা খুলে দেয়া; মানুষের কেয়ারলেস চলাফেরা; সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব না মানা, সুরক্ষা সামগ্রীর যত্রতত্র ব্যবহার ও সঠিক ডিসপোজ না করা এবং মানুষের মধ্যে ভীতি না থাকায় করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। উপসর্গহীন ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ করোনা ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীও সুপার স্প্রেডার হিসেবে কাজ করছে। পিপিই বলতে শুধু গাউন নয়, মাস্ক, আই প্রটেক্টরও আছে। শিথিল লকডাউন, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব না মানা, মাস্ক, গøাভসসহ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী যত্রতত্র ব্যবহার ও এর সঠিক ডিসপোজাল না করাÑ করোনায় সংক্রমিত ও মৃত্যুর হার বাড়ার কারণ। কবরস্থানে মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ব্যবহৃত পিপিই কিট। আর তা কুকুরে টেনে আনছে লোকালয়ে। ফলে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা বাড়ছে। কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হয়ে যাঁরা মারা যাচ্ছেন তাঁদের কবর দেয়া হচ্ছে এখানে। কবর দেয়ার জন্য কর্মী ও মৃতের পরিবারকে দেয়া হচ্ছে পিপিই কিট। সেই কিট ব্যবহারের পর ফেলে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ। কিন্তু এভাবে ফেলে রাখায় দূষণের সম্ভাবনাও বাড়ছে। কারণ এই পিপিই কিট নষ্ট করার একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রত্যেকটা কবর দেয়ার সময় অন্তত ১৬টা সেফটি কিট দেয়া হয়। তার মধ্যে গøাভস, মাস্ক, জুতা সব থাকে। কবর দেয়ার পর সেগুলো সেখানেই ফেলে দেয়া হচ্ছে। সংক্রমণের ভয়ে সাফাইকর্মীরা তা তুলছে না। কুকুর মুখে করে সেগুলো লোকালয়ে নিয়ে আসছে। এতে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ছে। এভাবে পিপিই কিট যেখানে সেখানে পড়ে থাকলে তার থেকে সংক্রমণ মারাত্মক আকার নিতে পারে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এখন পাওয়া যাচ্ছে জীবাণুর থেকে সুরক্ষার পোশাক পিপিই। এগুল কতটা মানসম্মত বা পরিবেশবান্ধব আমরা তা জানি না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরে ঘরে যে পিপি, মাস্ক-গøাভস ব্যবহার করা হচ্ছে, যথাযথ পদ্ধতিতে নষ্ট না করলে তা পরিবেশ দূষণ ঘটাতে পারে। এমনটাই আশঙ্কা পরিবেশবিদদের। আত্মরক্ষার জন্য যে উপকরণগুলো অত্যাবশ্যকীয়, ভবিষ্যতে তা হয়ে উঠতে পারে বিপদের কারণ। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের এই সতর্কবার্তার লক্ষ্য একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেয়া মাস্ক, গøাভস। বিশেষ করে পলিভিনাইলের প্রয়োগে তৈরি দীর্ঘমেয়াদি মাস্ক এবং নাইট্রাইল ও ভিনাইল গøাভস। ইতোমধ্যেই অনেক দেশের বড় শহরেই মাস্ক ও গøাভস-দূষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। কোনভাবেই ব্যবহৃত পিপিই, মাস্ক, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখা যাবে না। এগুলো থেকেও করানো ভাইরাস এর জীবাণু ছড়াতে পারে। এগুলো নিয়ম অনুযায়ী ডিসপোজ করতে হবে। হাসপাতালে ডিউটি শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহৃত পিপিই, মাস্ক, গøাভসসহ অন্যান্য সবকিছু নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে এগুলো খুলে সঠিকভাবে একটি ব্যাগে ভরে নিয়ম অনুযায়ী এগুলো ডিসপোজ করতে হবে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ এবং হংকং ও জাপানে দেখা গিয়েছে সমুদ্র সৈকতে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ফেলে দেয়া মাস্ক, গøাভস। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও। রাস্তার ধারে যত্রতত্র পড়ে থাকছে এই সামগ্রী। এ নিয়ে চিন্তায় পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক সুবর্ণা ভট্টাচার্য বলছেন, ‘যে ভাবে বায়োামেডিক্যাল বর্জ্য আলাদা করে বিশেষ উপায়ে নষ্ট করা হয়, মাস্ক ও গøাভসের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনই করা উচিত। না হলে পরিবেশের ক্ষতি হবে।’ পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, সুতির মাস্ক পরিবেশের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ। তবে নানা ধরনের প্লাস্টিকের সকেট দেয়া যে মাস্কের বিক্রি এখন বেড়েছে, তার অনেকগুলোতেই পলিপ্রোপিলিন থাকে। এই রাসায়নিক যৌগ পরিবেশে মিশতে সময় লাগে। অতি উচ্চ তাপমাত্রায় এই সামগ্রীগুলো নষ্ট করা উচিত। বাড়িতে ব্যবহারের পর মাস্ক ও গøাভস বিøচিং পাউডার বা সাবান বা জীবাণুনাশাক দিয়ে পানি দিয়ে ভাল করে ধুয়ে আলাদা করে রাখা উচিত। আতঙ্কে মানুষ এখন বেশি করে মাস্ক-গøাভস কিনছে। আতঙ্কের প্রহর কাটলে যেন যথাযথভাবে তা নষ্ট করার কথাও মনে রাখা উচিত। পুকুর বা ড্রেনে ফেলা উচিত নয়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যেখানে-সেখানে ব্যবহার করা পিপি, মাস্ক ও গøাভস ফেলা থেকে বিরত থাকা বাঞ্চনীয়। আতঙ্কিত না হয়ে বরং আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত। লেখক : গবেষক
×